Inqilab Logo

রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

হাইকোর্টে রিট-জট

সারাদেশে ৩৯ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন সরকারি দফতরগুলোর অনেকটা অবজ্ঞা : বিবাদীপক্ষের খামখেয়ালি

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম

নাগরিকের রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্টদের রুল জারি করেন। রুলের জবাব দেয়ার জন্য সময় বেধে দেয়া হয়। কিন্তু সেই সময়সীমার মধ্যে রিটের জবাব মিলেছে- এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি দফতরগুলো অনেকটা অবজ্ঞা ভরেই ফেলে রাখে হাইকোর্টের রুলের জবাব দেয়ার বিষয়টি। বিবাদীপক্ষের খামখেয়ালির কারণে নিষ্পত্তি হচ্ছে না হাজার হাজার রিটের।

সারাদেশে ৩৯ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ২ লাখের বেশি রয়েছে শুধুমাত্র রিট মামলা। সময় মতো রিটের জবাব না আসার কারণে নিষ্পত্তি হচ্ছে না এসব রিট। তবে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই মামলা জটের বিরুদ্ধে এক প্রকার জেহাদ ঘোষণা করেছেন। সে লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।

অভিজ্ঞ আইনজীবীরা জানান, নাগরিকের সংবিধানিক অধিকার প্রশ্নে রিট করা হয়। সংক্ষুব্ধ যেকোনো বাংলাদেশী সংবিধানের ১০২ এবং ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে রিট করতে পারেন। রিটে সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের বিবাদী করা হয়। কি কারণে রিটকারীর প্রত্যাশিত অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি- তা জানতে চাওয়ার জন্য আদালত বিবাদীদের বক্তব্য জানার জন্য রুল জারি করেন।

নাগরিককে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য আদালত ৫ ধরণের আদেশ দেন রিটের পরিপ্রেক্ষিতে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে দেয়া এই আদেশ ‘রিট আদেশ’ হিসেবে পরিচিত। রিট আদেশ বাস্তবায়নে হাইকোর্ট সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে নির্দেশ দেন। কতদিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে হবে কিংবা আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে সেটিরও একটি সময়সীমা বেধে দেয়া হয়। রুল জারি হয় রিট পিটিশন দায়েরের পর প্রাথমিক শুনানি শেষে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে রিটের জবাব দিতে বলা হয়। কমপক্ষে এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় বেধে দেয়া হয় রুলের জবাব দানের জন্য। এটিই রিট মামলার পদ্ধতি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জারিকৃত রুলের জবাব আসছে না।

অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের ওপর নোটিশ জারি নিশ্চিত করার পর আবেদনকারী পক্ষ আদালতের দৃষ্টিতে এনে চূড়ান্তক শুনানির জন্য আবেদন করছেন। ফলে প্রাথমিক রুলের জবাব ছাড়াই চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুলটি অ্যাবসোলিউট (চূড়ান্ত) করা হয়। সে অনুযায়ী হাইকোর্ট রায় দেন। এ ধরণের রিটের ক্ষেত্রে প্রাথমিক রুলের জবাব আসাটা কতটা জরুরি- এ প্রশ্নে বিতর্ক রয়েছে।

কিন্তু মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় এ পদ্ধতিগুলো মানতে কোনো বাধ্যবাধকতার প্রথা গড়ে ওঠেনি। এ প্রথা গড়ে উঠলে যাদের ওপর রুল জারি হয় তারা দ্রুত জবাব দিতে বাধ্য থাকতেন বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের মামলা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আধুনিকায়নের মাধ্যমে বিচারাধীন রিট-জট কমতে পারে- মর্মে অভিমত দেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না। তার মতে, একের পর এক আদালত ভবন নির্মাণ করলেই হবে না। বিচারপতি নিয়োগ দিলেই হবে না। এমন বাধ্যবাধকতা আনা উচিত, যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদনকারী নিজ উদ্যোগেই রুলের শুনানি করেন। মামলা দায়ের পদ্ধতি এবং ব্যবস্থপনাও ডিজিটালাইজড করা এখন সময়ের দাবি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিম আল ইসলাম বিচার বহির্র্ভূত হত্যা এবং ফতোয়া সংক্রান্ত রিটে রুলের জবাব না আসার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, সরকারের ওপর জারি হওয়া আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়ার যে চর্চার পথ, তা অনেকটাই দুর্গম হয়ে পড়ছে। রুলের জবাব না আসার কারণে এ সংক্রান্ত রিটের শুনানি বিলম্ব হচ্ছে। এ কারণে দীর্ঘসূত্রতার বলয় থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। মামলারও নিষ্পত্তি হচ্ছে না সময় মতো। ফলে বিচার-বহির্ভূত শাস্তি কিংবা ফতোয়ার অপব্যবহার বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রুলের জবাব সময়মতো না আসা কিংবা কিছু ক্ষেত্রে জবাব একেবারেই না আসার পেছনে যে কারণ, তা হলো, সংশ্লিষ্ট দফতরের উদাসীনতা, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, সরকারি আইনজীবীদের কর্তব্যে অবহেলা এবং আদালতের বাধ্যবাধকতার কোনো কাঠামো বা চর্চা না থাকা।

রাজউকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি রিটের ফিরিস্তি দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বাবরুল আমীন বলেন, রিটটি (নম্বর-২২০২/২০০১) ২০০১ সালের ৪ জুন দায়ের হয়েছে। ২১ বছরেও রিটটির নিষ্পত্তি হয়নি। দশ বছর কেটে গেছে রুলের জবাব আসতেই। রিটটির সর্বশেষ শুনানি হয়েছে ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর। সরকারপক্ষের সৃষ্ট জটিলতার কারণে দুই দশকেও রিটটির নিষ্পত্তি হয়নি। রুলের জবাব প্রদান বাধ্যতামূলক করা হলে হয়তো রিট নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা থেকে কিঞ্চিৎ রেহাই পাওয়া যেতো বলে মনে করেন তিনি।

চাকরি সংক্রান্ত মামলায় অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট সালাহ উদ্দিন দোলনের মতে, রুলের জবাব না আসার কারণে বিচার প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট সময় শেষ হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত রুলের জবাব দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা সংস্থাগুলোর বাধ্যবাধকতা থাকে না। এখানে সরকার ও সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়েরও এ বিষয়ে তৎপর থাকা উচিৎ।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার। তাদের পত্রযোগে কিংবা ফোনেও অবহিত করা হয়। তাগিদ দেয়া হয়। তাদেরকে নোটিশও করা হয়। কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলো থেকে কোনো সাড়া আসে না অনেকাংশেই। এছাড়া পত্রপত্রিকার খবরের মাধ্যমে দপ্তরগুলো এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। তবুও অনেক ক্ষেত্রেই তারা উদাসীনতা প্রদর্শন করেন। এর পেছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো যোগাযোগ রাখে না অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সঙ্গে। দ্বিতীয়ত, তারা সতর্ক থাকে না এবং উচ্চ আদালতের যে অনেক ক্ষমতা রয়েছে, তা উপলব্ধি করে না। তৃতীয়ত, দফতরগুলো মামলার নোটিশকে গুরুত্ব দেয় না। তবে বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক এবং সজাগ।



 

Show all comments
  • লিটন চন্দ্র সূএধর ২৩ নভেম্বর, ২০২২, ১:১৭ পিএম says : 0
    সরকার অমর সরকারের ইচ্ছা থাকলে সব সমস‍্যা সব মামলা সমাধান হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাইকোর্টের


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ