Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ট্রেন নিয়ে ষড়যন্ত্র!

তূর্ণাসহ ৪টি ট্রেনের বগি কমছে : ভোগান্তি বাড়বে যাত্রীদের

প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : কমলাপুর টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে এক যাত্রী। চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য তূর্ণা নিশীথার টিকিট কাটতে এসেছেন। লাইন পেরিয়ে ক্রমে কাউন্টারে পৌঁছেই তিনি হতাশ। কাউন্টার থেকে বলা হলো, ‘তূর্ণার সিট খালি নেই’। বাধ্য হয়ে তিনি পরদিনের মহানগর প্রভাতীর টিকিট কাটলেন। একটি বেসরকারি কোম্পানীর কর্মকর্তা রুহুল আমীন নামের ওই যাত্রী জানালেন, অফিসের কাজে প্রায়ই তাকে চট্টগ্রাম যেতে হয়। ট্রেনে যেতেই তিন স্বস্তিবোধ করেন। কিন্তু রাতের ট্রেনের টিকিট সহজে মেলে না। রুহুল আমীনের মতো চট্টগ্রাম যাওয়ার রাতের ট্রেনের টিকিট না পাওয়ার যাত্রীর সংখ্যা অনেক। এজন্য প্রয়োজন ছিল তূর্ণার আসন সংখ্যা তথা বগির সংখ্যা বাড়ানো। কিন্তু ঘটতে যাচ্ছে উল্টোটা। লাল-সবুজ বগির দোহাই দিয়ে দুই তূর্ণাসহ (আপ-ডাউন) চারটি ট্রেনের বগি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চার ট্রেনের বগি কমাতে রেল ভবনের অপারেশন শাখা থেকে গত মঙ্গলবার পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ২ আগস্ট ওই চারটি ট্রেনের রেক কম্পোজিশন (ইঞ্জিনসহ সব বগি মিলিয়ে একটি রেক)
পুনর্বিন্যাস করার জন্য পূর্বাঞ্চল রেলওয়েকে তাগাদা দেয়া হয় রেলভবন থেকে। দু’টি করে বগি কমালে আগের চেয়ে ১৫৮ জন যাত্রী কম পরিবহন করবে ট্রেনগুলো। আর এতে করে টিকিট সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করবে। বাড়বে যাত্রী হয়রানি। খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তারাই ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের লাভজনক ট্রেনের বগি কমানোর সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, রেলওয়ে ফ্যান ফেসবুকগুলোতে এ নিয়ে চলছে কঠোর সমালোচনা। অনেক মন্তব্যের মধ্যে সেখানকার একটি মন্তব্য হলো-‘রেলের কালো বিড়াল আর গেল না’।
তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্রতিদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছাড়ে রাত সাড়ে ১১টায়। আবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে একই ট্রেন ছাড়ে রাত ১১টায়। পরদিন সকালে ঢাকা থেকে একই ট্রেন মহানগর প্রভাতী হয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে এবং চট্টগ্রাম থেকে বিকালে মহানগর গোধূলী হয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। এভাবেই দু’টি রেক (ইঞ্জিনসহ সবগুলো বগি মিলে এক রেক) দিয়ে এক জোড়া তূর্ণা এবং মহানগর প্রভাতী ও মহানগর গোধূলী ট্রেন চালানো হয়। প্রতিটি ট্রেনে ইঞ্জিনের সাথে ১৮টি বগি যুক্ত থাকে। এতে করে ট্রেনগুলোর আসন সংখ্যা ৬৯৫টি। দু’টি বগি কমালে আসন সংখ্যা হবে ৫৩৭টি। এর মধ্যে কোটার কারণে ২৫ শতাংশ টিকিট সংরক্ষণ করা হয় ভিআইপিদের জন্য। সাধারণ যাত্রীদের জন্য থাকে মাত্র ৪শ’ টিকিট। রেলওয়ের হিসাব বলছে, তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধারণক্ষমতার ৯০ শতাংশের বেশি যাত্রী প্রায় নিয়মিতই পরিবহন করে। রাতে নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য যাত্রীদের কাছে এই ট্রেনটি জনপ্রিয়। সে কারণে টিকিট ছাড়ার শুরুর দিকে না কাটলে টিকিট প্রত্যাশীদের হতাশ হতে হয়। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে তূর্ণা এক্সপ্রেসে সিøপার ১০০ শতাংশ, এসি চেয়ার ৯৩ শতাংশ এবং শোভন চেয়ারের টিকিট ১০৭ (দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিটসহ) শতাংশ বিক্রি হয়। জুলাই মাসে সিøপার ৯৯ শতাংশ, এসি চেয়ার ৯৯ শতাংশ এবং শোভন চেয়ারের টিকিট বিক্রি হয় ১১২ শতাংশ। জুন মাসে সিøপার টিকিট ৯৫ শতাংশ, এসি চেয়ার ৮৭ শতাংশ এবং শোভন চেয়ার টিকিটের ৯৩ শতাংশ বিক্রি হয়। মে মাসে এসি সিøপারের টিকিট বিক্রি ছিল শতভাগ। এসি চেয়ার ৯৬ শতাংশ এবং শোভন চেয়ার ১০১ শতাংশ বিক্রি হয়।
সূত্র জানায়, তূর্ণা এক্সপ্রেসে ঢাকা ও চট্টগ্রামের টিকিট বিক্রি থেকে আয়ের পরিমাণও অনেক বেশি। গত সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা প্রান্ত থেকে ১ কোটি ১ লাখ ৯৮ হাজার এবং চট্টগ্রাম প্রান্ত থেকে আয় হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আগস্টে ঢাকা প্রান্ত থেকে ১ কোটি ৬ লাখ ২৮ হাজার এবং চট্টগ্রাম প্রান্ত থেকে আয় হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ ১৭ হাজার টাকা। মে মাসে আয় হয় যথাক্রমে ১ কোটি ১ লাখ ৩৪ হাজার এবং ১ কোটি ৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা। রেলওয়ের হিসাব মতে, বগি কমে গেলে শুধুমাত্র তূর্ণা এক্সপ্রেস থেকে বছরে ৫ কোটি এবং মহানগর প্রভাতী ও মহানগর গোধূলী থেকে আরও ৫ কোটি টাকা আয় কমবে। রেল কর্তৃপক্ষের জেনেশুনে এই আয় কমানোর চেষ্টাকে অনেকেই গভীর ‘যড়যন্ত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ ইন্দোনেশিয়া থেকে মিটার গেজের জন্য আমাদনিকৃত লাল-সবুজ বগিগুলো এসে গেছে। এছাড়া পুরাতন ২০টি বগি অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। যেগুলো প্রয়োজনে যেকোনো ট্রেনে ব্যবহার করা হয়।
শুরুতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেন সুবর্ণ এক্সপ্রেসে লাল-সবুজ বগি যুক্ত করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। লাল সবুজ বগি দিয়ে ‘সোনারবাংলা’ নামে নতুন ট্রেন চালু করার অজুহাতে শুরুতে বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভজনক ট্রেন সুবর্ণকে বঞ্চিত করা হয়। এরপর জামালপুরগামী তিস্তা ও সিলেটগামী পারাবতে লাল-সবুজ বগি লাগানো হলেও এখনও সুবর্ণ সেই পুরাতন সাদা বগিতেই চলছে। এমতাবস্থায় তূর্ণা, প্রভাতী ও গোধূলীতে লাল-সবুজ বগি যুক্ত করার অজুহাতে সেগুলোর লোড (বগির সংখ্যা) কমানো হচ্ছে। এ নিয়ে রেলফ্যান ফেসবুকগুলোতে চলছে সরব সমালোচনা। অনেকেই এটাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে রেলভবনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, তাদের উচিত ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে রাতে তূর্ণার পর যাতে আরও একটি ‘ননস্টপ’ ট্রেন চালু করা যায় সেই ব্যবস্থা করা। একজন রেলফ্যান ঢাকা-রাজশাহী রেলপথের উদাহরণ টেনে বলেছেন, সেখানে দুটি রেক দিয়ে তিনটি ট্রেন চালানো হচ্ছে। একই ব্যবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে করা হলে রেলওয়ের আয় ও যাত্রীসেবার মান বহুগুণ বাড়তো। ওই রেলফ্যানের মতে, তূর্ণায় বর্তমানে ২ টি এসি সিøপিং বার্থ লাগানো থাকে। রাতে যাত্রীর চাহিদা এত বেশি থাকে যে, আরো ৫টি এসি বার্থ দিলেও টিকেট পাওয়া যাবে না। তিনি বাসের সাথে ট্রেনের তুলনা করে ফেসবুকে লিখেছেন, “রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম উভয় দিক থেকে প্রায় শতের মত এসি বাস চলাচল করে। যার টিকেট-এর দাম এসি বার্থের চেয়েও বেশি। বাসে বসে আর ট্রেনে কম্বল বালিশ বিছানা নিয়ে জার্নি। রাতে আর একটি ট্রেন না দেবার উদ্দেশ্যেই এবং যাত্রীদের ট্রেনবিমুখ করতেই সম্ভবত সুবর্ণের রেক না বদলিয়ে তূর্ণার রেক লোড কমিয়ে নতুন কোচ দেয়া হচ্ছে। মানুষ দেখবে, হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নতুন ট্রেন চলছে, পুরাতন কোচ-এর পরিবর্তে লাল-সবুজ এর বিজয় কেতন উড়ছে। কিন্তু কেউ জানবে না, লসের খাত বাড়ছে কিভাবে? ইকোনোমিক রিটার্ন কমছে কিভাবে? কিভাবে ব্যাহত হচ্ছে কল্যাণ, বেড়ে যাচ্ছে কিভাবে জনগণের মাথার উপর ঋণের বোঝা।”

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ট্রেন নিয়ে ষড়যন্ত্র!
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ