Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অফিস নেই খরচ নিচ্ছেন ১৮৭ এমপি

প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১০ এএম, ১৫ নভেম্বর, ২০১৬

হাবিবুর রহমান
নির্বাচনী এলাকার অফিস খরচ বাবদ মাসে ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ এমপিদের জন্য। তিনশ’ আসনের মধ্যে ১৮৭ জন এমপি বরাদ্দকৃত টাকা নিলেও তাদের নির্বাচনী এলাকায় কোনো অফিস নেই। কোনো কোনো এমপি সরকারি অফিস দখল করে আছেন। জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রত্যেক এমপিকে নিজ এলাকায় অফিস পরিচালনার জন্য মাসে মাসে টাকা দেয়া হয়। তারা সে টাকা খরচ না করে পকেটে রেখে দিলে কী-ই বা করার আছে? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ এমপিদের নির্বাচনী এলাকায় অফিস ভাড়া না নিয়ে বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলনকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে. চলতি সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৪ জন, স্বতন্ত্র ১৪ জন এবং জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি মিলে ৬ জন এমপি আছেন। ৩০০ জন এমপির মধ্যে ২১৪ জন ব্যবসায়ী ও ৪৮ জন আইনজীবী। আর রাজনীতিকে পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ২২ জন। নির্বাচনী এলাকায় এমপিদের অফিস খরচের জন্য আগে বরাদ্দ ছিল মাসে ৯ হাজার টাকা। জাতীয় সংসদে এই টাকা বাড়ানোর দাবি তুললে ৯ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ হাজার টাকা করা হয়। প্রতি মাসে বেতনের সাথে এই টাকা তুলে নিচ্ছেন এমপিরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশে জাতীয় সংসদের তিনশ’ আসনের মধ্যে অন্তত ১৮৭টি নির্বাচনী এলাকায় এমপিদের নিজস্ব কোনো অফিস নেই। যাদের আছে তারা সরকারি অফিস ব্যবহার করছেন। অনেক এমপি সরকারি অফিসের ভাড়াও ঠিকমতো দেন না। দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি নাজমুল হক প্রধানের কোনো নির্বাচনী অফিস নেই। পঞ্চগড়-২ আসনের এমপি নুরুল ইসলাম সুজন, ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সরকারদলীয় সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের এমপি মো: ইয়াসিন আলীর কোনো অফিস নেই। দিনাজপুর-১ আসনের সরকারি দলের এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল বাসায় অফিস করেন। দিনাজপুর-৪ আসনের এমপি বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, দিনাজপুর-৬ আসনের এমপি মো: শিবলী সাদিক, নীলফামারী-১ আসনের এমপি আফতাব উদ্দিন সরকার, লালমনিরহাট-২ আসনের এমপি বর্তমান সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, লালমনিরহাট-৩ আসনের এমপি আবু সালেহ মোহাম্মদ সাইদ (দুলাল)-এর কোনো নির্বাচনী অফিস নেই। রংপুর-১ আসনের এমপি বর্তমান সরকারের প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা তার নির্বাচনী এলাকায় অফিস নেই। তবে এলাকায় গেলে তিনি রংপুর জেলা বাস মালিক সমিতির অফিসে বসেন। কুড়িগ্রাম-১ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান এলাকায় গেলে বাড়িতেই অফিস করেন। কুড়িগ্রাম-১ আসনের এমপি বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর নিজস্ব কোনো অফিস নেই। তবে জেলা শহরে বাড়ি হওয়ায় তিনি জাতীয় পার্টির অফিস ব্যবহার করেন। কুড়িগ্রাম-৩ আসনের এমপি সাবেক মন্ত্রী এ কে এম মাঈদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে অফিস করলেও এবার সরকারি অফিস নিয়েছেন। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপির (জাতীয় পার্টি মঞ্জু গ্রুপ) নিজ বাড়িতেই অফিস করেছেন। গাইবান্ধা-৩ আসনের এমপি ডা: মো: ইউনুস আলী সরকার, গাইবান্ধা-৪ আসনের এমপি মো: আবুল কালাম আজাদ, জয়পুরহাট-১ আসনের এমপি সামছুল আলম দুলুর কোনো নির্বাচনী অফিস নেই। বগুড়া-৩ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম তালুকদারের অফিস তো দূরে থাক এলাকার জনগণের সাথে কোনো সম্পর্কও তিনি রাখেন না। বগুড়া-৫ আসনের এমপি মো: হাবিবুর রহমান, বগুড়া-৭ আসনের এমপি মুহাম্মদ আলতাফ আলী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের এমপি মুহা: গোলাম মোস্তফা, নওগাঁ-১ আসনের এমপি সাধন চন্দ্র মজুমদার, নওগাঁ-৫ আসনের এমপি মো: আব্দুল মালেক, নাটোর-১ আসনের এমপি আবুল কালাম, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আবদুল মজিদ ম-ল, পাবনা-২ আসনের এমপি খন্দকার আজিজুল হক আরজু, মেহেরপুর-১ আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন, কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি আবদুর রউফ, ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি মো: নবী নেওয়াজ, পটুয়াখালী-১ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, যশোর-৪ আসনের এমপি রনজিত কুমার রায়, যশোর-৬ আসনের এমপি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, ঢাকার এমপি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামসহ অনেকের নির্বাচনী এলাকায় অফিস নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় সংসদের এক কর্মকতা বলেন, এর আগে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এমপিদের বিমান ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এবার এমপিদের নির্বাচনী অফিস খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা এমপিদের খরচগুলো স্বচ্ছতার আওতায় আনার জন্য বলেছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
নির্বাচনী এলাকায় অফিস না থাকার বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন এমপির সাথে। পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি নাজমুল হক প্রধান ইনকিলাবকে বলেন, আমার অফিস নেই। আমি একটি পাঠাগারে আগে থেকে বসতাম। এখনও সেখানেই বসি। তিনি বলেন, অফিস খরচ বাবদ জাতীয় সংসদ থেকে যে টাকা দেয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়। নীলফামারী-১ আসনের এমপি মো: আফতাব উদ্দিন সরকার বলেন, আমার অফিস নেই। ডিমলা সদর উপজেলায় বাড়ি হওয়ার কারণে বাড়িই আমার অফিস। তিনি বলেন, বাড়িতে অফিস হলেও অনেক হয়। তিনি বলেন, এই টাকা আরো বাড়ানো উচিত। নাটোর-১ আসনের এমপি মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার কোনো অফিস নেই। তবে আমি সবসময় পার্টি অফিসে বসি। তারপর বাগাতিপাড়ায় মাঝে মধ্যে যাই। কুড়িগ্রাম-৩ আসনের এমপি সাবেক মন্ত্রী এ কে এম মাইদুল ইসলাম বলেন, সরকার যে অফিস ভাড়া দেয়, তার চেয়ে আমার বেশি খরচ হয়। আমার অফিস আছে। তারপরও জনগণের সুবিধার জন্য আমি একটি অফিস নিয়েছি। সেখানে একজন কর্মকর্তা ও পিয়ন রয়েছে। তাদের বেতন-ভাতা আমাকে দিতে হয়। এরপরও আমার বাড়ি সকলের জন্য উন্মুক্ত।
যেসব এমপির নির্বাচনী এলাকায় অফিস আছে তারা হলেনÑ দিনাজপুর-২ আসনের এমপি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর-৩ আসনের এমপি জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম, দিনাজপুর-৫ আসনের এমপি বর্তমান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, লালমনিরহাট-১ আসনের এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, জাতীয় সংসদের হুইপ আ স ম ফিরোজ, ভোলা-১ আসনের এমপি ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, বরিশাল-১ আসনের এমপি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, বরিশাল-৪ আসনের এমপি পংকজ দেনাথ, ঝালকাঠি-২ আসনের এমপি বর্তমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, টাঙ্গাইল-১ আসনের এমপি আব্দুর রাজ্জাক, শেরপুর-১ আসনের এমপি আতিউর রহমান আতিকসহ বেশ কিছু মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর অফিস রয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
সরকারি কোষাগার থেকে মাসে মাসে টাকা নেয়ার পরও নির্বাচনী এলাকায় অফিস না থাকার বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, এটা দুঃখজনক। তিনি বলেন, নবম জাতীয় সংসদকে ডিজিটালের আওতায় আনার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। তখন শুনেছিলাম এমপিরা অধিবেশনে না থাকলেও তার নির্বাচনী এলাকা থেকে নোটিশ ও বিলে স্বাক্ষর করতে পারবেন। কিন্তু সে প্রকল্প কি হলো জানি না। ড. তোফায়েল বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা বাড়ানো উচিত।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন, শক্তিশালী ও নির্দলীয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন। এমপিরা নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচের নামে সরকারি টাকা নিচ্ছেন এ বিষয়ে সংসদের করণীয় কিছু আছে কি না জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • খাইরুল ইসলাম ১৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৩ পিএম says : 0
    অনুসন্ধানমুলক এই রিপোর্টটির জন্য সাংবাদিক ও ইনকিলাবকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অফিস নেই খরচ নিচ্ছেন ১৮৭ এমপি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ