Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাংবাদিকতার নক্ষত্র পুরুষ আসফ-উদ্-দৌলা রেজা

প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

র.ক.ম নাজিম-উদ্-দৌলা : বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা। পুরো নাম রেজাউল মুস্তাফা মুহাম্মদ আসফ-উদ্-দৌলা। রেজা ছিল তার ডাক নাম। সবকিছু মিলিয়ে তিনি হলেন রেজাউল মুস্তাফা মুহাম্মদ আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা। গ্রাম বাংলার মেহনতি গণমানুষের কাছে তার পরিচয় ছিল ‘আসফ ভাই’ হিসেবে, সাংবাদিক ও সংবাদপত্র জগতে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয় রেজা ভাই। আর অন্যরা তাকে আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা বলে চিনতেন ও জানতেন। এ নামের মানুষটি যেমন বিশাল জ্ঞান ও প্রতিভা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি বিশাল, ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল তার জীবন ও কর্ম। তিনি নিঃসন্দেহে একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ও জাতির গর্বিত সন্তান। দেশ ও জাতির সেবায় আত্ম-নিবেদিত এ মানুষটির নাম আজ আর তেমন উচ্চারিত হয় না- অথচ এদেশ, এদেশের মাটি আর মানুষকে তিনি তার কাজে-কর্মে ও চিন্তায় সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন। একারনেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরি তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। কোন লোভ-লালসা, প্রাচুর্য্যরে মোহ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। যশঃ ও খ্যাতির লোভে এবং কোন কিছু পাবার প্রত্যাশায় কারো পিছনে ছোটাছুটি করেননি অথবা কারো দয়া ও করুণার প্রত্যাশী ছিলেন না। সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে তিনি পূতঃপবিত্র জ্ঞান করেছিলেন বলেই এ পেশাতে জীবনের শেষ নিংশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার স্বকণ্ঠে উচ্চারিত হতে শুনেছি ‘সাংবাদিকতার মতো পবিত্র পেশা আর কি হতে পারে?’। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা জগতে আসফ-উদ্-দৌলা রেজাকে অন্যতম পথ প্রদর্শক ও দীক্ষা গুরু হিসেবে আখ্যায়িত করা অযৌক্তিক হবে না।
আসফ-উদ্-দৌলা রেজার জন্ম ১৯২৬ সালে। পিতা ছিলেন বগুড়া জেলার ‘ধন কুন্ডী এস্টেটের’ সর্বশেষ জমিদার ও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট মরহুম আজগর হোসেন সরকার। প্রপিতামহ মরহুম মানিক উদ্দিন সরকার ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা জমিদার। পিতা মরহুম এলাহী বকস্ সরকারের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে মরহুম আজগর হোসেন সরকার জমিদারি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। প্রজাহৈতিষী, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও ধর্মভীরু এ জমিদার পরিবারের সুনাম আজো অক্ষুণœ আছে। প্রতিষ্ঠাতা জমিদার মরহুম মানিক উদ্দিন সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মকা-ে মুগ্ধ হয়ে মহারানী ভিক্টোরিয়া ‘দানবীর’ সম্বোধন করে তাকে অভিনন্দনপত্র পাঠিয়েছিলেন। আসফ-উদ্-দৌলা রেজার পিতা মরহুম আজগর হোসেন সরকারও তার পিতা ও পিতামহের আদর্শকে লালন করেছিলেন। প্রজাদরদী ও দৃঢ়চেতা এ মানুষটি সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি আজো শোনা যায়। উল্লেখ্য যে, মরহুম আজগর হোসেন সরকার মনে-প্রাণে একজন স্বদেশি ছিলেন এবং দুশো স্বদেশির থাকা-খাওয়া ও যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। আসফ-উদ্-দৌলা রেজার মাতা সৈয়দা ফেরদৌস মহল শিরাজী এবং মাতামহ ‘অনল প্রবাহের’ অমর কবি ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। মাতা ফেরদৌস মহল শিরাজী পিতার আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। সৈয়দা ফেরদৌস মহল শিরাজী ছিলেন তৎকালীন ইডেন গার্লস স্কুলের (বর্তমানে ইডেন গার্লস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) প্রথম মুসলিম ছাত্রী এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক জনসভায় বক্তৃতা প্রদানকারী প্রথম মুসলিম মহিলা। একই সঙ্গে নারী শিক্ষা ও নারী অধিকার আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন মোহাম্মদী, বসুমতী, সন্ধ্যা, সোলতান, সওগাত, নূর, বেগমসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা দেশপ্রেমমূলক কবিতা, প্রবন্ধ, গান নিয়মিত প্রকাশিত হতো। অগ্রণী এ নারীর জীবন ও কর্ম আজো দেশ ও জাতির অজানা রয়ে গেছে। পিতৃকুল ও মাতৃকুলের দিক থেকে আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা দুটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারী ছিলেন। প্রপিতামহ, পিতামহ ও পিতা এবং মাতামহ ও মাতার জীবনাদর্শের এক অপূর্ব সমন্বয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। সামন্তবাদী সমাজ ও পরিবেশে লালিত, পালিত হয়েও তিনি গণমুখী এবং গণচিন্তামূলক সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকায় (পঞ্চম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা) প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার উত্তরে বলেছিলেন ‘সামন্তবাদী পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু মনটা ছিল অশৈশব গণমানুষের সুখ-দুঃখের সাথে একাত্ম। ...................... পৈতৃক জমিদারির আওতাভুক্ত এলাকায় পাখি শিকার ইত্যাদি সখের কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। সাধারণ মানুষের সাথে মিশে তাদের জীবন উপলব্ধির চেষ্টা করতাম। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি, পিতার জমিদারি আমলে একবার এক প্রজার বিদ্রোহী মনোভাবের জন্য জমিদারের কর্মচারীরা তার বাড়ি-ঘর ভেঙে দেয়। বিষয়টি কিশোর আসফ-উদ্-দৌলা-রেজাকে দারুণভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত করে। তিনি বিনীত প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে এ বিষয়ে জমিদার পিতার সাথে আলাপ করেন। পুত্রের মনোভাব বুঝতে পেরে পিতা সেরেস্তার তরফ থেকে ঐ প্রজাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন এবং এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর জন্য সকলকে সতর্ক করে দেন।
আসফ-উদ্-দৌলা-রেজার মৃত্যুর দুদিন পর ১৯৮৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকে কলাম লেখক সুহৃদ “চর্তুরঙ্গ” কলামে লেখেন ‘সাধারণ মানুষই সব আদর্শের লক্ষ্য। সাধারণ মানুষের কল্যাণই সব আদর্শের শেষ কথা। সময়ে এই বোধ যারা সম্যক্ষ উপলব্ধি করতে পারেন, শুধু উপলব্ধি করতে পারা নয়, এই বোধকে ভাষা দিতে পারেন তারই সার্থক কর্মী পুরুষ। আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা তার জীবদ্দশায় নানাভাবে এই ভূমিকাকে মূর্ত করে তুলতে চেয়েছেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে তার এই ভূমিকা অবশ্যই পথিকৃতের ভূমিকা হিসেবে উল্লেখিত হবে।.......... একজন নগন্য সাংবাদিক হিসেবে মরহুম আসফ-উদ্-দৌলা-রেজাকে সব সময়ই মনে রাখব। কেননা তিনি সাংবাদিকতা জগতের একজন পতাকাবাহী পুরুষ। তার স্মৃতি ম্লান হওয়ার নয়।’ কলামে সুহৃদ আরো লেখেন ‘আমরা তাকে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বা কার্য-নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে মনে রাখতাম কি-না সন্দেহ, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় অগ্রজ, তার সেই পরিচয়ই বড় ছিল আমাদের কাছে। বয়সে বড় হলেই অগ্রজের এই শ্রদ্ধা সবাই অর্জন করতে পারেন না। যার ব্যক্তিত্ব গুণটি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, বুদ্ধি ও হৃদয়ের বিচারে যিনি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেন, বড়’র বা অগ্রজের শ্রদ্ধা তারই প্রাপ্য। রেজা ভাইর এই ব্যক্তিত্বটি একটু প্রখরভাবেই চোখে পড়ত। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা স্বাস্থ্যবান মধ্যমাকৃতির সুপুরুষ ব্যক্তিটিকে দেখামাত্র চেনা যেত ইনি আর দশজনের চেয়ে আলাদা।......... একজনকে সম্মান করে শ্রদ্ধা জানিয়ে বড় ভাই ডেকে নিজেও আনন্দ পাওয়া যায়। রেজা ভাই আমাদের কাছে আনন্দের এই উৎস ছিলেন বরাবর।........যারা আসফ-উদ্-দৌলা রেজাকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, তারাই সব কিছুর ঊর্ধ্বে এই কথাটা স্বীকার করবেন যে, সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হওয়াই ছিল তার জীবনের আদর্শ। সাংবাদিকতার পেশায় থেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ, দুর্ভোগ- দৈন্যের কথা বলা যায় না। রেজা ভাই তার সেই কর্তব্য সাংবাদিক হিসেবে কতটা করতে পেরেছেন, যে মূল্যায়ন স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়।’ প্রকৃত পক্ষে আসফ-উদ্-দৌলা-রেজার বিশালতার পরিমাপ সহজসাধ্য নয়। আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা তার সাংবাদিকতা জীবনে সহকর্মী তথা সহযোদ্ধাদের কাছে কতটা আত্মার-আত্মীয় ছিলেন তা বুঝা যায় ১৯৮৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘আসফ-উদ্-দৌলা-রেজার আদর্শ অনুসরণ তাহার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রকৃষ্ঠ পথ’ শীর্ষক খবর থেকে। খবর থেকে জানা যায় ইত্তেফাক ভবনে অনুষ্ঠিত মরহুম আসফ-উদ্-দৌলা-রেজার শোকসভায় সাংবাদিক, সংবাদপত্রসেবী, শিক্ষক, শিল্পীসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই শোক সভায় বিপুল সংখ্যক গুণীজনের সমাবেশ ঘটেছিল। স্মৃতি তর্পণ অনুষ্ঠানে বক্তব্যকে ছাপিয়ে আবেগ-মথিত কান্নায় সহকর্মীরা বার বার ভেঙে পড়েন। প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট রাহাতখান রচিত ‘অমল ধবল চাকুরী’ উপন্যাসে সহকর্মীদের প্রতি আসফ-উদ্-দৌলা-রেজার গভীর মমত্ববোধ, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির প্রমাণ পাওয়া যায়। উপন্যাসের নায়ক দৈনিক ইত্তেফাকে কর্মরত একজন সাংবাদিক। একটি বিশেষ কারণে তিনি চাকরিচ্যূত হন। চাকরি হারানোর পর তিনি চরম অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে অন্য সহকর্মীদের সাথে এ প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলে সহকর্মীরা তাকে শান্ত¦না দিয়ে বলেন তুমি আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা ভাইর কাছে যাও। রেজা ভাই থাকলে কারো চাকরি যায় না। আসলে উপন্যাসের এই বক্তব্য আসফ-উদ্-দৌলা রেজার জন্য বাস্তবে শতভাগ প্রযোজ্য। কি বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা বহুমুখী প্রতিভা ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের সময় দারিদ্র্যকে জীবনের সহচর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সাহায্য প্রার্থী অজস্র মানুষকে সাহায্য ও রক্ষা করতে তিনি বিন্দু মাত্র কুণ্ঠিত হননি। নিজেকে একজন সংগ্রামী, ত্যাগী, পরপোকারী ও আপসহীন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহুকুমার (বর্তমানে জেলা) চান্দাইকোনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কিছুদিন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়ন করেন। এরএর ১৯৪৭ সালে কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়কালে তিনি বেকার হোস্টেলে থাকতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সহপাঠি ছিলেন তিনি। জাতির জনকের সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব সম্পর্কের কথা প্রবীণদের অনেকেরই জানা আছে। পিতার জমিদারি চলে যাওয়ার পর অবস্থার চাপে তাকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রপিতামহ জমিদার মানিক উদ্দিন সরকার তার বিশাল ভূ-সম্পত্তির বিরাট অংশ জনকল্যাণ ও ধর্মীয় কাজের জন্য ওয়াকফ করে ছিলেন যা আজো বিদ্যমান ও ‘হিরণ নেছা-মানিক উদ্দিন ওয়াকফ এস্টেট’ নামে পরিচিত। আসফ-উদ-দৌলা-রেজা কর্ম জীবনের শুরুতে কিছুদিন চান্দাইকোনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক আজাদে সহঃসম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেন। সরকারি তোষণ নীতি মেনে নিতে না পারায় তিনি দৈনিক আজাদ ত্যাগ করেন। পরে কিছুকাল দৈনিক সংবাদে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে ইত্তেফাক পত্রিকা দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে তিনি সহকারী বার্তা সম্পাদক পদে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগাদান করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক এবং ১৯৭২ সালে বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক পদে আসীন হন। এদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা জগতের কিংবদন্তি পুরুষ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মানসপুত্র ছিলেন মরহুম আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ, তার আদর্র্শ, চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসকে আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা নিজ জীবনে ধারণ করে তার সুযোগ্য ভাবশিষ্য একনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা একজন আপসহীন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও শহীদ সিরাজ উদ্দিন হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মরহুম আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা স্বীয় অধ্যবসায়, আন্তরিকতা ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে দৈনিক ইত্তেফাকের সংগ্রামী চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যান। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তার প্রাণপ্রিয় সাধনার ধন। এ দেশের সাংবাদিকতার জগতে আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা কত উঁচুমাপের ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তা বুঝা যায় ১৯৮৩ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে ‘স্থান-কাল-পাত্র’ কলামে কলাম লেখক “লুদ্ধুক” এর লেখার শেষাংশ থেকে। “লুদ্ধুক” লিখেছেন “উপসংহারে জনান্তিকেই বলে রাখি, এদেশে রেজা ভাই অনুসৃত সাংবাদিকতার সেই ধারাটির যদি কোন দিন সত্যি সত্যি বিলুপ্তি ঘটে তাহলে সেদিনই রেজা ভাইয়ের মৃত্যু হবে। তার আগে তার কোন মৃত্যু নাই।” এ দেশের সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীদের কাছে আসফ-উদ-দৌলা রেজা কতটা আপন ছিলেন তা বুঝা যায় তার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত বির্ভিন্ন শোকসভা ও স্মরণ সভার সংখ্যা থেকে। সমগ্র বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, বন্দরে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার মৃত্যুতে অসংখ্য শোকসভা, স্মারণ সভা ও দোয়া-মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতেই বুঝা যায় কিভাবে তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাদের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আসফ-উদ্-দৌলা-রেজার ঢাকায় জিগাতলার ভাড়া বাসায় তার কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে স্বনামধন্য সাংবাদিক মরহুম সানাউল্লাহ নূরী কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন “দেশ যখন জ্বলছে, রেজা ভাই তখন চলে গেলেন কিন্তু আমাদের করণীয় কি, কিছুই বলে গেলেন না।” পাশে দাঁড়িয়ে আরেক প্রথিতযশা সাংবাদিক মরহুম এবিএম মুসা ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন “রেজা ভাই চলে গেলেন, আমাদের জন্য কি উপদেশ দিতে চেয়েছিলেন জানতে পারলাম না।” সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালে তার মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে অনেক সাংবাদিক, সম্পাদক, সংবাদপত্রের মালিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকসহ আরও অনেককে চিৎকার করে কাঁদতে দেখেছি।
আগেই উল্লেখ করেছি মরহুম আসফ-উদ্-দৌলা রেজা বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সে প্রতিভার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছিল একজন বেতার ও টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার অবস্থান অবশ্যই ঈর্ষণীয়। ১৯৫১ সালে তিনি তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে দৈনিক প্রচারিত “আমার দেশ” অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশেও বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত ঐ অনুষ্ঠান তিনি পরিচালনা করতেন। মৃত্্ুযর কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আসফ-উদ্-দৌলা রেজা সাংবাদিক খ্যাতির পাশাপাশি এই দেশের মানুষের প্রিয় “আসফ ভাই” হিসেবে সুপরিচতি হয়ে উঠেন। বলা প্রয়োজন গ্রামীণ শ্রোতাদের কেউ কেউ অনুষ্ঠানটিকে “মজিদের মার আসর” বলতো। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিভিন্ন শিক্ষামূলক, ইতিহাস ভিত্তিক ও তথ্য ভিত্তিক অনুষ্ঠান তিনি উপস্থাপন করতেন। লেখালেখির জগতেও আসফ-উদ্-দৌলা রেজার বিচরণ ছিল। “অভিযোগ” নামে তার লেখা একটি উপন্যাস পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছিল। “সিমলা নদীর বাঁকে” তার লেখা বেতার নাটকটি বহুল প্রশংশিত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত মতবাদ, রাজনীতি ও সরকার, নিরস্ত্র সংগ্রাম ইত্যাদি অনুবাদ গ্রস্থ তাকে একজন বিশিষ্ট অনুবাদকের মর্যাদা দান করেছিল। তিনি জাতীয় আইনশৃংখলা উপকমিটি, চলচ্চিত্র, সেন্সর বোড, সিভিল এভিয়েশন, কনসালটেটিভ কমিটি, শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনা কমিটি, সাক্ষরতা সমিতি, আরবান রেডক্রস পরিচালনা কমিটি, লিগ্যাল এইড কমিটি, বেতার উপদেষ্ঠা কমিটি, জাতীয় নজরুল স্মৃতি কমিটি, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার উপদেষ্ঠা কমিটিসহ বহু সেবামূলক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের পরীক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন। মরহুম আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা তুরস্ক, চীন, পাকিস্তান, জাপান, ইরাক, লেবানন, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তিনি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৯০ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর “একুশে পদকে” ভূষিত করেন। এছাড়া সাংবাদিকতায় তিনি “ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার” লাভ করেন। কীর্তিমান এই মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই। সাংবাদিকতার নক্ষত্র পুরুষ আসফ-উদ্-দৌলা-রেজা তার উত্তরাধিকারী বর্তমান ও ভবিষ্যত সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবেন- এ প্রত্যাশা করা যায়। মহান আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে নসীব করুন।
লেখক অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাংবাদিকতার নক্ষত্র পুরুষ আসফ-উদ্-দৌলা রেজা
আরও পড়ুন