Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

টাকার সুবর্ণজয়ন্তী

মুদ্রার নাম ‘টাকা’ হলো যেভাবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

১৯৭২ সালের ৪ মার্চ প্রথমবারের মতো বাজারে এসেছিল স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত ১ টাকার নোট। সেই হিসেবে গতকাল শুক্রবার দেশের নানা সংস্থা থেকে দিনটিকে উদযাপন করা হচ্ছে, দেয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিবৃতি।
১৯৭২ সালের মার্চ মাসে একই দিনে ১ টাকা, ৫ টাকা ও ১০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়েছিল। একই বছর মে মাসে ১০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়। বাংলাদেশের প্রথম কাগুজে মুদ্রা চালুর দিনটি গত বছর থেকে পালিত হচ্ছে ‘টাকা দিবস’ হিসেবে।

এবারের টাকা দিবসে দুই দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে দেশের প্রথম ব্যাংক নোট ও মুদ্রাবিষয়ক পত্রিকা কালেক্টার। এ আয়োজনে থাকছে সংগ্রাহক মহাসমাবেশ, মেগা অকশন এবং পুরস্কার বিতরণীসহ নানা আয়োজন।
নিজস্ব মুদ্রা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের একটি প্রতীক। তাই হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নিজস্ব ব্যাংক নোট চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম নোটগুলো ছাপিয়ে আনা হয়েছিল ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, স্বাধীনতার পর নিজস্ব মুদ্রা না থাকার কারণে সার্বিক অর্থ ব্যবস্থায় সঙ্কট ছিল। এরপর খুব কম সময়ে, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ২ মাস ১৯ দিন পর বাংলাদেশে কাগজের টাকার প্রচলন হয়। এর আগে দেশে পাকিস্তানি মুদ্রার প্রচলন ছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি সংবলিত রুপি নামক সেই মুদ্রায় উর্দু, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় মান লেখা থাকত।

ব্যাংক নোটবিষয়ক তথ্য ও গবেষণাধর্মী পত্রিকা কালেক্টার জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রথম কাগুজে নোটের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গতকাল শুক্র ও আজ শনিবার তাদের উৎসবের আয়োজন করেছে। তৎকালীন বাংলাদেশে সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল হওয়ায় ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রথম টাকা ছাপানো হয়েছিল।
এদিকে একেক দেশের মুদ্রার নাম একেক রকম। তাই প্রশ্ন জাগে, আমাদের মুদ্রার নাম ‘টাকা’ হলো কীভাবে।
টাকা শব্দটিকে আমাদের ‘ভাষার বিকাশের ইতিহাস’ হিসেবেও দেখা যায় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. মেসবাহ কামাল। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার শিকড় দুটি: প্রাকৃত ও সংস্কৃত। এ দুটি ভাষায় একটা শব্দ ছিল ‘টংকা’। সংস্কৃত ও প্রাকৃত দুটিতেই ‘টংকা’ শব্দটি থাকায় সেখান থেকে টাকা শব্দটি এসেছে। কারণ শব্দটি আমাদের ভাষার শিকড়ে রয়েছে। এ জন্য ডলার, ইউরো অন্য কোনো নাম হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মুদ্রার নাম রুপি। কিন্তু পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় রুপিকে টাকা বলে। কারণ, টাকা শব্দটি শিকড়ের মধ্যে আছে। ভাষার যে শিকড় তার মধ্যে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, পাকিস্তানি আমলে সবাই রুপি বললেও তখনও আমরা টাকা বলতাম। টাকা শব্দটি বাংলা। স্বাধীনতার পর নতুন সরকার এসে বাংলা শব্দ ‘টাকা’কে মুদ্রার নাম হিসেবে গ্রহণ করে। ডলারের মতো টাকারও একটা চিহ্ন আছে। টাকা শুধু মুদ্রা নয়, আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
টাকা শব্দের উৎপত্তি

মূলত সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভব ‘টাকা’ শব্দের। সংস্কৃত শব্দ ‘টঙ্ক’, যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। পরবর্তী সময়ে নামকরণ হয় টাকা। আগে যেকোনো ধরনের মুদ্রা বা ধাতব মুদ্রা বোঝাতে টাকা শব্দটির প্রচলন ছিল। অর্থাৎ টাকা দিয়ে সব সময়ই অর্থকে বোঝানো হয়েছে। চতুর্দশ শতকের শুরুতে বাংলায় এর প্রচলন শুরু হয়। বাংলা ভাষার একটি অংশ হিসেবে সব ধরনের কারেন্সি বা নোট বা মূলধন বোঝাতে ব্যবহার করা হয় ‘টাকা’ শব্দ।

মুদ্রার জন্মের ইতিহাস
স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন থাকার যুগে ধাতুর তৈরি টাকা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এ ধরনের টাকা ক্ষয় হয়ে যেত এবং এর পরিমাণ কমে যেত, অন্য দিকে অনেক পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা পরিবহন করা ঝুঁকি এবং খুবই কষ্টসাধ্য কাজ ছিল।
এরপর মানুষ স্বর্ণকারের কাছে স্বর্ণ রেখে একটা সিøপ বা রসিদ নিয়ে আসত। এই রসিদ অনেকটা চেকের মতো কাজ করত। লেনদেনের সময় রসিদ ধরিয়ে দিত এবং সেই রসিদ ওই স্বর্ণকারের কাছে জমা দিলে স্বর্ণকার তাকে ধাতুর মুদ্রা দিতে বাধ্য থাকত। কারণ সেই রসিদে এই কথাটা লেখা থাকত: ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে মুদ্রা দিতে বাধ্য থাকিবে।’ এরপর আধুনিকায়ন এবং জাতীয়করণের ফলে এটা কাগজের মুদ্রা কিংবা টাকায় পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে যেভাবে আসে টাকা
দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগ থেকেই ‘টাকা’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত এ দেশের মানুষ। টাকার আনুষ্ঠানিক যাত্রা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হলেও ১৯৪৭ সাল থেকে দেশে প্রচলিত পাকিস্তানি রুপিকে এ দেশে কাগজে-কলমে টাকাও বলা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি রুপির একপাশে ‘বাংলা দেশ’ এবং অপর পাশে ইংরেজিতে ‘বাংলা দেশ’ লেখা রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো। ১৯৭১ সালের ৮ জুন পাকিস্তান সরকার এই রাবার স্ট্যাম্পযুক্ত টাকাকে অবৈধ এবং মূল্যহীন ঘোষণা করে। এর পরেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ পর্যন্ত এই রাবার-স্ট্যাম্পযুক্ত পাকিস্তানি টাকা চলেছিল সারা দেশে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নতুন মুদ্রা প্রচলন শুরু হয়। তাতে সময় লেগেছিল তিন মাসের মতো। তাই ওই সময়ে পাকিস্তানি রুপিই ব্যবহৃত হতো। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশি কারেন্সিকে ‘টাকা’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে প্রথম কোষাগার মুদ্রা বের করা হয় ১ টাকার নোট। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এ নোটের প্রচলন ছিল।

বাংলাদেশি মুদ্রা কেন দুই ধরনের
দেশে প্রচলিত মুদ্রা দুই ধরনের। একটি সরকারি টাকা বা সরকারি মুদ্রা। অপরটি ব্যাংক নোট। সরকারি মুদ্রা হলো: ১ টাকা, ২ টাকা এবং ৫ টাকা। এর বাইরে সব নোটই ব্যাংক নোট। ব্যাংক নোট বাংলাদেশ ব্যাংক বের করে বলে এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের স্বাক্ষর থাকে। কিন্তু সরকারি নোট বের করে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়। এ জন্য এতে থাকে অর্থসচিবের সই। এর বাইরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান, স্থান ও ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ বিভিন্ন সময়ে স্মারক মুদ্রা, নোট ও ফোল্ডার দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মুদ্রণ করে। এসব স্মারক মুদ্রা ও নোট বিনিময়যোগ্য নয়।

টাকা ছাপা হয় যেভাবে
টাকশাল বা দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেড থেকে ছাপানো হয় টাকা। এই টাকশাল গাজীপুরে অবস্থিত। টাকশাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে টাকশালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
টাকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগ পর্যন্ত ভারত, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি থেকে বাংলাদেশের নোট ছেপে আনা হতো। তবে নোট ছাপানোর যাবতীয় উপকরণ কাগজ, কালি, রং, নিরাপত্তা সুতা ইত্যাদি এখনও বিদেশ থেকে আমদানি হয়।

টাকার ভবিষ্যৎ
বর্তমানে কাগুজে টাকার ব্যবহার অনেক কমেছে। মানিব্যাগ অথবা পকেট ফুলিয়ে টাকা রাখার যে প্রবণতা একসময় ছিল, এখন সেই ধারণা থেকে বের হয়ে আসছে সবাই। বড় প্রতিষ্ঠানের সিইও থেকে শুরু করে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক পর্যন্ত লেনদেনে কার্ডের দিকে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান আরও বলেন, টাকা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কারণ, ঈদের সময় নতুন নোট বাজারে ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, তখন কাগুজে নোটের চাহিদা বাড়ে।

তিনি বলেন, টাকার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ‘টাকা জাদুঘর’ করা হয়েছে। সেখানে শুধু যে মুদ্রা প্রদর্শন হয় তা নয়, কোন টাকার কবে কীভাবে উদ্ভব হয়েছে, সেটার বিবরণও দেয়া হয়েছে। তবে অর্থনীতির বিবর্তনের সঙ্গে টাকার ব্যবহারেও বিবর্তন হয়েছে। এখন কাগুজে টাকার ব্যবহার কমেছে। ডিজিটাল মুদ্রায় ঝুঁকছে সবাই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, একসময় বিনিময় মাধ্যম ছিল কাগুজে টাকা। কিন্তু এখন বিকল্প বের হয়েছে। ফলে আগের তুলনায় নগদ টাকার ব্যবহার কমেছে। তবে আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ নগদ টাকা পছন্দ করে। চেক বা কার্ডে লেনদেন অনেকে করতে চায় না। এ জন্য আমাদের কারেন্সি বেশি প্রয়োজন হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টাকার সুবর্ণজয়ন্তী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ