Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চলনবিলের শুঁটকি রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব

প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী : উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলে এখন মাছের শুঁটকি তৈরির ধুম পড়েছে। এ জনপদের পাঁচটি জেলার ১২ উপজেলার হাজারো নারী শ্রমিক তাদের ব্যস্ত সময় পার করছে। নারীদের হাতের জাদুর তৈরি চলনবিলের শুঁটকি এখন দেশ ছেড়ে বিদেশে। শুঁটকি তৈরিতে নারীদের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। তাই সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা জরুরিভাবে গ্রহণ করা দরকার।
উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলের সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে দেশীয় পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। সেই ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। মাছে লবণ মাখানো, মাপজোখ করা, বহন করে মাচায় নেওয়া, উল্টে-পাল্টে নাড়া, বাছাই করা Ñ আরও কত কাজ! আর এসব কাজই হয় নারীর হাতে। মহাজন কেবল মাছ কিনেই দায়মুক্ত। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সিংড়া উপজেলা। সিংড়া ব্রিজসংলগ্ন বাজার থেকে কিলোমিটারখানেক আগের গ্রাম নিঙ্গুইন। চলনবিলের মিষ্টি পানির মাছের শুঁটকির জন্য বেশ নাম আছে জায়গাটির। মৌসুমে রাস্তার পাশের বিশাল এলাকাজুড়ে বসে শুঁটকি মাছ তৈরির কারখানা। আশপাশের গ্রামের নারীই প্রাণ এ শুঁটকিপল্লীর। চলনবিলের অধিকাংশ মাছ চলে আসে জেলা-উপজেলা সদরের আড়ত ও বাজারে। সেখান থেকে পাইকাররা শুঁটকির জন্য কিনে আনেন শত শত মণ মাছ। তবে জানুয়ারি মাছের পড়তি মৌসুম। তাই চাপ কম। ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত চলে শুঁটকির মাছ সংগ্রহ। বর্ষার পানিতে চলনবিলাঞ্চলে যেসব মাছ বেড়ে ওঠে, সেসব মাছ ধরা চলে এসময় পর্যন্ত। এখন মৌসুম প্রায় শেষ। বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এখন শুরু হচ্ছে ফসল বোনা। তাই দিনে সংগ্রহ ১০-১২ মণ মাছ। মৌসুমে এটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫-৪০ মণে। জানালেন শুঁটকিপল্লীর মালিকদের একজন রাশেদুল। সরকারি জায়গা লিজ নিয়ে চালানো এ পল্লীতে এখন কাজ করছেন জনা চল্লিশেক নারী। মৌসুমে এক হাজার নারী কাজ করেন। মাছ মাপজোখের পর মাখানো হয় লবণ। এটা মাছ দ্রæত শুকাতে সাহায্য করে, তাছাড়া মাছ ভালোও রাখে। লবণ মাখানো হলেই কাঁখে করে নারীরা নিয়ে যান মাচায়। মাচায় নেওয়ার পর মাছগুলো সুন্দর করে বিছিয়ে রোদমুখী করা হয়। এ কাজটিও করেন নারীরাই। শুধু রোদে দেওয়া নয়, সারাদিন তাদের কাজ কয়েকবার উল্টে-পাল্টে দেওয়া। রোদ কম থাকলে শুকাতে লাগে তিন-চার দিন। আবার রোদ বেশি থাকলে একদিনেই শুঁটকি হয়ে যায়। তবে বড় কিছু মাছে আবার একটু সময় লাগে। এখানে শুঁটকি করা হয় শোল, বোয়াল, রায়েক, খলিসা, পুঁটি, গুঁচি, টেংরা, চান্দা, বাতাসি, কাকিলা, বেলে, মলা, ইচা, টাকি প্রভৃতি মাছ। পুঁটি মাছের আধিক্য থাকে বেশি। লিপি, রাশিদা, ইতির মতো নারীরা এখানে কাজ করেন সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। মজুরি সে তুলনায় কমই বলতে হবে। ১১০ টাকা প্রতিদিন। মৌসুমে আরও বেশি সময় থাকতে হয়। মাচায় মাছ নাড়তে নাড়তে রাশিদা বলেন, কাজ করতে ভালোই লাগে। কিন্তু অনেক সুময় দেওয়া লাগে। তার তুলনাত মজুরি খুব বেশি পাই ন্যা। যা পাই তা দিয়্যা সোংসার একটু ভালো মুতন চলে। তাই স্বামী কাম কোরলেও কামেত আসি। কাঠের একটি হাতল দিয়ে পরম মমতায় মাছ নাড়তে দেখা গেলো তাকে। একটু শুকনো মাছগুলো থেকে আলগা আঁশটে ফেলার দারুণ ‘আর্ট’ আছে তার। রাস্তার পাশে কতগুলো অস্থায়ী খোলা ঘরে চলে মাছ বাছাইয়ের কাজ। সেখানে কাজ করছেন ইতি, লিপিসহ কয়েকজন। ছোট-বড়, ভালো-মন্দ মাছ বাছাই করাই তাদের কাজ। মহাজনের চেয়ে তারাই ভালো জানেন এ বিষয়ে। মহাজন জাকির জানান, পুঁটি ৪০-৮০ টাকায় কিনে শুঁটকি করে বিক্রি করেন ২৫০-৩৫০ টাকায়, রায়েক কেনা ৪০-৬০, বিক্রি ৮০-১৪০, খলিসা ২০-৪০ টাকায় কিনে বিক্রি ৭০-৮০ টাকায়। বোয়াল কেনা ১০০-১২০, বিক্রি ৫০০-৬০০, শোল ৮০-১০০ টাকায় কিনে বিক্রি ৫০০-৫৫০ টাকায়। চান্দা ৩০-৩৫ টাকা কেনা, বিক্রি ১০০-১২০। লিপি জানালেন, শোল আর বুয়াল শুকাতে একটু বেশি সুময় লাগে। এই মাছগুলান কাইটে শুকাবার দিতে হয়। এগল্যান মাছেত মাংসও বেশি থাকে। নারীর মমতাময়ী হাতে তৈরি মিষ্টি পানির এ শুঁটকি নাটোর, রংপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী প্রভৃতি এলাকায় যায় বেশি। ঢাকাসহ অন্য জেলায় আসে খুব কম। এ শিল্প স্বাবলম্বী করেছে গ্রামের অনেক নারীকে। বছরের ছয় মাস অন্তত তাদের কাজের অভাব থাকে না। গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে তারাও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই ছয়মাস তাদের মাছ কেনাও লাগে না। মহাজন নিয়মিত খেতে দেন। তাতে কম মজুরিতে কাজ করেও খুশি তারা। অন্তত মাছ তো কেনা লাগে না! গ্রামের সরল এসব নারী অল্পতেই তুষ্ট। তাই সারাদিন বিরামহীন খেটেও মুখে কষ্টের কথা নেই। মহাজনরা সবসময় ভালোই থাকেন। তবে এই নারীরাই দৃঢ় কর্মদক্ষতায় তাদের ভালো রাখেন।
সব কিছু মিলিয়ে বৃত্তম চলনবিল অঞ্চলের শস্য ও মৎস্যভাÐার নামে খ্যাত এই অঞ্চলের ফসলাদি ও মৎস্য সুস্থভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নতি লাভ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চলনবিলের শুঁটকি রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ