Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দণ্ডের আগেই সাজাভোগ

ড্রেজার কেনা টেন্ডারে জালিয়াতি : নৌ-মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও উপেক্ষিত

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

নৌ-মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও উপেক্ষিত করে দণ্ডের আগেই সাজাভোগের সুপারিশ করেছে। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখলে যেমন দক্ষ, তেমনি জালিয়াতিতেও পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে থ্রি এঙ্গেল মেরিন নামক শিপইয়ার্ড। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ড্রেজার কেনার দুটি টেন্ডারে জালিয়াতির এ প্রমাণ নিজেই দিয়েছে এ শিপইয়ার্ডটি। দুটি লটে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার টেন্ডারে জাল চুক্তিপত্র, অভিজ্ঞতার সনদ, ব্যাংক লেনদেনের হিসাব ও জাহাজের সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র জমা দিয়েছে। ওই কাগজপত্রের মাধ্যমে এ সংস্থার ৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষাঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের চারটি ড্রেজার নির্মাণের কাজ বাগানোরও চেষ্টার কমতি ছিল না। তবে বিষয়টি ধরা পড়েছে দরপত্র মুল্যায়ন কমিটির অধিকতর যাচাইয়ে। এদিকে জালিয়াতির এ মহাযজ্ঞের ঘটনায় থ্রি এঙ্গেল মেরিনকে নয় মাসের জন্য ব্লাক লিস্ট বা অযোগ্য ঘোষণার দণ্ড আরোপের সুপারিশ করেছে বিআইডব্লিউটিএর আরেকটি কমিটি। গত ১২ এপ্রিল জমা দেওয়া ওই কমিটির প্রতিবেদনে এ দণ্ড গত বছরের ১৩ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ দণ্ড আরোপের আগেই ওই নয় মাস পার হয়ে গেছে বলে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ইনকিলাবকে ফোনে বলেন, ড্রেজার কেনার দুটি টেন্ডারে জালিয়াতির এ প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দুটি লটে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার টেন্ডারে জাল চুক্তিপত্র, অভিজ্ঞতার সনদ, ব্যাংক লেনদেনের হিসাব ও জাহাজের সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (অর্থ) গোপাল চন্দ্র সাহা ইনকিলাবকে বলেন, ৪৫০ কোটি টাকার টেন্ডারে জাল চুক্তিপত্র, অভিজ্ঞতার সনদ, ব্যাংক লেনদেনের হিসাব ও জাহাজের সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আমরা কাজ করেছি। এর বেশি কিছু বলতে চাননি।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, দুটি লটের টেন্ডারে একই ধরনের জাল কাগজপত্র দেওয়ায় এ পর্যন্ত থ্রি এঙ্গেল মেরিন শিপইয়ার্ডের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি সংস্থাটি। এ প্রতিষ্ঠানকে কোনো টেন্ডারে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকতেও বলা হয়নি। এমনকি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ১৪ ডিসেম্বর বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দেয়। সেটি এখনও কার্যকর করেনি। উল্টো কমিটি এমন সুপারিশ করেছে যে, প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করলেও একদিনের জন্যও তার কার্যকারিতা থাকছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিআইডব্লিউটিএর শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কমিটির যোগসাজোশে জালিয়াতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পের ১৩ নম্বর প্যাকেজের আওতায় লট-১ ও লট-২ এর আওতায় ২৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের দুটি করে ড্রেজার, সহায়ক জলযান ও আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের টেন্ডারে এ জালিয়াতির করে থ্রি এঙ্গেল মেরিন। প্রতিটি লটের প্রাক্কলিত মূল্য ২২৪ কোটি ৯ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত লট-২ এর জালিয়াতির ঘটনায় কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। লট-১ এ জাল কাগজপত্র জমা দেওয়ার ঘটনায় এখনও পদক্ষেপ নেয়নি বিআইডব্লিউটিএ। লট-২ এ জালিয়াতির ঘটনায় ১৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন অত্যন্ত গোপনে গত ১২ এপ্রিল বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেন কমিটির সদস্যরা।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ি টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের একটি চুক্তিকে ১৮০ কোটি টাকা বা দুটি চুক্তির প্রতিটিতে ৯০ কোটি টাকার মূল্যের ড্রেজার বা জাহাজ নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ওই ড্রেজার বা জাহাজ ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির সুপারভিশনের আওতায় নির্মাণ করতে হবে। এ শর্ত পূরণ করতে ইউনিকর্ন ফ্রেইট সার্ভিসেস নামক প্রতিষ্ঠানের ‘এমভি ইউনিকর্ন এক্সপ্রেস-১ ও ‘এমভি ইউনকর্ন এক্সপ্রেস-২’ নামক দুটি জাহাজ নির্মাণ বাবদ একটি ১৩০ কোটি ও আরেকটি ৯০ কোটি টাকার চুক্তিপত্র ও অভিজ্ঞতা সনদ জমা দেয় থ্রি এঙ্গেল মেরিন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির ওই চুক্তিপত্র ও অভিজ্ঞতা সনদ যাচাইয়ে চিঠি দেয়। জবাবে ইউনিকর্ন ফ্রেইট সার্ভিসেস ওই চুক্তিপত্র ও অভিজ্ঞতা সনদ ‘সঠিক নয়’ বলে জানায়। এছাড়া জাহাজ দুটির রিনা ও আইআরএস নামক দুটি ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে বলে থ্রি এঙ্গেল মেরিন দাবি করলেও যাচাইয়ে তা টিকেনি। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু চুক্তিটি জাল। সুতরাং তার সঙ্গে জমা দেওয়া অন্যান্য কাগজপত্র যেমন ভ্যাট প্রদানের কাগজ, ব্যাংক লেনদেন ও জাহাজের ক্লাসিফিকেশনও সঠিক নয়। এছাড়া জাহাজ দুটির আকার ও ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে সেটিও সঠিক ছিল না।

টেন্ডারে জাল কাগজপত্র দেওয়ার কথা থ্রি এঙ্গেল মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম স্বীকার করেছেন বলে কমিটির প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জাল কাগজপত্র জমা দেওয়ায় পিপিএ-২০০৬ ও পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না সে বিষয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এর জবাবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিঠিতে বলেন, টেন্ডার জমা দেওয়ার সময়ে তিনি ব্যবসায়িক কাজে অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠানের যারা টেন্ডার জমা দেওয়ার কাজে দায়িত্বে ছিল তাদের সঙ্গে ইউনিকর্ন ফ্রেইট সার্ভিসেস এর মালিকের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি হয়। ফলে ভুল চুক্তিপত্র ও অভিজ্ঞতার কিছু কাগজ দাখিল করা হয়। এটিকে তিনি ‘সরল বিশ^াসে’ ভুল বলে অখ্যায়িত করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: থ্রি এঙ্গেল

২০ এপ্রিল, ২০২২
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ