Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোজার আগেই কসাই সিন্ডিকেট

গরুর গোশত মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে

মো. জাহিদুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৬ এএম

গরুর গোশত মুসলমানদের পছন্দের খাবারের তালিকায় অন্যতম খাবার। পবিত্র রমজান মাসে এই গোশতের চাহিদা বেড়ে যায়। ইফতারের হালিম, কাবাব, তেহারি, রাতের খাবার ও সেহরির খাবারে অনেকের পছন্দের তালিকায় থাকে এই গোশত। রোজায় চাহিদা বাড়বে সে কারণে ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্যের মতো গরুর গোশতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কসাইরা। বাজারে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এবং সংশ্লিষ্টদের মনিটরিং না থাকায় রোজা শুরুর আগেই ৬০০ থেকে ৬২০ টাকার গরুর গোশতের দাম ৭০০ টাকা করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কসাইরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছেন। অথচ গরুর গোশতে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে গরুর সঙ্কট নেই এবং দামও আগের মতোই। অথচ রোজাদারদের পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলে নিতেই গোশতের দাম বাড়ানো হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ গোশত ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, গরুর গোশতের দাম নিয়ে আমাদের যাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তাদের কেউ এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছে না। প্রতি রমজান এলেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গোশতের মূল্য নির্ধারণ করত। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমরা ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় গোশত বিক্রি করেছিলাম। হঠাৎ ভারতীয় গরু পাচার করার কাজে ভারতীয়রা একেকটা গরুতে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা অবৈধভাবে আদায় করত। আস্তে আস্তে এটা এমন একটা পর্যায়ে চলে গেল, যা সীমাহীন বলা যায়। এখনও যদি সরকার গরু আমদানি শুরু করে তাহলে গরুর গোশতের কেজি ৪০০ টাকার মধ্যে রাখা যায়। কত টাকায় আমদানি হবে কিংবা কত টাকায় রফতানি হবে তার একটা মূল্য ঠিক করে দিলেই গোশতের বাজারটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।

গরুর গোশত এখন বড়লোকের খাবার। মন চাইলেও সাধ্যে কুলায় না। বাজারে যে হারে গরুর গোশতের দাম বাড়ছে, তাতে মাসে একবার খেতে পারাই দায়। কথাগুলো বলছিলেন রাজধানী কাফরুলের বাসিন্দা মোয়াজ্জেম হোসেন। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই ব্যক্তি যেন গোটা সমাজেরই প্রতিনিধি। গরুর গোশত কিনতে আসা প্রায় সবার সাথে কথা বলেই পাওয়া গেল একই রকম প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ আবার গোশতের দোকানেও আসতে ভয় পাচ্ছেন বলে জানান।

মিরপুর ১১ নম্বরের বাসিন্দা আব্দুল হান্নান। তিনি জানান, সকালে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হতে দেখে ছেলে বায়না করে বলল, বাবা গরুর গোশত খাবো। মুহূর্তেই বুকটা হতাশায় ছেয়ে গেল। কি আর করব, অন্য বাজারের তালিকা একটু কাটছাঁট করে ৭০০ টাকা খরচায় এক কেজি গরুর গোশত কিনলাম।

সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, রোজা সামনে রেখে বর্তমানে গরুর গোশত ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে কোথাও কোথাও ৭২০ টাকা কেজি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিটি গরুতেই পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা বাড়তি লাগছে। আগে চামড়া বিক্রি করা যেত পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন এক হাজার টাকায়ও বিক্রি করতে কষ্ট হয়। দোকান ভাড়া, নিজেদের খরচ বেড়েছে। গোশত বেচে চলা মুশকিল। গোশতের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বাজারে গরুর গোশতের দাম গত সপ্তাহেও ছিল ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে; বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭২০ টাকায়। এখন ক্রেতাদের মনে প্রশ্ন হঠাৎ করে গরুর গোশতের দাম বাড়ার কারণ কী? ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ। খামারিরা এখন গরু বিক্রি করতে চায় না। কারণ, তিন মাস পরেই কোরবানি। তারা খামারে লালন-পালন করা গরু বিক্রির জন্য কোরবানির বাজার ধরতে চায়। এ কারণে বাজারে গরুর সরবরাহ কমেছে। অপরদিকে দেশের অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে গো-খাদ্যের দামও বেড়েছে। শুষ্ক ঋতু বলে এখন লতাপাতা ঘাস বা খড় নেই। খামারে লালন করা গরুর জন্য দোকান থেকে কেনা খাদ্যই ভরসা। ফলে গরুর দাম বেড়েছে। আর গরুর দাম বাড়লে গোশতের দাম বাড়বেই, যা খুবই স্বাভাবিক।

চড়া দামের কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো গরুর গোশত কিনে খাওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন। ফলে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরাই এখন গরুর গোশতের মূল ক্রেতা। এক কেজি গোশত ৭০০ টাকা দিয়ে কেনার সামর্থ্য রাখে এমন মানুষ এখন হাতেগোনা। অথচ দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন। ২০২০-২১ অর্থবছরেও প্রায় চার লাখ পশু উৎপাদন বেড়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৫৪ হাজারই গরু। চাহিদার তুলনায় গোশতের উদ্বৃত্ত ১০ লাখ মেট্রিক টন। তারপরও গরুর গোশতের দাম বাড়ছে। গরুর গোশতের এই দামকে অস্বাভাবিক বলছেন খোদ গোশত ব্যবসায়ীরা। গরুর গোশতের কেজি ৭০০ টাকার ওপর হওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়।

ডিএলএস হিসাব অনুযায়ী, দেশে জনপ্রতি গোশতের চাহিদা রয়েছে দৈনিক ১২০ গ্রাম। সে হিসাবে বছরে গোশতের চাহিদা ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে গোশতের উৎপাদন ছিল ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টন। অর্থাৎ গোশতের উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন। আগের বছর উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০২১ সাল শেষে গরুর গোশতের দাম বেড়ে কেজিপ্রতি ৬০০ টাকা হয়েছে। ২০২০ সাল শেষে গড়ে যা ছিল ৫৮৮ টাকা। ২০১৯ সালে ৫৪০, ২০১৮ সালে ৫২৭ টাকা কেজি ছিল। তারা জানায়, দেশে গোশতের বাজারে বড় পরিবর্তন আসে ২০১৭ সালে। আগের বছরের তুলনায় এক লাফে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে ৫২০ টাকায় ওঠে ওই বছর। ২০১৬ সালে গড়ে ৪২০ টাকা কেজিতে গরুর গোশত পাওয়া যেত।

প্রতি বছর রোজার আগেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গরুর গোশতের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তবে গত কয়েক বছর তা করা হয়নি। এ বছর গরুর গোশতের মূল্য নির্ধারণের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে একটি মিটিং ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ। সে মিটিংয়েই দাম ঠিক হওয়ার কথা রয়েছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত দাম নির্ধারণ করা হয়নি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে। দক্ষিণ সিটির পক্ষ থেকে এপ্রিলের ৫ তারিখে মিটিং ডাকা হলেও উত্তর সিটিতে এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি না জানেন না ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা। তিনি জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোজা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ