Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নাসিরনগরের ঘটনায় ৪ মামলা এলাকায় গ্রেফতার আতঙ্ক

প্রকাশের সময় : ৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সংবাদদাতা : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাটি অঞ্চলের উপজেলা নাসিরনগর। পবিত্র কাবা শরিফ নিয়ে রসরাজ দাসের নিজস্ব ফেসবুক ব্যবহার করে ছবি পোস্ট করে। এ নিয়ে গত সপ্তাহে টালমাটাল হয়ে ওঠে নাসিরনগর। এ ঘটনায় সমাবেশের পর কতিপয় ব্যক্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ভাংচুর করে। ভাংচুর হয় বেশ কয়েকটি মন্দির। আড়াই হাজার অজ্ঞাত লোককে আসামি করে পৃথক দু’টি মামলা হয়। এরমধ্যেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হিন্দুদের পাঁচটি ঘরে রহস্যজনক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নাসিরনগরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৭৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। এ নিয়ে গ্রামের ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের কয়েকজন ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছেন। কেউ সড়কের ঠিকাদারের উন্নয়নকর্মী। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ছবি দেখে দেখে সনাক্ত করেই গ্রেফতার চলছে। সন্ধ্যার পর থেকে নাসিরনগরের সদরে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত পাঁচ শতাধিক কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রামের মানুষজন বলছে, সন্ধ্যার পর আতঙ্ক সৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। নাসিরনগর বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী স্বাধীন মিয়া বলেন, বহু বছর ধরে ব্যবসা করছি। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। এবারের ঘটনায় দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে চিড় ধরেছে। আর পাশাপাশি আতঙ্ক তো আছেই। যেভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কি যে হয় বলতে পারছি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, এখানে তেমন কিছুই হয়নি। নিরাপরাধ লোকদেরও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ ষড়যন্ত্র করে যারা আগুন দিয়েছে তারা তো গ্রেফতার হচ্ছে না। হাজার হাজার অজ্ঞাত লোককে আসামি করায় গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিভিন্ন গ্রামগুলোতে অজানা গ্রেফতার আতঙ্ক দেখা দেয়ায় অনেকে অন্যত্র রাত যাপন করছেন।
নাসিরনগরে সৃষ্ট ঘটনায় আরো দুইটি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে চারটি মামলা ও একটি জিডি হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে অন্তত ২৭’শ ব্যক্তিকে। ইতোমধ্যে পুলিশ ৭৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। রোববার রাতে সর্বশেষ ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের সোমবার কড়া নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত তাদের জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
ইসলাম হামলা-ভাংচুর সমর্থন করে নাÑ শীর্ষ আলেম সমাজ
সোমবার এদারায়ে তালিমিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা মাওলানা আশেকে এলাহি ইব্রাহীমির নেতত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শীর্ষ আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল নাসিরনগরে সম্প্রতি সৃষ্ট ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। সকাল ১১টায় দলটি উপজেলার গৌরবাড়ি মন্দির, দত্তবাড়ি মন্দিরসহ ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাসহ বাড়িঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় উলামা প্রতিনিধি দলেন নেতা মাওলানা সাজেদুর রহমান বলেন, এ ন্যক্কারজনক ঘটনায় আলেম সমাজ অত্যন্ত মর্মাহত। ইসলাম কখনো হামলা-ভাংচুর সমর্থন করেনা। ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের সনাক্ত করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। সেই সাথে নিরীহ লোকজন যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শীর্ষ আলেমগণ পবিত্র কাবা শরিফের অবমাননাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেনÑ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা মুফতি মুবারক উল্লাহ, জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা সাজিদুর রহমান, মুফতি আব্দুর রহিম কাসেমী, মাও. নোমান হাবিবী, মাও. বোরহান উদ্দিন কাসেমী, মুফতি এনামুল হাসান, নাসিরনগরের কওমি উলামা পরিষদের সভাপতি মাও. সামছুদ্দিন, মাও. আব্দুস সাত্তার, মাও. ইকবাল, মাও. আব্দুল মোমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে টিন ও নগদ অর্থ বিতরণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনায় ক্ষতিগস্ত পরিবারের মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টিন ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। সকালে উপজেলা চত্বরে আয়োজিত বিতরণ অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মো: রেজওয়ানুর রহমান, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো: আবুল কাশেম, উপজেলা চেয়ারম্যান এ টি এম মনিরুজ্জামানসহ জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গত সপ্তাহে নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫১টি পরিবারের মধ্যে নগদ অর্থ ও টিন বিতরণ করা হয়। নাসিরনগর সদর উপজেলার কাশিপাড়ার ১২টি পরিবারকে তিন বান্ডিল করে টিন, নগদ নয় হাজার টাকা, হরিপুর ইউনিয়নের ১৬টি পরিবারকে দুই বান্ডিল করে টিন ও নগদ ছয় হাজার টাকা এবং সদরের আরো ২৩টি পরিবারকে দুই বান্ডিল করে টিন ও নগদ ছয় হাজার করে টাকা প্রদান করা হয়। জেলা প্রশাসক মো: রেজওয়ানুর রহমান বলেন, আমরা সবসময় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছি। নাসিরনগরের পরিবেশ আগের মতো শান্ত হয়ে এসেছে। আশা করছি, সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে সম্প্রীতি ছিল সেটি আবারো ফিরে আসবে।
সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম
নাসিরনগরের ঘটনা সুপরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেছে সেক্টর কমান্ডার ফোরাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক তা-ব পরিদশন শেষে সোমবার বিকেলে নাসিরনগর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান। এ সময় ফোরাম নেতারা বলেন, আমরা মনে করি, যারা যদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায় এই হামলায় তাদের ইন্দন রয়েছে। এর আগে রামু এবং উখিয়াতেও একই ঘটনা ঘটেছে। এখানে যে সহিংসতা হয়েছে তা সুপরিকল্পিত। দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে একটি চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম, মহাসচিব হারুন হাবিব, সাং¯ৃ‹তিক ব্যক্তি ম. হামিদ বক্তব্য রাখেন। ১৫ সদস্যের ওই দলে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক আলহাজ মোমারফ হোসেন, দফতর সম্পাদক মেজর (অব.) শেখ দলিল উদ্দিন আহামেদ, প্রচার সম্পাদক তুষার আমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়কমন্ত্রী
মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বাঞ্চারামপুরের সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম সোমবার হেলিকপ্টারযোগে নাসিরনগর উপজেলার আশুতোষ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে অবতরণ করেন। পরে তিনি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘর ও মন্দির পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলে তাদের শান্তনা দেন ও প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন। পরে তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আলহাজ এডভোকেট সায়েদুল হকের সাথে স্থানীয় ডাকবাংলায় সাক্ষাত করেন। এ সময় তিনি তার ব্যাক্তিগত তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরন করার জন্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট সায়েদুল হক এর হাতে দুই লাখ টাকা তুলে দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক তানজিল আহমেদসহ উপজেলার শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেফতারকৃতের ৮ জন রিমান্ডে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় প্রথম দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনায় প্রথম দফায় গ্রেফতারকৃত ১১ জনকে সোমবার নাসিরনগর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিন আদালতে রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদালত তাদের ৮ জনকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তারা হলোÑ উজ্জল মিয়া, মামুন মিয়া, ইয়ামিন মিয়া, শাহীদ মিয়া, রুনাইদ, খায়রুল মিয়া, বাবুল মিয়া, ছোট্ট মিয়া। কোর্ট ইন্সপেক্টর মাহাবুবুর রহমান রিমান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নাসিরনগরের ঘটনায় ৪ মামলা এলাকায় গ্রেফতার আতঙ্ক
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ