Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যন্ত্রপাতি সঙ্কটে স্থবির বন্দর

প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম বন্দরে ১১২০ কোটি টাকায় ৬১ ধরনের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ক্রয় থমকে গেছে : ঘাটতির সুবাদে নগদ ঘুষ-বকশিশ স্পিডমানি লেনদেন
শফিউল আলম : দীর্ঘদিন ধরে ভারী যন্ত্রপাতির সঙ্কটে চট্টগ্রাম বন্দরে নিত্যদিনের কার্গো ওঠানো-নামানোর স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মংলায়ও বিরাজ করছে ইকুইপমেন্টের ঘাটতি। এতে করে দেশের উভয় সমুদ্র বন্দরে অপারেশনাল কার্যক্রমে ‘নীরব স্থবিরতা’ নেমে এসেছে। বন্দরের সার্বিক গতি ও উৎপাদনশীলতার উপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। অনেক ক্ষেত্রে বন্দর-ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই বাড়তি খরচ আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা গুণলেও পরে পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে বাস্তবে তার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের ভোক্তা সাধারণকেই। চট্টগ্রাম বন্দরে ১১শ’ ২০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ ৬১ ধরনের অত্যাধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ থমকে আছে। এ মুহূর্তে প্রধান বন্দর চট্টগ্রামে কী গ্যানট্রি ক্রেনের ঘাটতিসহ বিশেষত কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অধিকাংশ যন্ত্রপাতির সঙ্কট অত্যন্ত প্রকট। যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতিতে দুর্নীতিবাজ চক্রের এখন পোয়াবারো। কেননা যান্ত্রিক সঙ্কটকে পুঁজি করে নেপথ্যে বেড়ে গেছে নগদ ঘুষ বকশিশ স্পিডমানির কারবার।
কলের কাজ যেহেতু কলে চলে, ‘বলে’ চলে না, সেহেতু চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্রবন্দরে কন্টেইনার ও খোলা কার্গো হ্যান্ডলিং করার উপযোগী বিভিন্ন ধরনের ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের অভাবে স্বাভাবিক কাজের গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কমে গেছে উভয়বন্দরের যান্ত্রিক দক্ষতা ও সক্ষমতা। চাহিদার বিপরীতে ৪০ শতাংশ যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। এতে করে পণ্য খালাস, জাহাজীকরণ, স্টেক-মজুদ করাসহ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সময় ও অর্থের অপচয় বেড়ে গেছে। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক সরঞ্জাম ঘাটতি থাকার সুবাদে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে প্রতিনিয়ত অনিয়ম ও হয়রানির অভিযোগ করছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। যান্ত্রিক ঘাটতি, পুরনো জরাজীর্ণ যান্ত্রিক সমস্যার অজুহাতে যথেচ্ছ ঘুষ, কথিত বকশিশ ও ‘স্পিডমানি’র আদায়ের বিনিময়ে কাজ করতে হচ্ছে এমনটি অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে দৈনিক শত শত কোটি টাকা মূল্যের আমদানি-রফতানিমুখী পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, সিসিটি, জেসিবি মিলিয়ে রয়েছে ১৯টি জেটি-বার্থ। বন্দরে বছরে ২১ লাখ ৯০ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট সাইজ ইউনিট হিসাবে) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। কন্টেইনার ওঠানামায় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ১২ শতাংশ। কিন্তু ক্রমবর্ধমান পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা অনুপাতে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম খুবই কম। বর্তমানে উভয় বন্দরে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়ে গেছে। কারিগরি হিসাবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতির মধ্যে উভয় বন্দরে কাজ চালানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে এক কিলোমিটার দীর্ঘ ৫টি জেটি-বার্থ সমন্বিত সর্ববৃহৎ কন্টেইনার স্থাপনা এনসিটিতে যান্ত্রিক ঘাটতি প্রকট। পুরনো জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড, শেডগুলোতে কন্টেইনার এবং খোলা সাধারণ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী যান্ত্রিক সরঞ্জাম রয়েছে অনেক কম। বন্দরে বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের চাহিদা অনুপাতে স্থাপনাভেদে শতকরা ২০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত যোগানে ঘাটতি রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতা বন্দরের দক্ষতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এরজন্য এখনই জোরালো অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে বন্দরে পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট সংস্থান করাকে অপরিহার্য হিসেবে দেখছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।
বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতির বিষয়টি ঘুষ-দুর্নীতি এবং হয়রানির বাহনে পরিণত হয়েছে। কখনও যান্ত্রিক উপকরণের ঘাটতি, কখনও সেগুলো পুরনো, জরাজীর্ণ অবস্থায় বিকল হয়ে পড়ার অজুহাতে সুযোগ বুঝে একশ্রেণীর অপারেটর, কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ-বকশিশ এবং দ্রুত কাজ আদায়ের ‘শর্ত’ হিসেবে ‘স্পিডমানি’ উসুল করে নিচ্ছে। হরেক কায়দা কৌশলে জিম্মি করা হচ্ছে আমদানি-রফতানিকারক, কনসাইনি, ব্যবসায়ীদের। কাজের বিনিময়ে সিডিউলে নির্ধারিত চার্জের বাইরে মোটা অংকের ঘুষ-বকশিশের অবৈধ লেনদেন চলছে।
৬১ ধরনের সরঞ্জাম ক্রয় ঝুলে আছে
চট্টগ্রাম বন্দরে যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি সামাল দেয়ার জন্য ‘অবিলম্বে’ বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) বছর বছর মুনাফালব্ধ নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নে মোট ১১শ’ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১ ধরনের অত্যাধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনার আশারবাণী শোনানো হলেও তা এখনও ঝুলে আছে। গত জুলাই মাসে এ সম্পর্কিত ফাইল সচল হয়ে না এগুতেই ফের থমকে গেছে। এ প্রকল্পের মধ্যে ছিল ১০টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন ছাড়াও রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রীচ স্ট্র্যাকার, কন্টেইনার মোভার, রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন। যার সবই কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ভারী যন্ত্রপাতি। দীর্ঘ একযুগ পর বন্দরে এসব সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। সরঞ্জাম ক্রয় পদ্ধতি নিয়ে একের পর এক জটিলতার কারণেই এ নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড নাকি অন্যকোন প্রক্রিয়ায় সরঞ্জাম কেনা হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীন মূলত নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। বন্দর কর্তৃপক্ষও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না নৌমন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে। অথচ বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারাই বলছেন, যুগোপযোগী অত্যাধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংযোজিত হলে বন্দরের গতি, সক্ষমতাসহ উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ২১ লাখ ৮৯ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। এর পরিমাণ উত্তারোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবহন ব্যয় ও খরচ সাশ্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কন্টেইনার শিপিংয়ের কদর বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে গত ১২ বছরে উল্লেখযোগ্য ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহ না হওয়ায় কন্টেইনার হ্যান্ডলিং স্থবিরতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার খালাস, ওঠা-নামা, স্থানান্তর, মজুদের উপযোগী যান্ত্রিক সরঞ্জামের উল্লেখযোগ্য ঘাটতির মধ্যে রয়েছেÑ কী গ্যানট্রি ক্রেন, রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন, সার্র্বক্ষণিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কাজে অপরিহার্য (ফোর হাইটের ৪০ টনী) স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, ৭ টন থেকে ৪৫ টনী রীচ স্টেকার, ৪০-৪৫ টনী স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, ১৬ থেকে ৪২ টনী ফর্ক লিফট, ফর্ক লিফট ¯েপ্রডার, কনটেইনার মুভার, এম্পটি হ্যান্ডলার ফর্কলিফট, টার্মিনাল ট্রাক্টর, ট্রেইলর। ২-৩ টনী শ্যোর ক্রেন, ৫০ টনী মোবাইল ক্রেন, ২০ টনী মোবাইল ক্রেন, ১০ টনী মোবাইল ক্রেন, ১০ টনী লগ হ্যান্ডলার, ৫ টনী ফর্ক লিফট, ৫ টনী লো মাস্ট ফর্ক লিফট, ৩ টনী ফর্ক লিফট, ২৫ টনী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাক্টর, ২৫ টনী হেভি ট্রেইলর ও লাইট ট্রেইলর।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যন্ত্রপাতি সঙ্কটে স্থবির বন্দর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ