Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তিন কারণে রেমিট্যান্সে ধস

প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫২ পিএম, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

শামসুল ইসলাম ও তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের : মধ্যপ্রাচ্যের মন্দা, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ ও ভিসা নবায়ন ফি পরিশোধের কারণে টানা চার মাস ধরে রেমিট্যান্স কমছে। তাই এ বছর দশ মাসেই দ্বিগুণ জনশক্তি রফতানি হলেও এর প্রভাব পড়ছে না প্রবাসী আয়ে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এ কারণে দেশগুলো ব্যয় সংকোচন করেছে। যে কারণে আয় কমে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের যারা মোট প্রবাসীর এক তৃতীয়াংশের বেশি। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে।
অবৈধপথে (হুন্ডির মাধ্যমে) অর্থ পাঠানো বেড়ে যাওয়ার কারণেও রেমিট্যান্স কমছে। বিভিন্ন দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেট) বেশি বিনিময় পাওয়া যাচ্ছে।
পাশাপাশি ভিসা নবায়ন ফি পরিশোধে বিপুল অর্থের প্রয়োজনকেও রেমিট্যান্স কমার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, আসন্ন নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের ভিসার মেয়াদ নবায়নের জন্য বিভিন্ন ট্যাক্স পরিশোধ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে অনেকেই রেমিট্যান্স কম পাঠাচ্ছেন।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিট্যান্স সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স এসেছে ৪২৫ কোটি ৫৭ লাখ (৪.২৫ বিলিয়ন) ডলার। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ কম। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৫০৩ কোটি ২১ লাখ (৫.০৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হল বিদেশে থাকা কর্মীদের পাঠানো অর্থ। ২০১৫ সালে মোট জাতীয় আয়ের ১৩ শতাংশ অবদান ছিল এই প্রবাসী আয়ের।
বিএমইটি’র পরিচালক (বহির্গমন) টিপু সুলতান প্রবাসী আয় হ্রাস প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মন্দা ভাব চলছে। জনশক্তি রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা নাজুক। এসব দেশেই সব চেয়ে বেশি জনশক্তি রফতানি হয়ে থাকে। এ কারণেই রেমিট্যান্স হ্রাস পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বায়রার মালয়েশিয়া জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি’র চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন বে-বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সি’র স্বত্বাধিকারী মোঃ গিয়াস উদ্দিন বাবুল ইনকিলাবকে বলেন, দুই ঈদের সময়ে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যালেনে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠায়। বর্তমানে অনেক প্রবাসী কর্মীই দ্রুত টাকা পৌঁছানোর লক্ষ্যে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এ জন্য রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়ছে।
তিনি বলেন, আসন্ন নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের ভিসার মেয়াদ নবায়নের জন্য বিভিন্ন ট্যাক্স পরিশোধ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে অনেকেই দেশে পর্যাপ্ত রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছে না। প্রবাসী রেমিট্যান্স হ্রাসের এটিও একটি কারণ।
ব্যাংকসহ বৈধ পথে বিদেশি মুদ্রার হিসাব কষে রেমিট্যান্সের তথ্য দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে আসা অর্থের হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে থাকে না।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক সরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদেশে কর্মরত ৮৬ লাখ বাংলাদেশির পাঠানো অর্থের ৭৮ শতাংশ আসে ব্যাংকের মাধ্যমে। হুন্ডির মাধ্যমে আসে ১২ শতাংশ। হুন্ডির এই হার এখন বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখত বলেন, বিভিন্ন দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন প্রবাসীরা।
আগে সিঙ্গাপুর থেকে ১ ডলার পাঠালে যে টাকা পাওয়া যেত, এখন ওই দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে কম টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সে জন্যই একটু বেশি টাকার প্রত্যাশায় অনেক প্রবাসী এখন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন। কারণ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে বরাবরই দর ব্যাংকের চেয়ে বেশি বিনিময় মূল্য পাওয়া যায়।
মালয়েশিয়া ও ইউরোপীয় দেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিআইডিএসের এই গবেষক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১০০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। আগস্ট মাসে তা বেড়ে ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার হয়েছিল। তারপর থেকেই কমছে রেমিট্যান্স। সেপ্টেম্বরে তা কমে ১০৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১০১ কেটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
গত জুলাই থেকে আগস্টে রেমিট্যান্স বাড়লেও গত বছরের তুলনায় তা ছিল কম। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৩৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। আগস্ট মাসে আসে ১১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৩৫ কোটি ডলার, অক্টোবরে ১১০ কোটি ডলার।
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছিল। তবে আগের অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছিল।
রেমিট্যান্স কমলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এখনও সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
আমদানি ব্যয় কমে যাওয়া এবং বিদেশি ঋণ-সহায়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে রিজার্ভ এই সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। রপ্তানি আয় বৃদ্ধিও রিজার্ভ বাড়ার একটি কারণ বলে মনে করেন তারা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি। এই তিন মাসে গত বছরের তিন মাসের চেয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৪ দশমিক ১২ শতাংশ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তিন কারণে রেমিট্যান্সে ধস
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ