Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভালোবাসা দিবস পাপাচারের ফাঁদ

প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস খুঁজলে যা পাওয়া যায় তা খুবই ধোয়াশাপূর্ণ। যে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা বলা হয়, তিনি কি আসলেই ছিলেন, থাকলে একজন নাকি একাধিক, তার সাথে ভালোবাসা দিবসের সম্পর্ক কি, এসব বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে যে কাহিনী প্রচলিত, তাকে আমরা শুধুমাত্র কল্পকাহিনীই বলতে পারি। তারপরও যদি বলতে হয়, বলতে হবে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন পাদ্রি এবং সেই সাথে চিকিৎসক। ঐ সময়ে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস যুদ্ধের জন্য ভালো সৈন্য সংগ্রহ করতে আদেশ করেন যে, কোন যুবক-যুবতি বিয়ে করতে পারবে না। সম্রাটের এই ফরমানের বিরুদ্ধে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন প্রচারণা ও নীরবে-নিভৃতে বিবাহের মন্ত্র পড়াতেন। প্রেমের জন্য মারা যাননি ভ্যালেন্টাইন। তিনি মারা গেছেন বিয়ে করা ও রোমান দেবতা না মানার কারণে। এতে স্পষ্ট হয়, ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’কে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করার কোন যুক্তিই নেই।
ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শান্তি ও সম্মান। দুনিয়ার বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- ক্ষমা ও ভালোবাসার সুবাদেই। ভালোবাসার দ্বারা এক ব্যক্তি যদি অন্যের প্রতি আসক্ত হয় তাকে বলে বন্ধু। হজরত আলী (রা.) বলেন, যার বন্ধু নেই সে গরিব। হজরত আবুবকর (রা.) বলেন, সর্বাপেক্ষা দুর্বল ব্যক্তি সে, যার কোনো বন্ধু নেই। কিন্তু ভালোবাসার বন্ধু কে হবেন সে সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ঈমানদার ব্যতীত কাউকেও সাথী বানিয়ো না। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য রাখা উচিত সে কাকে বন্ধু করে নিচ্ছে।’ মুসলমান স্বামী-স্ত্রী ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের কারণে যে অগাধ মহব্বত, অভাবিত শান্তি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে তা ইহুদী-নাছারা তথা পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের এদেশীয় এজেন্টরা কল্পনাই করতে পারবে না।
ভালোবাসা দিবস মানুষকে নৈতিক অবক্ষয়, অশ্লীল ও অন্যায়ের দিকে ধাবিত করছে। অভিভাবকগণ সঠিকভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিলে হয়তো বা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। মানুষ যখন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে জানত না, তখন পৃথিবীতে ভালোবাসার অভাব ছিল না। আজ পৃথিবীতে ভালোবাসার বড় অভাব। আর হবেই না কেন? অপবিত্রতা, নোংরামি আর শঠতার মাঝে তো আর ভালোবাসা বলে কিছু থাকতে পারে না। দিনটিতে শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা তো সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে উঠে। নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য উজাড় করে প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় নেমে আসে। উঠতি মেয়েরা রূপান্তরিত হয়ে জৈবিক কামনা ও যৌনতার খোরাকে রূপ নেয়। অঙ্কন পটীয়সীরা উল্কি আঁকার জন্য পসরা সাজিয়ে বসে থাকে রাস্তার ধারে। তাদের সামনে তরুণীরা পিঠ, বাহু আর হস্তদ্বয় মেলে ধরে পছন্দের উল্কিটি এঁকে দেয়ার জন্য। তারপর রাতব্যাপী চলে নীরবে-নিভৃতে প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে খোশ গল্প। এ হলো বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের কর্মসূচি! একে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস না বলে বিশ্ব বেহায়াপনা দিবস বললে অন্তত নামকরণটি কিছুটা হলেও যথার্থ হবে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীর মধ্যে ভালোবাসা বিদ্যমান। ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর, কোমল মানবিক অনুভূতি। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, প্রিয় সন্তান, পরিবার, সমাজ এমনকি দেশের জন্যও ভালোবাসা। নিজের ঘরকে অরক্ষিত রেখে নারীরা বিভিন্ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত সন্তান বড় হচ্ছে নৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষাহীনভাবে। ছেলে-মেয়েদের আচরণ নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার সময়ই হয় না। এ অবস্থার ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ে আমাদের সন্তানরা একপর্যায়ে বখাটে, নেশাখোর, সর্বশেষ সন্ত্রাসী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করছে। অনেক মা-বাবাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজেদের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টে ব্যস্ত থাকেন এবং সন্তানদের আদর-ভালোবাসা ও সঙ্গ দিতে না পারায় সন্তানরাও বাবা-মার শাসন থেকে মুক্ত হয়ে একদিন অনাচারের খপ্পরে পড়বে সেটি আর বিচিত্র কী!
খ্রিস্টানদের কোনো কোনো ধর্মীয় নেতাও ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসার উৎসব দিবস হিসেবে সমর্থন করেছেন। একটি নব-উদ্ভাবনকে ধর্মীয় বেশ পরিয়ে সমাজে চালু করা যা খ্রিস্টানদের ধর্মীয় নেতাদের দ্বারাই সম্ভব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোরআনে বলেছেন : ‘তারা তাদের প-িত এবং সন্ন্যাসীদেরকে আল্লাহর পাশাপাশি তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে’ (আত তাওবাহ্)। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, কি ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। গির্জার অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না। নষ্টামি, বেহায়াপনা ও সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের স্মৃতি এবং চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ হয়। এক সময় ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ করে। এছাড়া হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময় এ দিবস নিয়ে বির্তক সৃষ্টি হয়। মালয়েশিয়ান সরকার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে একটি পাপাচারের ফাঁদ বলে আখ্যা ও মুসলমানদের অংশগ্রহণ প্রতিরোধে প্রচারাভিযান চালায়।
ইতিহাস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তথাকথিত ভালোবাসা দিবস এদেশীয় সংস্কৃতির অংশ নয়। তা সম্পূর্ণরূপেই বিজাতীয়, বিধর্মীয় তথা পশ্চিমা ইহুদী-নাছারাদের প্রবর্তিত। যার অনুসরণ মুসলমানদের জন্য হারাম ও কবীরা গুণাহ। এই দিবসের নামে মূলত চলে বেপর্দা-বেহায়াপনার নির্লজ্জ প্রদর্শনী। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।’ অর্থাৎ যারা কথিত ভালোবাসা দিবস পালন করবে তাদের হাশর-নশর ইহুদী-নাছারা তথা বিধর্মীদের সাথেই হবে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন বা জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে বাছাই করেছেন তিনি বলেন : ‘এবং যে কেউই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন-ব্যবস্থা আকাঙ্খা করবে, তা কখনোই তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না, এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন’ (আলে ইমরান)। মুসলিমরা তাদের চালচলন, রীতিনীতি এবং উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অনুসরণ করছে। টিভি, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেটের মত মিডিয়ার প্রচারে অবিশ্বাসীদের অনুসৃত সমস্ত বিজাতীয় রীতিনীতি আজ মুসলিমদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে এবং এর অনুসরণ ও অনুকরণ সহজতর হয়ে উঠেছে। কোন দিবসের কথা উঠলেই মানুষ অন্ধভাবে তা অনুকরণ করার প্রতিযোগিতায় নামে।
ইসলাম প্রতিটি দিনে প্রতিটি মুহূর্তেই ছোট-বড় সকলের প্রতি অগাধ ভালোবাসার প্রেরণা দেয়। হাদিস শরীফে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার চেতনা ও প্রেরণা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ আবার স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া যদি অন্য কাউকে সিজদা করা জায়িয হতো তবে আমি স্ত্রীদের বলতাম তারা যেনো স্বামীদের সিজদা করে।’ হাদিসে সব সময়ই স্ত্রীদের সাথে হাসিমুখে কথা বলা, স্ত্রীর দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য, স্ত্রীর কাজে সাহায্য করার জন্য, স্ত্রীকে ক্ষমা করার জন্য, স্ত্রীকে সম্মান দেয়ার জন্য বিশেষভাবে বলা হয়েছে। অপরদিকে স্বামীর খিদমত, সম্মান, কথানুযায়ী চলার জন্য স্ত্রীদেরকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, ইহুদি ও খ্রিস্টানসহ কাফিরদের সংস্কৃতির অনুসরণের পরিসমাপ্তি ঘটবে জাহান্নামের আগুনে। তাই আমাদের যুবসম্প্রদায়কে জাহান্নামের পথ থেকে ফিরিয়ে জান্নাতের প্রশান্তির দিকে আহ্বান করা সকলের দায়িত্ব। আমাদের জীবনের প্রতিদিনই হয়ে উঠুক ভালোবাসা দিবস।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী



 

Show all comments
  • MD. Mahabub ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৭:৩৬ পিএম says : 0
    Valo Lakha, Thanks
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভালোবাসা দিবস পাপাচারের ফাঁদ

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন