Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আওয়ামী লীগে শুরু হয়েছে শুদ্ধি অভিযান

টার্গেট জাতীয় নির্বাচন

প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২১ পিএম, ৩ নভেম্বর, ২০১৬

তারেক সালমান : জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন শেষে এবার সারাদেশের সংগঠনকে গোছাতে কাজ শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ‘আবর্জনা সাফ’ করে আরও বেশি শক্তিশালী, গণমুখী হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব। বিজয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষায় দলকে সাধারণ নাগরিক ও ভোটারদের কাছে নিয়ে যাওয়ার টার্গেট হাতে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আর নির্বাচনে দলকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সত্যিকার জনমুখী করারও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে দলটি। নতুন নেতৃত্বের লক্ষ্য বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগামী জাতীয় নির্বাচনেও দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়া।
আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বলেন, প্রধানত আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার টার্গেট নিয়েই এবারের কমিটি করা হয়েছে। যারা দলীয় কর্মকা-ে বেশি সময় দিতে পারবেন এমন ক্লিন ইমেজের নেতাদেরই নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্যই দলের সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এমন প্রভাবশালী অথচ তরুণ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদেরও কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হয়নি। নতুন কমিটির  নেতা ও সম্মেলনে আসা জেলার নেতারা সম্মেলনের পরদিন গণভবনে শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে সেখানেও তিনি নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশনা দেন।
গত ২২ ও ২৩ অক্টোবর রাজধানী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অত্যন্ত জাঁকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণভাবে দলের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল শেষ সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগ। সম্মেলনের মাধ্যমে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের। এছাড়াও কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটিও ইতোমধ্যে গঠন করেছে দলটি।
দলীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটির নতুন নেতৃত্ব উদ্যোগ নিয়েছে ‘দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা আগাছা পরিষ্কারের’। উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযানের। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের কাছে দলের হাইকমান্ডের ‘ম্যাসেজ’ পৌঁছে দিচ্ছেন।
গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে আওয়ামী যুবলীগের এক বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলকে আবর্জনা, হাইব্রিড ও পরগাছা মুক্ত করতে যুবলীগের সহযোগিতা কামনা করেন।
একই দিন বিকালে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের  জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বর্ধিত সভায়ও প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের কাছে দলের কড়া ‘ম্যাসেজ’ দেন। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভাষণ কম, এ্যাকশন বেশি। আওয়ামী লীগের পরবর্তী লক্ষ্য জাতীয় নির্বাচন উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণের ভালোবাসা অর্জন এবং মন জয় করতে হবে। খারাপদের শুদ্ধ ও সংশোধন করতে হবে। অন্যথায় অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেই এ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা এখন জনগণের কাছে যাব। জনগণকে খুশি করাই আমাদের পরবর্তী এজেন্ডা। যারা আচারণগতভাবে খারাপ, জনগণের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন, তারা দ্রুত শুদ্ধ হয়ে যান। নিজেদের সংশোধন করুন। যারা ভুল করেছেন, তারা এলাকার জনগণের কাছে ক্ষমা চান। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হবে। এর জন্য কোনো আপোষ নেই।  
সূত্র মতে, দলকে আরও গণমুখী করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে নতুন কমিটি। এজন্যই সম্মেলনের মঞ্চ থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ার উপর জোর দিয়ে তাদের তালিকা তৈরি করতে দলের সর্বস্তরের নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- প্রচার এবং জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েও কাজ শুরু করছে নতুন কমিটি।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, নবগঠিত কমিটির অন্যতম লক্ষ্য দলকে সুসংগঠিত করা, শক্তিশালী করা, সর্বোপরি আওয়ামী লীগকে আরও গণমুখী করে তোলা। আগামী নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করতে এ কমিটিকে অনেকদূর পাড়ি দিতে হবে।
সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমেই টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে চায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই নির্বাচনে যাতে কোনোভাবেই বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো বিতর্কিত নির্বাচন না হয়, সেজন্যও সচেতন রয়েছে দলটি। বিগত দশম জাতীয় নির্বাচনে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই অংশ না নেয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আর বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করায় গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতাহীনতার কারণে ‘একতরফা’য় রূপ নেয়।
সূত্র জানায়, দল ও সরকারে শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদেও ব্যাপক রদবদল করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের সফল কাউন্সিলের পর হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও ঝিমিয়ে পড়া সাংগঠনিক শক্তি চাঙা করতে দল ও সরকারকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে শাসক দলটি। সে লক্ষ্যে তুণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নবীন-প্রবীণ নেতাদের সমন্বয় করা হচ্ছে। যার বহিঃপ্রকাশ ইতোমধ্যেই দলের নতুন কমিটিতে দেখা গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, সরকার ও দলীয় কাঠামো থেকে দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিত নেতাদের বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের কমিটির পর নিজের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভায় বিতর্কহীন ও অপেক্ষাকৃত সৎ ও তরুণ নেতাদের স্থান দেয়ার কথা ভাবছেন তিনি। সূত্রের দাবি, প্রধানমন্ত্রী ও সভাপতি শেখ হাসিনা দলকে ঢেলে সাজাতে নেতাদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বিতর্কিতদের দলে না রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র বানানোর যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তার নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সেই ধরনের একটি শিক্ষিত ও সু-শৃঙ্খল টিমও গঠন করতে চান। দলে এমন কাউকে স্থান দেবেন না, যার কারণে আওয়ামী লীগের বদনাম হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। যারা দলকে ইমেজ সঙ্কটে ফেলেছে, দুর্নীতি করেছে, অন্যায় করেছে, তাদেরকে দলে না রাখার ব্যাপারেই মত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সেভাবেই আগামী দিনের জন্য নতুন নেতৃত্ব তৈরি করছে আওয়ামী লীগ।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে সারাদেশে দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের জন্য কাজ শুরু করেছেন সিনিয়র নেতারা। দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী, বেফাঁস মন্তব্যকারী, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ, দখলদার ও সন্ত্রাসীদের বাদ দিয়ে শিক্ষিত ইমেজধারী ও নতুনদের তুলে আনার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে দলের আগাছাদের বাদ দিতে একটি তালিকা তৈরি করেছে দলটি। এছাড়াও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা নেতাদেরও চিহ্নিত করতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। তাছাড়া  কোনোভাবেই যাতে বাইরের কেউ হাইব্রিড হিসেবে দলে ঢুকতে না পারে সেদিকেও কড়া নজর রাখছে দলটির সিনিয়র নেতারা। সবকিছু মিলিয়ে আগামীতে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যেই দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা হয়েছে। তারা উল্লেখ করেছেন, হত্যাকা-, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে দলটি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নিতে যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছর যাবত বহুল বিতর্কিত-আলোচিত কক্সবাজারের সংসদ সদস্য বদি ইতোমধ্যেই সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দোষীয় সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাকে রক্ষায় দলীয়ভাবে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করা হয়নি। এছাড়া, সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রী খাদিজাকে কোপানোর অভিযোগে আটক শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুলকে রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। বরং তার উপযুক্ত বিচারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ছাত্রলীগ তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করেছে। গেল সপ্তাহে রাজধানীর গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদের সময়ে অবৈধ অ¯্র উঁচিয়ে হকারদের ধাওয়া করা ঢাকা দক্ষিণ শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতাকেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বহিষ্কার ও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই হত্যা চেষ্টার মামলাও করেছে পুলিশ। তাদের রক্ষায় ছাত্রলীগ কোনো তৎপরতা দেখায়নি। এসবই হচ্ছে দল ও সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে। ক’দিন আগে ফরিদপুরের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে অন্যর জমি দখলের অভিযোগ উঠলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ।
আওয়ামী লীগের ভেতরে শুদ্ধি অভিযানের বিষয়ে গত রবিবার সচিবালয়ে আয়োজিত সংলাপের প্রশ্নের জবাবে নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এতবড় দল, এতবড় পরিবার। পরিবারের মধ্যে কিছু ছোট-খাটো সমস্যা থাকে। বাস্তবতা অস্বীকার করে তো লাভ নেই। কিছু ট্রাশেস ঢুকে গেছে, কিছু আবর্জনা, কিছু প্যারাসাইট-এখানে, ওখানে নানান সমস্যা সৃষ্টি করে। এগুলোকে আমরা ঠিকঠাক করব।
কাদের বলেন, অলরেডি বলে দেয়া হয়েছে, অপকর্ম যারা করছে, যারা দলের সম্মানকে ক্ষুণœ করছে, তারা যদি সংশোধন না হয়, পরবর্তী নির্বাচনে তাদের নমিনেশনের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।




 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আওয়ামী লীগে শুরু হয়েছে শুদ্ধি অভিযান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ