Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিডরের দুঃসহ স্মৃতিবহ দিন আজ

প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা
নাছিম উল আলম : সিডরের কালো রাত্রির ভয়াল দুর্যোগ আজো তাড়া করে ফিরছে গোটা উপকূলবাসীকে। ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর কালো রাত্রিতে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশের উপকূলের ১০টি জেলায় ভয়াবহ ধ্বংসলিলা চালায়। প্রলয়ঙ্করী ঐ ঝড়ে মাঠ পর্যায়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির’ স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যাপক প্রচারণাসহ প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতা যথেষ্ট সক্রিয় থাকায় প্রাণহানীর সংখ্যা আশাতীতভাবে হ্রাস পেলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যা ছিল সে সময়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রায় অর্ধেক। সরকারি হিসবে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। ঐ ঝড়ে সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭৫ এবং নিখোঁজের সংখ্যা ছিল ৮৭১ জন। নিখোঁজদের বেশিরভাগেরই পরবর্তীতে আর কোনো খোঁজ মেলেনি। সরকারি হিসেবে সিডরের ছোবলে দেশের উপকূলভাগের ১০টি জেলার ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫টি পরিবার কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপকূলের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৭০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লক্ষাধিক। প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ফসল সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টরের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিহাসের ভয়াল ঐ ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলভাগের প্রায় ৫০ লাখ গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগির মৃত্যু ঘটে।
তবে উপকূলীয় এলাকায় সেদিন সিডরের ঐ ভয়াল তা-বে ক্ষয়ক্ষতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারত যদি বিশাল সবুজ বেষ্টনী ও পারিকল্পিত বনায়ন না থাকত। প্রকৃতির ঐ তা-ব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়িয়েছিল প্রকৃতিই। তবে সিডর-এর মতো প্রকৃতির ভয়াল তা-ব সামাল দিতে সে রাত উপকূলীয় বনায়ন কর্মসূচি ও সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের লক্ষ লক্ষ গাছ ছাড়াও সাধারণ মানুষের প্রায় ১ কোটি গাছ মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। প্রকৃতির রুদ্্র রোষের সামনে বুক পেতে ছিল উপকূলীয় বনভূমি। সিডরের সে রাতে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সাথে কুড়ি ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্রায় পৌনে ৭শ’ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামোর সড়কসমূহ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া আরো প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার বিভিন্ন ধরনের সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১ হাজার ৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯শ’টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ’ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাত্র ১শ’ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও ১৫ নভেম্বর বিকেলেই আকস্মিকভাবে তার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে উল্টর-পূর্বমুখী হতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার পরেই ঝড়টি আরো দ্রুত গতিতে উল্টর-পূর্বমুখী হয়ে ভারত-বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখ-ে আছড়ে পড়ে। ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ’ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা সাগর মোহনা থেকে অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সবেগে তা-ব চালায়। এমনকি সাগর মোহনা থেকে প্রায় পৌনে দু’শ’ কিলোমিটার উত্তরে বরিশাল মহানগরীতেও সিডর-এর তীব্রতা ছিল ২২৪ কিলোমিটার।
সাগরপাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে বরিশাল হয়ে গোপালগঞ্জ-মাদারীপুর-শরিয়তপুর ও ফরিদপুরের কিছ্ ুএলাকা এবং চাঁদপুর-কুমিল্লা পর্যন্ত সিডর তার সরব উপস্থিতির জানান দেয় সে রাতে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল, বরগুনার পাথরঘাটা, আমতলী, বেতাগী, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, মির্জাগঞ্জ, সদর, পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া, ভা-ারিয়া, ঝালকাঠীর কাঁঠালিয়া, রাজাপুর, সদর হয়ে বরিশাল, মাদারীপুর ও শরিয়তপুরের বিশাল এলাকায় সিডরের তা-ব অব্যাহত ছিল। পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সাথে প্রায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদসহ ফসলী জমিকে ল-ভ- করে দেয় সিডর।
২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর কালো রাতের সিডর-এর তা-ব এখনো মনে রেখেছে দক্ষিণ উপকূলবাসী। সেদিন যদি ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’র হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক উপকূলীয় জনগণকে সতর্ক করাসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লক্ষাধিক মানুষকে উদ্ধার না করত, তবে সিডরের প্রাণহানিও ’৭০-এর ‘হেরিকেন’-এর ভয়াবহতাকে স্পর্শ করতে পারত বলে মনে করছেন উপকূলবাসী। এমনকি নিজের জীবনকে বিপন্ন করেও সিডরের রাতে বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু নানা প্রশাসনিক জটিলতায় সেই ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’র কার্যক্রমই এখন বিপর্যস্ত।
শরণখোলায় ৩ শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে
উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরু
শরণখোলা সংবাদদাতা : পাউবোর ৩৫/১ পোল্ডারের সিডর বিধ্বস্ত বাগেরহাটের শরণখোলার বেড়িবাঁধের কাজ শুরু কয়েছে। সিডরে উপজেলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় ৩ শ’ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে টেকসই ও উঁচু বেড়িবাঁধের কাজ করছে চীনের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সিডরের ৯ বছর পর উপজেলাবাসীর প্রাণের দাবি আধুনিক, টেকসই ও উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় উপজেলাবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে শরণখোলা উপজেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটে। পরবর্তীতে উপজেলাবাসীর পক্ষ থেকে আধুনিক, টেকসই ও উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণে দাবি ওঠে। পরবর্তীতে বাস্তবতা উপলদ্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শরণখোলাবাসীকে দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করতে একটি উঁচু ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের নির্দেশ দেন।
কনসালটিং ফার্ম ডেভকমের সুপাইভাইজার শফিকুল ইসলাম শামিম জানান, ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৩.২ কিলোমটিার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ সিএইচডব্লিউই নামে চাইনিজ একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ কাজ তিন বছরে বাস্তবায়ন করবে। বেড়িবাঁধটি টপে চওড়ায় ৪.৫০ মিটার এবং বর্তমানের চেয়ে স্থান ভেদে দুই থেকে আড়াই মিটার উঁচু হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিডরের দুঃসহ স্মৃতিবহ দিন আজ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ