দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পবিত্র শবে বরাত এক মহামান্বিত রজনী। যে রজনী সহস্রধিক রজনীর চেয়ে উত্তম এবং আল্লাহতালা প্রদ্ত্ত বান্দার জন্য মহান নিয়ামত। কারণ এ রজনীতে আল্লাহতালা তার বান্দাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন। ক্ষমা প্রত্যাশি বান্দার পাপ মর্জনা করেন। দয়া প্রত্যাশী বান্দার উপর রহমত বর্ষণ করেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ(দঃ) বছরের যে পাঁচটি রাতের বিশেষ গুরত্ব বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে শবে বরাত বরকতময় একটি রজনী। তিনি আরো বলেছেন,যখন শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত আসবে তখন তোমরা রাত্রি জাগ্রত থেকে আল্লাহতালার এবাদত করবে এবং পরের দিন রোজা রাখবে। কেন না এই রাতে সূর্যাস্তের পরক্ষণে আল্লাহতালা প্রথম আসমানে আগমন করেন এবং বান্দাহদের উদ্দেশ্যে বলেন,ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ আছ কি তাকে আমি ক্ষমা করে দেব। রিজিক প্রার্থনাকারী কেউ আছ কি তাকে আমি রিজিক দান করব। বিপদগ্রস্থ কেউ আছ কি তাকে আমি বিপদ থেতে মুক্তি দান করব। সুবহানাল্লাহ।
রাসুলে করিম(দঃ) বলেছেন,এই রাতে যে বা যারা খাঁটি অন্তর নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে কাটাবে মহান আল্লাহ নিঃসন্দেহে তাদের কাঙ্খিত আশা আকঙ্খা পূরণ করে দেবেন। তিনি আরো বলেন শাবান মাসের মধ্যরজনীতে দয়াময় আল্লাহতালা অনুকম্পার চোখে তাকিয়ে থাকেন।এ পবিত্র রাতে যারা আল্লাহতালার ক্ষমা প্রার্থনা করেন তারা ক্ষমা প্রাপ্তি হন। যারা মহান আল্লাহর করুনা কামনা করেন তারা করুনাধারা বারিত হন। কিন্তু যারা হৃদয়ে অনিষ্ট লালন করে তাদেরকে পূর্বের মতোই রাখেন এবং ক্ষমা করেননা। যতক্ষন না এরূপ অনিষ্ট চিন্তা থেকে তারা নিজেকে পরিচ্চন্ন্ করে। তিনি আরো বলেন নিশ্চয় আল্লাহতালা সে রাতে সকল মুসলমানকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু গনক যাদুকর পিতা মাতার অবাধ্যকারী এ ব্যভিচারী ব্যতীত। এ বরকতময় রজনীতেও আল্লাহতালা তার বান্দাদের সৎ পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য শর্তআরোপ করেছেন। অপরের হক বিনষ্ট না করার জন্য বলেছেন। পিতা মাতার সেবা করার জন্য বলেছেন। যাদু টোনা সকল প্রকার কুপুরী থেকে মুক্ত থাকার জন্য বলেছেন। এক কথায় তিনি সর্তক করেছেন,এরূপ ব্যভিচারীদের তিনি কবুল করবেননা। তবে এখানে উল্লেখ করতে হয়,আমরা অনেকে সারা বছর পাপ কাজে লিপ্ত থাকি। বিশেষ করে অপরের হক বিনষ্ট করি। খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল মিশ্রিত করি,ওজনে কম দেওয়াসহ নানা রকম ঘোষ,দুর্নীতি প্রতারনামূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকি। সুতরাং আল্লাহতালা ভাল জানেন তিনি কার ইবাদত কবুল করবেন এবং কাকে মার্জনা করবেন। হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন,আমি এক রাতে রাসুলুল্লাহ(দঃ) কে ঘরে পাইনি। অতঃপর আমি ঘর থেকে বাহির হয়ে তাঁক জান্নাতুল বাকীতে পাই। তিনি আমকে বলেন,তুমি কি ভয় কর যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল(দঃ) তোমার উপর অন্যায় করবেন। আমি বললাম,হে আল্লাহর রাসুল মূলত তা নয় আমি মনে করেছি যে আপনি আপনার কোন স্ত্রীর নিকট গিয়েছেন। অতঃপর তিনি বলেন,নিশ্চয় আল্লাহ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে কুদরতিভাবে প্রথম আসমানে আসেন আর কালব নামক গোত্রের ছাগলের সমুদয় পশমের চেয়েও বেশি সংখ্যক ব্যক্তিদের ক্ষমা করে দেন। হযরত মা আয়শা(রাঃ) আরো বলেন,রাসুলুল্লাহ(দঃ) এ রাতে নামাজ পড়ছিলেন এবং সিজদায় দীর্ঘ অবস্থানের কারনে আমি মনে করলাম যে তিনি ওফাত লাভ করেছেন। তাঁর অবস্থা জানার জন্য আমি তাঁকে নাড়া দিলে তিনি নড়ে উঠেন এবং আমি তাঁকে সিজদায় বলতে শুনেছি হে আল্লাহ আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে আপনার শাস্তি থেকে পানাহ চাই। আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আপনার রাগ থেকে আশ্রয় চাই। আর আপনার যথাযথ প্রশংসা আমি করতে পারবনা। এজন্য আমি আপনার সে প্রশংসা করছি যা আপনি আপনার জন্য করেছেন। এরপর সিজদা থেকে মাথা উত্তোলন করলেন। অতঃপর নামাজ শেষ করে আমাকে বললেন,হে আয়শা আল্লাহর রাসুল কি তোমার সাথে কোন ধরনের খেয়ানত করেছেন আমি বললাম আল্লাহর শফথ করে বলছি এ ধরনের কোন কিছু নয় বরং সিজদায় আপনাকে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারনে আমি মনে করেছি যে আপনি ওফাত লাভ করেছেন। এ কথা শুনে তিনি বললেন তুমি কি জান না এটি বরাতের রাত। আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল ভাল জানেন। এরপর তিনি বললেন আজ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। এ রাতে মহান রাব্বুল আলামীন ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন। রহমত প্রার্থনাকারীদের রহমত প্রদান করেন এবং বিদ্বেষীদের অবকাশ দেন তওবা করার মাধ্যমে। হযরত মা আয়শা (রা,) বর্ণনা করেন,এক রজনীতে প্রিয় নবী(দঃ) চুপিসারে আমার চাঁদরের নিচ হতে বের হয়ে গেলেন,আমার ধারণা হল তিনি অন্য বিবির ঘরে তশরীফ নিলেন কিনা। হুজরা শরীফে খোঁজ করতেই আমার হাত নবী পাকের কদম শরীফ ছুঁয়ে গেল। আমি দেখলাম প্রিয় নবী সেজদায়রত আছেন এবং সেজদায় হামদ ছানা এবং উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য দোয়া করছেন। মা আয়শা(রা.) বলেন,কখনো দাঁড়িয়ে আবার কখনো বসে ইবাদতের এ ধারা সকাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখলেন। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইবাদতের কারনে পা মুবারক ফুলে গেছে। চরন শরীফের খেদতম করতে আরজ করলাম এয়া রাসুলুল্লাহ(দঃ) আমার মা আমার বাবা আপনার কদমে কুরবান হয়ে যাক নবুয়ত প্রকাশের আগে বা পরে আল্লাহতালা আপনাকে পুত পবিত্র রেখেছেন। পাশাপাশি আপনার প্রতি অসীম মেহেরবানী ও দোয়া করেছেন। তারপরও আপনি এমনভাবে কান্নাকাটি করছেন কেন? নবী করিম(দঃ) বললেন আমি কি শোকর গোজর বান্দা হবনা। আয়শা তুমি কি জান আজ এটি কোন রাত? মা আয়শা (রা.)বললেন,আল্লাহ এবং তাঁর প্রিয় হাবীব ভাল জানেন। নবী করিম(দঃ) বললেন, এ রাতে আগামী এক বছরে জন্ম গ্রহণকারী সকল শিশুর নাম এবং মৃত্যু বরণকারী সকল মানুষের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। এ রাতে আল্লাহ সকল সৃষ্টি জীবের জন্য রিযিকবণ্টন করেন। মা আয়শা(রা.)আরজ করলেন,এমন কেউ কি আছেন যিনি আল্লাহর রহমত ছাড়া বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারবেন? নবী পাক(দঃ) বললেন,এমন কেউ নেই যিনি আল্লাহর একান্ত রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন এমন কি আমি নিজেও। তবে আল্লাহপাক আমাকে সব সময় আপন রহমতের চাঁদরে ডুবিয়ে রেখেছেন। এরপর নবী পাক(দঃ) আপন দস্ত চেহেরা মোবারক এ ছেরে পাক বুলিয়ে নিলেন।
হযরত আয়শা(রা.)বলেন,রাসুল(দঃ) অন্যান্য মাসের তুলনায় মাহে শাবানে বেশী রোজা রাখতেন। মনে হত যেন তিনি পুরো শাবান মাসই রোজা রেখেছেন।
হযরত আনাস হতে বর্ণিত যখন রজব মাস প্রবেশ করে আল্লাহর নবী(দঃ) দুহাত তুলে দিয়ে দোয়া করে বলেন,হে আল্লাহ রজব আর শাবান মাসে আমাদেরকে বরতকত দান করে রমজান পর্যন্ত আমাদের জীবিত রাখুন। আমাদেরকে রমজানের ফজিলত অর্জন করার তৌফিক দান করুন।
হযরত আবু হুরাাইয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুলে করিম(দঃ) বলেছেন,শাবানের পনেরতম রজনীর এক চতুর্থাংশ যখন অতিবাহিত হয় তখন হযরত জিব্রাইল (আ.) এসে আমাকে বললেন,আপনি আপনার শির পাক উত্তোলন করুন। আমি আমার শির উত্তোলন করে জ্জান্নাতের আটটি দরজা উন্মুক্ত দেখতে পেলাম। প্রথম দরজার সামনে একজন ফেরেস্তা আহবান করছেন,খোশখবর ঐ ব্যক্ত্যির জন্য যিনি আজ রাতে রুকু আদায় করেছেন। দ্বিতীয় দরজায় দাড়িঁয়ে এক ফেরেস্তা আহবান করছেন,খোশখবরী ঐ ব্যক্তির জন্য যিনি আজ রাতে সেজদা আদায় করেছেন। তৃতীয় দরজায় দাঁড়িয়ে এক ফেরেস্তা আহবান করছেন,খোশখবরী আজ রাত ঐ ব্যক্তির জন্য যিনি দোয়া করেছেন। চতুর্থ দরজায় দাঁড়িয়ে এক ফেরেস্তা বলছেন,খোশখবরী ঐ ব্যক্তির জন্য যিনি আজ রাতে যিকির ও ইবাদতে মশগুল রয়েছেন। পঞ্চম দরজায় দাঁড়িয়ে এক ফেরেস্তা আহবান করেছেন,আজ রাতে সুখবর ঐ ব্যক্তির জন্য যিনি ভয়ে ক্রন্দনরত আছেন। ষষ্ঠ দরজায় দাঁড়িয়ে এক ফেরেস্তা আহবান করছেন,সুখবর ঐ ব্যক্তির জন্য যিনি মুসলমান এবং ঈমানদার। সপ্তম দরজায় দাঁড়িয়ে এক ফেরেস্তা আহবান করছেন,আজ রাতে যিনি দোয়া করবেন তার দোয়া কবুল হবে এবং হাজতমন্দের হাজত পুরা করা হবে। অষ্টম দরজায় দাঁড়িয়ে এক ফেরেস্তা আহবান করে যাচ্ছেন আজ রাতে মাফি চাওয়া সকল লোকের গুনাহ মাফ করা হবে। প্রিয় রাসুলে করিম(দঃ) বললেন, ওহে জিব্রাইল এই দরজাগুলো কতক্ষন খোলা থাকবে?জিব্রাইল বললেন,ফজর উদিত না হওয়া পর্যন্ত। রাসুলে করিম(দঃ)বলেন,শাবান আমার মাস আর রমজান আল্লাহর মাস।
উপরের উল্লেখিত হাদীস শরীফগুলো থেকে বুঝা যায় পবিত্র শবে বরাত কতটুকু গুরত্বপূর্ণূ ও বান্দার জন্য আল্লাহতালা প্রদত্ত কতবড় নেয়ামতপূর্ণ রজনী। আল্লাহর রাসুল এ রাতে ইবাদত বন্দেগী ও আল্লাহতালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং জান্নাতুল বাকীতে জিয়ারতের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন এ রজনী কিভাবে কাটাতে হবে। এ রাতে একগ্রচিত্তে এবাদত বন্দেগীর মাধ্যেমে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি নিশ্চয় ক্ষমা করবেন। এবং পুরস্কৃত করবেন। এ রাতে আল্লাহতালা অসংখ্য মাুষের গুণাহ মাপ করবেন। জাহান্নামে আজাব থেকে মুক্তি দিবেন। রোগ শোক বিপদ মুক্তি থেকে দিবেন। ব্যবসা বাণিজ্য জীবন উন্নয়নে ত্বরক্কী দান করবেন। দীর্ঘ হায়াতে জিন্দেগী দান করবেন।এক কথায় এ রাতে আল্লাহতালা তাঁর বান্দাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করবেন। আল্লাহ আমাদেও সকলকে আল্লাহ এবং তাঁর হাবীবের নির্দেশিত পথে চলার তৌপিক দান করুক এবং পবিত্র শবে বরাতের রজনীতে পুরস্কৃত হওয়ার উপযুক্ততা দান করুক আমীন।
লেখক : সাংবাদিক ও সদস্য নাজিরহাট পৌরসভা,ফটিকছড়ি,চট্টগ্রাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।