পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
নূরুল ইসলাম : ২০১৫ সালের ২৬ জুন। যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালী বউবাজার এলাকার এক মেস থেকে রিপন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কয়েকদিন আগের হওয়ায় লাশটি পচে ফুলে উঠেছিল।
শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না থাকায় মৃত্যুর কারণও ছিল অজানা। তালাবদ্ধ ঘর থেকে লাশটি উদ্ধার হওয়ায় সবার ধারণা ছিল, আত্মহত্যা করেছে অথবা প্রচ- গরমে স্ট্রোকে মারা গেছে। ময়না তদন্তের পর রিপনের লাশ তার মা ও বোনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই সাথে লাশের ভিসেরা রিপোর্ট পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে। এ ঘটনায় পুলিশ একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে। রিপনের মা ও বোন পুলিশকে জানিয়ে দেয়, এ মৃত্যুর ঘটনায় তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।
কয়েকদিন পর ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসে পুলিশের হাতে। সেখানে বলা হয়, লাশের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না থাকায় ভিসেরা রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। সময় গড়িয়ে যায়। এক বছর পর ভিসেরা রিপোর্ট আসে পুলিশের হাতে। তাতে লেখা, ‘এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। রিপনকে গলাটিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।’ রিপোর্ট দেখে পুলিশ নড়েচড়ে বসে। রিপনের বোনকে ডেকে রিপনের মৃত্যুর কারণ জানিয়ে দেয়া হয়। তিনি বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৪জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। চলতি বছরের ২৬ জুন মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এসআই বিলাল আল-আজাদকে। তিনি সেই বাড়িতে গিয়ে দেখেন এক বছরে সেখানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বহু ভাড়াটিয়া পরিবর্তন হয়েছে। একমাত্র বাড়িওয়ালাই রিপনকেই চিনতেন। বাড়িওয়ালা পুলিশকে জানায়, রিপন ওই বাড়ির তিনটি রুম ভাড়া নিয়ে সাবলেট দিতো। রিপন নিজে থাকতো এক রুমে।
মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর শুরু হয় রিপনের রুমমেটদের খোঁজা। এক বছর আগে যারা ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতো তাদের কেউ আর এই এলাকায় নেই। আবার তাদের সম্পর্কে প্রতিবেশিরাও কিছু জানে না। অনেক খোঁজাখুজির পর তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পারেন, মোরসালিন নামে রিপনের এক রুমমেট পাশের এক গ্যারেজে কাজ করতো। গ্যারেজের মালিক জানায়, মোরসালিনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের হোসনাবাদে। বাবার নাম আলম। তদন্তকারী কর্মকর্তা ছুটে যান বরিশালের হোসনাবাদে। যেহেতু তিনি মোরসালিনকে চেনেন না সেহেতু ধরা পড়লে সে নিজের নাম গোপন করতে পারে- সে জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা ছদ্মবেশ ধারণ করেন। তিন হাজার টাকার জুতা ও স্যান্ডেল কিনে ‘ফেরিওয়ালা’ সেজে হোসনাবাদ গ্রামে যান এসআই বিলাল আল-আজাদ। তার পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি। পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল। কাঁধে পুরনো জুতাভর্তি ব্যাগ। গ্রামের পথে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাঁক ছাড়েন, ‘জুতা-স্যান্ডেল নিবেন গো, জুতা’। এভাবে ফেরিওয়ালা সেজে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে আলমকে খুঁজতে থাকেন তিনি। ভোটার তালিকা সংগ্রহ করে তদন্ত কর্মকর্তা ওই গ্রামের ৬টি নাম পান যাদের নামের সাথে ‘আলম’ আছে। কিন্তু কোন আলমের ছেলের নাম মোরসালিন তা জানা কষ্টকর হয়ে যায়। এভাবে তিনদিন জুতা বিক্রি করার মাধ্যমে গ্রামের সবগুলো বাড়ি ঘোরা হয়ে যায়। একই বাড়িতে দুইবার গেলে কারো সন্দেহ হতে পারে সেজন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা জুতার পরিবর্তে প্লাস্টিকের জগ, বলসহ বিভিন্ন খেলনা আইটেম নিয়ে আবার যান সেই গ্রামে। যাদের নামের সাথে ‘আলম’ আছে তাদের বাড়িতে গিয়ে খেলনা বিক্রির ছলে জানার চেষ্টা করেন তাদের ছেলে- মেয়ের পরিচয়। এক আলমের একটাই মেয়ে বয়সে ছোট, আরেক আলমের সন্ধান পান যার ছেলে প্রফেসর। এভাবেই আসল ‘আলম’ এর সন্ধান মেলে। যার পুরো নাম খায়রুল আলম, পেশায় রাজামস্ত্রী। কিন্তু তার বাড়িতে তালা। প্রতিবেশিরা জানায়, ছেলে মোরসালিনকে নিয়ে তিনি ঢাকায় কাজ করেন। এখানে তারা থাকেও না, আসেও না। এবার মোবাইল নম্বর জানার চেষ্টা। প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পারলেন, একবছর আগে থেকে মোরসালিন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। এখন শুধু তার বাবা মোবাইল ব্যবহার করেন। অনেক চেষ্টার পর মোরসালিনের বাবার মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। সেই নম্বর নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকায় চলে আসেন।
মোরসালিনের বাবার মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করে পুলিশ জানতে পারে, সে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার হলদিয়া বাজারে আছে। চলতি বছরের ২৬ জুন তদন্ত কর্মকর্তা যান সেই হলদিয়া গ্রামে। সেখান থেকে মুরসালিন সন্দেহে এক যুবককে আটক করেন। কিন্তু তার বাবার নামের শেষে কোনো আলম নেই। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক জানায়, অন্য এক মোরসালিন ওই গ্রামেরই পূর্ব পাড়ায় এক বাড়িতে কাজ করে। রাত তখন সাড়ে ৩টা। লৌহজং থানা পুলিশকে সাথে নিয়ে এসআই বিলাল পৌঁছে যান পূর্বপাড়ার সেই বাড়িতে। বাড়িটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের। চারদিকে উঁচু প্রাচীর। গেটে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম লাগানো। বাড়ির মালিকের দুটো লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বলেও স্থানীয় সূত্রে পুলিশ জানতে পারে। এমতাবস্থায় ওই বাড়ির কলিং বেল টিপে ভেতরে ঢুকতে গেলে আসামি পালিয়ে যেতে পারে। তাই দেরি না করে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশ। এ সময় পুলিশ দেখতে পায়, মোরসালিন বাড়ির ভেতরের একটি কক্ষে প্লাস্টারের কাজ করছে। জরুরি বলে রাত জেগেই কাজ করছিল সে।
মোরসালিনকে গ্রেফতার করে আনা হয় যাত্রাবাড়ী থানায়। আদালতের নির্দেশে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, রিপনের সাথে একরুমেই থাকতো সে। এক বন্ধু আসায় রিপন মোরসালিনকে নতুন বাসায় উঠতে বলে। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে রিপন মোরসালিনকে মারধর করে। মোরসালিনও রিপনকে পাল্টা আঘাত করে। মারামারির এক পর্যায়ে রিপনের গলা টিপে ধরলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রিপনের মৃত্যু হয়েছে জেনে মোরসালিন বাহির থেকে মিখল দিয়ে ঘরটি তালাবদ্ধ করে রেখে পালিয়ে যায়। কোনোভাবে যাতে ধরা না পড়ে সেজন্য এক বছর আগে থেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেয় সে। বাড়িতেও যায়নি এক বছরে।
নৃশংস খুনের এই ঘটনা আগে গুরুত্ব না পেলেও খুনি গ্রেফতার হওয়ার পর এটি আলোচিত হয়ে ওঠে। শুরু থেকেই এই খুনের ঘটনার কোনো সাক্ষী ছিল না, ছিল না কোনো ক্লু। এক বছর পর খুন বলে ভিসেরা রিপোর্ট আসার পর তদন্ত করে খুনের রহস্য বের করা কঠিন ছিল। এ প্রসঙ্গে এসআই বিলাল আল-আজাদ বলেন, রিপন হত্যাকা-ের রহস্য বের করা আমার জন্য ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। সে কারণে আমি সর্বোচ্চটা দিয়েছি আসামিকে গ্রেফতারের জন্য, যদিও সেটা খুব কঠিন ছিল। তিনি বলেন, কাজ করার সময় অনেক বাধা প্রতিকূলতার সম্মুখিন হয়েছি, কিন্তু পিছিয়ে যাইনি। শুধু একটাই মনের মধ্যে লালন করেছি, আমাকে পারতেই হবে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিছুর রহমান বলেন, রিপন হত্যা মামলাটি একটি ক্লু-লেস মামলা। তারপরও তদন্ত কর্মকর্তা তার বুদ্ধিদীপ্ত তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকা-ের মূল রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি জানান, মাস দুয়েক আগে আদালতে এ মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।