Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ক্ষমতা পাচ্ছেন চেয়ারম্যানরা

গ্রাম আদালত আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায়

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২২, ১২:১২ এএম

গ্রাম আদালতে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা পাচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সালে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল গ্রাম আদালত। এর পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইন করলেও কার্যকর করতে পারেনি। এ কারণে দিন দিন দেশের সকল আদালতে মামলা বেড়ে চলেছে। গ্রাম আইনটি কার্যকর হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। গ্রাম আদালত সাফল্যের মুখ দেখার কারণেই সরকার আইনটি দ্বিতীয় দফায় সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গ্রাম আদালতকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করতে পারলে জেলা পর্যায়ের আদালতসমূহে মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। আমরা গ্রাম আদালতের কিছু ধারা সংশোধন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছি।
দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কতিপয় বিরোধ ও বিবাদের সহজ ও দ্রæত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গ্রাম আদালত গঠনকল্পে প্রণীত আইন। গ্রাম আদালত যে কোনো ব্যক্তিকে আদালতে হাজির থেকে এবং সাক্ষী দেয়ার জন্য অথবা কোনো দলিল দাখিল করার জন্য সমন দিতে পারবে এমন সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করে আইনের খসড়া প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দিয়েছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আগামীতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলে জানা গেছে।
এদিকে গ্রাম আদালত আইন দ্বিতীয় দফায় সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু হলে তারা পুলিশকে বাধা দিচ্ছে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, দেশে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৩৭ লাখ। তবে বেসরকারি হিসাবে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। মূলধারার বিচারব্যবস্থায় ঝুলে থাকা এসব মামলা বিচারপ্রার্থীদের হয়রানির অন্যতম কারণ। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ভার ও ব্যবস্থাগত জটিলতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ বিচার পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। উচ্চ আদালত থেকে মামলার চাপ কমাতে, একই সঙ্গে জনগণের কাছে স্থানীয় বিচারব্যবস্থার সুযোগ পৌঁছে দিতে সরকার গ্রাম আদালতকে আরো কার্যকর করতে চায়। গ্রাম আদালত উচ্চ আদালতে মামলার জট কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৪৪টি মামলা উচ্চ আদালত থেকে গ্রাম আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেন গ্রাম আদালত। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে দেশের গ্রাম আদালতগুলোতে মামলা হতো ছয় থেকে সাত হাজার।
সাড়ে ৩৭ লাখ মামলার জটাজালে বিপর্যস্ত বিচারাঙ্গন। বিদ্যমান কোর্ট-কাচারিগুলোর ত্রাহি দশা। বিশৃঙ্খলা, দুর্ভোগ, অনিয়ম-দুর্নীতির ভিড়ে মামলার ফেরে পড়া বিচারপ্রার্থীর রুদ্ধশ্বাস ছোটাছুটি। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার এ এক জটিল কঠিন সমীকরণ। এসবের ধার না ধেরে প্রতিষ্ঠিত সরল এক বিচারব্যবস্থার নামই হচ্ছে ‘গ্রাম আদালত’। যে আদালতে নেই কালো গাউন পরা উকিল-মোক্তার-পেশকার। তবে রয়েছে লাল সালু বেষ্টিত এজলাস, কাঠগড়া। তবে নেই ১৪ শিকের গারদ। ইউনিয়ন পরিষদে বসছে ‘আদালত’। ফরিয়াদী-প্রতিবাদী উভয়েই হাজির। মজলিসে উপস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বাদী-বিবাদী সপক্ষে প্রমাণ ও সাক্ষী-সাবুদ হাজির করেন। তারা উভয়ের কথা গভীর মনোযোগ সহকারে শোনেন। অতঃপর হাজেরানে মজলিসের সামনে থমথমে ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে ঘোষিত হয় রায়। সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষিত এ রায় উভয়পক্ষ মেনে নিতে বাধ্য। কারণ এই ‘গ্রাম আদালত’-এর রয়েছে আইনগত শক্ত ভিত্তি। গ্রামে বসবাসকারী প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আইনগত প্রতিকার লাভের জায়গা হিসেবে ক্রমেই আস্থা লাভ করছে গ্রাম আদালত।
গ্রাম আদালত কার্যকর করেছিল প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার। গ্রামীণ বিচার-আচার স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি করার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রাম আদালত চালু হয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ মেয়াদে আদালতটি জনপ্রিয় হয়। পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইন করলেও কার্যকর করতে পারেনি। আইনটি কার্যকর হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। গ্রাম আদালত সাফল্যের মুখ দেখার কারণেই সরকার আইনটি দ্বিতীয় দফায় সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গত চার বছরে ২৭ জেলার ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে মোট ২ লাখ ২৭ হাজার ২৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৭টি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা ৮৪ শতাংশ। এই সময়ে ১৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্তপক্ষকে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মরণ কুমার চক্রবর্তী ইনকিলাবকে বলেন, গ্রাম আদালতের সাফল্য আসলেই অবাক করার মতো। সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়নের মধ্যে ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নে এই সাফল্য পাওয়া গেছে। গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পের অধীনে ছিল এসব ইউনিয়ন। এই প্রকল্প সারা দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদে চালু করা হলে বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। আমরা প্রকল্পটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি গ্রাম সরকার আইনটি আবারও সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছি। গ্রাম সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব সমস্যা হচ্ছে, তা দূর করার জন্য সংশোধনী দরকার। এর মধ্যে গ্রাম আদালতের বিষয়টিও রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সরকারি দলের। তাদের হাতে বিচারের ভার দেয়া নিরাপদ হবে কি না তা সঠিক বলতে পারব না। তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট বিচার করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ের এই আদালত জজ আদালতে মামলার চাপ কমিয়ে গোটা বিচারব্যবস্থায় গতিশীলতা এনেছে। তবে জনপ্রতিনিধিদের আচরণগত ত্রæটির কারণে এই আদালত অনেক সময় ভাবমর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু আইনগত দিক থেকে গ্রাম আদালত একটি পূর্ণাঙ্গ আদালত।
দীর্ঘদিন থেকেই বিরোধ-বিবাদ মীমাংসার মাধ্যম হিসেবে সালিসি ব্যবস্থা প্রচলিত। সালিসি ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৬ সালের গ্রাম আদালত আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষ মনোনীত দু’জন করে মোট চারজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। তবে প্রত্যেক পক্ষ মনোনীত দু’জন সদস্যের মধ্যে একজন সদস্যকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যান কোনো কারণে তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে বা তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপত্তি উঠলে, পরিষদের অন্য কোনো সদস্য আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো পক্ষ সদস্য মনোনয়ন না দিলে ওই মনোনয়ন ছাড়াই আদালত বৈধভাবে গঠিত হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। যদি কোনো পক্ষ ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্যকে পক্ষপাতিত্বের কারণে মনোনীত করতে না পারে, তাহলে চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে অন্য কোনো ব্যক্তিকে মনোনীত করা যায়। গ্রাম আদালত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা অন্য কোনো আদালতে পুনরায় বিচার করা যায় না। তবে এই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ থাকবে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে গ্রাম আদালত আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদকে ছোটখাটো মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেয়। তারই আলোকে ‘গ্রাম আদালত বিধিমালা, ২০১৬’ জারি করে গ্রাম আদালত ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা হয়।

 

 



 

Show all comments
  • Muneer ১ মার্চ, ২০২২, ১:০০ এএম says : 0
    Is totally bad idea, some chairman are non educated, how he will do judgments, even he doesn’t know what’s meaning , it’s totally bad idea , village people will be suffer lots
    Total Reply(0) Reply
  • মামুন রশিদ চৌধুরী ১ মার্চ, ২০২২, ৭:০৬ এএম says : 0
    এখন চেয়ারম্যানদের যে অবস্থা তাতে গ্রাম পর্যায়ে বহু মানুষ ন্যায়বিচার বঞ্চিত হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • জাকের হোসেন জাফর ১ মার্চ, ২০২২, ৭:০৭ এএম says : 0
    চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা দিলে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে হবে। বিনা ভোটের চেয়ারম্যান মানুষের ওপর বেইনসাফি করবে।
    Total Reply(0) Reply
  • তাসনোবা তামান্না ১ মার্চ, ২০২২, ৭:০৭ এএম says : 0
    এখনতো বিনাভোটে অযোগ্যরা চেয়ারম্যান হচ্ছেন!!!তারা কিভাবে বিচার সালিস করবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Mominul islam ১ মার্চ, ২০২২, ১০:৫৬ এএম says : 0
    চেয়ারম্যানের কাছে আমার জমি বিচার পাব কেমনে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ