Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিপন্ন দক্ষিণাঞ্চলের নদ নদী

তীব্র ভাঙন-নাব্যতা সঙ্কট বাড়ছে লবণাক্ততা ফারাক্কাসহ অন্যান্য নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিয়ে ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে এদেশের নদ-নদী মৃত্যুর মুখে প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি ন

নাছিম উল আলম : | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২২, ১২:০১ এএম

ভারতের ফারক্কা বাঁধ এবং অন্যান্য নদীর উৎসমুখে বাঁধ, স্পার, রেগুলেটর নির্মাণ করে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এদেশের নদীগুলো মৃত্যুর মুখে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অনাবৃষ্টির ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ছোট বড় ১৩২টি নদ-নদী এখন নাব্যতা সঙ্কটে। নদ-নদীতে পানি কম থাকায় বাড়ছে লবনাক্ততা। শুষ্ক মৌসুমে উজানের প্রবাহ কমে যাওয়ায় সাগরের লবানাক্ত পানি উজানে উঠে আসছে। গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। বরিশালের কির্তনখোলা নদীতে ২০০৬ সালে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০-৬৩০ পার্সেন্ট পার মিলিয়ন-পিপিএম। সেটা এখন প্রায় ৯শ পিপিএম-এর কাছে। সাগরের লবণাক্ত পানি বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উজানে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা পর্যন্ত পৌছে গেছে।
নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদ-নদী বর্ষায় ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে নি:স্ব হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। ভাঙন রোধে যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে অনেক নদী আজ এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠছে।
ভারতের সাথে অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানি উত্তরবঙ্গ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। এর ৭৮ ভাগই বহন করছে দক্ষিণাঞ্চলের ছোট বড় ১৩২টি নদ-নদী। অথচ ভারত বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহর করে নেওয়ায় এসব নদীতে প্রবাহ কমে গেছে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের প্রায় ৫শ কিলোমিটারে নাব্যতা সঙ্কট ভয়াবহ। নাব্যতা সঙ্কটে বিপুল মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও ক্রমশ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে।
নদী বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেশ করে। আর উজানের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যেতে দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা, তেতুলিয়া, বলেশ^র ও বিষখালী সহ বিভিন্ন নদ-নদী যেমনি বর্ষা মৌসুমে দু কুল ছপিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি নদী ভাঙনও তীব্র আকার ধারন করে। এতে সর্বশান্ত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু একই নদীতে শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ হ্রাসে নাব্যতা সংকট নৌ যোগাযোগ সহ মৎস্য ও কৃষি ব্যাবস্থাকে বিপন্ন করছে। দক্ষিণাঞ্চলে লবনাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। হাজার হাজার একর জমিতে এখন আর কোন ফসল হচ্ছে না। এতে অনেক কৃষক নি:স্ব হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট জলবায়ু ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারা´ক হুমকির মুখে। নদীতে নাব্য সঙ্কটে নৌ-যোগাযোগ ও ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে নদী নির্ভর যে অর্থনীতি তা ধীরে ধীরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। এ ব্যাপারে এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে পুরো দক্ষিণাঞ্চল লবনাক্ত হয়ে বিরান ভ’মিতে পরিণত হতে পারে।
নাব্যতা সঙ্কটের ফলে এ অঞ্চলের নৌ-পথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। দক্ষিণাঞ্চলের নদÑনদীর ওপরই দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দরসহ সারা দেশের সাথে নৌ যোগাযোগ নির্ভরশীল। মেঘনা সহ মাঝারি ও বড় নদ-নদী গুলোতে নাব্যতা সঙ্কটে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা সহ উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ যোগাযোগ ক্রমশ ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। ভোলার ইলিশা থেকে ল²ীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রশস্ত ভাটি মেঘনায়ও ডুবো চরে ফেরিসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে।
নদ-নদী পরিবশে, প্রতিবেশ এবং কৃষি ব্যবস্থা সহ দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি হলেও তার সংরক্ষন ও উন্নয়নের অভাব প্রকট। নদী ভাঙন দক্ষিণাঞ্চলে একটি মানবিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হলেও তার টেকসই ও দ্রæত প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন এখনো অনুপস্থিত। এখনো কোন এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হলে তা প্রতিরোধে প্রকল্প প্রনয়ন থেকে বাস্তবায়ন শুরু করতেই ৫-৭ বছর চলে যাচ্ছে। আর প্রকল্প অনুমোদনের পরে বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতেও লেগে যায় আরো কমপক্ষে ৩ থেকে পাঁচ বছর। ততদিনে ঐ এলাকার পুরো মানচিত্রই পাল্টে যাচ্ছে।
নদী ভাঙন প্রতিরোধে গত দুই দশকে দক্ষিণাঞ্চলে কিছু প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। বর্তমানে ঝালকাঠী বাদে দক্ষিণাঞ্চলের অপর ৫টি জেলায় ৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা ব্যায়ে ১৩টি নদী ভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তবে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রকল্পের অনুমোদন সহ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তড়ান্বিত না করলে দেশের মানচিত্র থেকে দক্ষিনাঞ্চলের বিশাল জনপদ বিলীন হয়ে যাবে।
একদিকে ভাঙন অপরদিকে নাব্যতা সংকটে নদÑনদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর। অথচ নৌপথে পন্য ও যাত্রী পরিবহন ব্যায় অন্য যেকোন ক্ষেত্রের তুলনায় সাশ্রয়ী ও নিরাপদ।
সেন্টার ফর এনভায়রমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস-সিইজিআইএস’ দক্ষিনাঞ্চলের ৩১টি নৌপথের ১ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার এলাকায় সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষায় ৩১টি নৌপথের মধ্যে ৪৭০ কিলোমিটারে ৪২ মিলিয়ন ঘন মিটার পলি অপসারনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন কোন উদ্যোগ আজ নেওয়া হয়নি। এরপরে দু বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও বিষয়টি নিয়ে বিআইডবিøউটিএ এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় কোন ‘উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাব,ডিপিপি’ পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। তবে সিইজিআইএস-এর প্রস্তাবনার আলোকে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গত সপ্তাহেই তাদের খসড়া ডিপিপি দাখিল করেছে বলে বিআইডবিøউটিএ সূত্রে জানা গেছে। খসড়া প্রতিবেদনটিতে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ, লঞ্চ ঘাটসমুহের উন্নয়নে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুষ্ক মৌসুমে উজানে প্রবাহ হ্রাস এবং কয়েক বছর কম বৃষ্টিপাতের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে লবনাক্ততার মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রের মতে ২০০৬ সালে বরিশালের কির্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০-৬৩০ পার্সেন্ট পার মিলিয়ন-পিপিএম। সেখানে ২০১৭ সালের তা ৯১০ পিপিএম-এ পৌছে। ২০২০-এ লবনাক্ততার মাত্রা প্রায় ৯শ পিপিএম-এর কাছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দক্ষিণাঞ্চলের নদ নদী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ