Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রবাসীদের অর্থ-মেধা কাজে লাগাতে পারলে বদলে যেত সিলেট

প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফয়সাল আমীন ঃ বৃহত্তর সিলেটের অর্থনীতির অনিবার্য শক্তি প্রবাসীরা। তাদের অর্থে ধনবান মূলত সিলেটিরা। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অবস্থার বুনিয়াদকে সেই অর্থ-ই মজবুত করে রেখেছে। অবস্থার এ ধারাকে পরিবর্তন ঘটাতে পারলে বদলে যেতে গোটা সিলেট। আধুনিক মালেশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো রূপ যৌবনে ভরে উঠা কোন ব্যাপার ছিল না সিলেটের। সেই জন্য প্রয়োজন সরকারের কার্যকর উদ্যোগ। উন্নয়নমুখী স্বদিচ্ছা নিশ্চিত করতে পারলে সিলেট গড়ে উঠতে সেই অবয়বে। এর কর্তৃত্ব থাকত বর্তমান সরকারের। সেই জন্য প্রয়োজন প্রবাসীদের অর্থ ও মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার সংযোগ ঘটানো। এতে করে সিলেটে ঘটবে অবিশ্বাস্য উন্নয়ন। নিশ্চিত হবে দেশ ও প্রবাসীদের মধ্যে সূদুরপ্রসাীর অর্থনীতিক সর্ম্পক। আত্মীয়তার বন্ধনের পাশাপাশি যুতসই বিনিয়োগ নির্ভর সর্ম্পক সিলেটের পাশাপাশি দেশকেও আলোকিত করতে সম্ভব হবে।
বৃহত্তর সিলেটের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক প্রবাসে বসবাস করে। এ সংখ্যা বিশেষত সিলেট বেশি। কুড়ি লাখেরও বেশি প্রবাসী সিলেট অঞ্চলের। প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা দেশে প্রেরণ করেন তারা। তাদের এ অর্থের বলতে গেলে ব্যয় করেন অনুৎপাদনশীল খাতে। এছাড়া ব্যাংক টাকা জমিয়ে রাখাকে অনেকে শ্রেয় মনে করেন। সবক’টি উপজেলায় প্রবাসীদের আধিক্য। যুক্তরাজ্যে প্রবাসী ৭টি উপজেলার মধ্যে বিশ্বনাথ, জগন্নাথপুর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, সদর ও মৌলভীবাজার সদর। প্রবাসীদের অর্থে এ উপজেলার বাড়িঘর সাজানো গোছানো পরিপাটি। রাস্তাঘাট সবই উন্নত। নিকট অতীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়লের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ ব্যায়ের উপর এক গবেষণা পরিচালনা করে। সেই গবেষণায় দেখা যায়, অর্থের বেশির ভাগ অংশ ক্রয় হয়, জমিজমা কিনে, এরপর সংসার প্রতিপালন ও দালান কোটার সৌন্দর্য্যবৃদ্ধিতে। সম্প্রতি মার্কেট, ব্যাংক , আবাসন খাতে বিনিয়োগর একটি প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু এ খাতগুলো এখন মান্ধা হয়ে যাওয়ায়, বিনিয়োগের প্রতি তাদের সেই আগ্রহ নেই। ইদানিং প্রবাসীরা দেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে নেওয়ায় ঝুঁকছেন। এতে করে সিলেটের ভবিষ্যত অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। প্রবাসীরা দেশেমাতৃকার টানে ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে দেশে বিনিয়োগ করে একটি নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই ধারা এখন ক্রমশ মুখ থুবড়ে পড়ছে। প্রবাসী প্রজন্ম নানা কারণে দেশ বিমুখ। তাদের অগ্রজরা দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে তাল মেলাতে হিমশিম দেখে তারা অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত। একটা অনিশ্চয়তা তাদের ঘিরে ধরেছে। সে কারণে আত্মীয়তার মধ্যে সর্ম্পক ধরে রাখাকে বেশ মনে করছে তারা। কিন্ত অবস্থার এ গতি পরিবর্তন করতে পারে সরকার। প্রবাসীদের অর্থনীতির পাশাপাশি তাদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সংযোগ ঘটাতে পারলে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটতে পারত সিলেটে। এর মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্মেও প্রবাসীর দেশে আসার একটি স্বার্থগত পথ খুজে পেত। আত্মীতার পাশাপাশি অর্থনীতির স্বার্থগত এ সংযোগে তাদের সাথে সুদৃড় সর্ম্পকে জড়িয়ে যেত সিলেট তথা দেশ। সিলেটের ব্যাংকগুলোতে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে প্রবাসী সিলেটিদের। এ টাকা কোন উৎপাদনশীল খাতে পরিবেশ প্রতিবেশ নিশ্চিত হলে তারা বিনিয়োগ করতো। কিন্তু সেই পরিবেশ তাদের সামনে নেই। বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে একমাত্র সরকার। সেরকম কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত বাস্তবিক অর্থে প্রকাশ পায়নি। নিকট অতীতে বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের (বিইউপি) এক জরিপে দেখা যায়, প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থেও দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় অনুৎপাদশীল খাতে এবং এর অধিকাংশ ব্যয় হয় ভোগ বিলাসে। জরিপে আরো দেখা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো টাকার ৬৬.১ শতাংশ অনুৎপাদনশীল খাতে। এর মধ্যে ৫২.৪ শতাংশ আপ্যায়ন, অনুষ্ঠানাধি এবং ৯.২শতাংশ ঘরবাড়ি, ঠিক করার কাজে ব্যায় হয়। বিনিয়োড় খাতের মধ্যে দোকান ও গাড়ি ক্রয় ইত্যাদি। ১২.২শতাংশ ও অকৃষি খাতে, কৃষি জমি কোন খাতে ১৫ শতাংশ, ০.৮ শতাংশ ভ্রমণ, ৩.৪ শতাংশ ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় হয়। প্রবাসী পরিবারের যেসব সদস্য দেশে বসবাস করেন তারা বেকার থাকেন। তাদের মধ্যে উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োেগের কোন আগ্রহ নেই। তবে সামান্য একটি অংশ ব্যয় হয় ব্যবসা, পরিবহন ও অন্যান্য খাতে। এর মধ্যে কৃষি জমি ক্রয়, কৃষিকাজ, কাপড়ের দোকান, ইলেক্ট্রনিক্স দোকান, বেকারী প্রভূতি। মাত্র ২৯ শতাংশ পরিবার এসব খাতে বিনিয়োগ করছে। ৭৮ শতাংশ পরিবার কোন বিনিয়োগই করেনি। জরিপের আলোকে বিইউপি মূল্যায়ন করে বলা হয়েছিল, তথ্য নির্দেশান ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তামূলক কার্যক্রমের অভাবে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ যথাযথ ব্যবহৃত না হয়ে অনেকে উল্টাপাল্টা খাতে ব্যয় করছে। এ ক্ষেত্রে বিইউপি সুপারিশ করেছিল তা হলো বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্টদের বিনিয়োগ উৎসাহিত করা, বিনিয়োগের নির্দেশনা প্রশিক্ষণমূলক সহায়তামূলক কার্যক্রম বিস্তৃত করা, বিনিয়োগ প্রকল্পের সমর্থনে জরুরি ভৌত, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো তৈরির বিষয় চিন্থিত করা। পরবর্তীতে এ নিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে প্রবাসীরা বিভিন্ন পর্যায়ে বিনিয়োগ করেছিল। সেই অবস্থা এখন হুমকির মুখে। তারা বিনিয়োগ গুটানোর পাশাপাশি দেশের সাথে আত্মীয়তার সর্ম্পক সীমিত করার চিন্তাধারায় ব্যস্ত। একাধিক যুক্তরাজ্য প্রবাসীর সাথে আলাপকালে তারা বলেন, দেশে বিনিয়োগ করলে এর বিপরীতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নেই, সর্বক্ষেত্রে প্রবাসীদের ঠকানোর একটি প্রবণতা লক্ষণীয়। তাই বিনিয়োগ করার আগ্রহ নেই তাদের। বরং পৈতৃক বা পারিবারিকভাবে যে বিনিয়োগ রয়েছে তা গুটিয়ে নেওয়ার মনোভাব তাদের। অনেকে ভিটেমাঠি বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাজ্য বার্মিংহাম এর বাসিন্দা ফয়েজ উদ্দিন এমবিই বলেন, প্রবাসীদের অর্থের প্রতি আগ্রহ দেশের আতœীয় স্বজন কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের। সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের রেমিটেন্সের ফলাও প্রকাশ হয়। কিন্তু এই প্রবাসীদের মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন দেখা যায় না। যদি এই দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দেওয়া না হয় তাহলে দ্রুত দেশের সাথে সর্ম্পক ছেদ ঘটবে প্রবাসী তথা প্রবাসী প্রজন্মের। তাই সরকার এ নিয়ে বিশেষ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ দরকার। এতে করে, প্রবাসীদের অর্থ ও মেধার সংযোগ ঘটবে। ফলশ্রুতিতে অর্থ নির্ভর টেকসই সর্ম্পক সত্যিকার অর্থে গড়ে উঠবে। যার সূদুরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশ-বিদেশে। সিলেট প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ফয়সল আহমদ চৌধুরী বলেন, এখন প্রবাসীদের বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী দেখা যায় না। নানা পারিপাশ্বির্ককতায় তাদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ খুবই দরকার। সুজন সিলেট এর সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ফারুক মাহমুদ বলেন, সরকার সিলেটকে উন্নয়নের একটি রোড ম্যাপ নিয়ে প্রবাসীদের বিনিয়োগে নিয়ে আসতে পারলে বৈপ্লবিক একটি পরিবর্তন সূচিত হতো। সেই সাথে প্রবাসী ও দেশের মানুষের মধ্যে অর্থনীতির স্বার্থগত সর্ম্পক গড়ে উঠত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রবাসীদের অর্থ-মেধা কাজে লাগাতে পারলে বদলে যেত সিলেট
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ