Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শেষ হয়েছে সাগর-নদীতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা

প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

৭ মাসের জন্য জাটকা আহরণ ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ
নাছিম উল আলম : নিরাপদ প্রজননের মাধ্যমে ইলিশের বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে টানা ২২ দিনের অবরোধ গত মধ্যরাত থেকে উঠে যাবার পাশাপাশি ১ নভেম্বর থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। ফলে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও চারা পোনা জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপণন বন্ধ থাকবে আগামী ৭ মাস।
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে ইলিশের উৎপাদন ও সহনীয় আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকেই সরকার ‘মৎস্য সংরক্ষণ আইনÑ১৯৫০’এর আওতায় আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার দিনসহ এর আগের ৪ দিন ও পরের ১৭ দিন এবার উপকূলের প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার ইলিশ মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করে। পাশাপাশি সারা দেশেই ইলিশ-এর আহরণ, পরিবহন ও বিপণন বন্ধ ছিল। মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ সুপারিশের আলোকেই ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার দিনসহ আগে ও পরের পাঁচ দিন করে মোট ১৫ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে সর্বশেষ গবেষণার সুপারিশের আলোকে চলতি বছর পূর্ণিমার দিন ছাড়াও আগের চার দিন ও পরের ১৭ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত রাখতে সাড়ে ৩ লাখ জেলে পরিবারকে ২০ কেজি করে ৭ হাজার ১শ’ টন চাল বিতরণ করার কথা জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সহয়তায় এসব চাল বিতরণের কথা বলা হলেও উপকূলের অনেক এলাকাতেই এ চাল বিতরণ নিয়ে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার ২ লাখ ২৮ হাজার জেলে পরিবারের মধ্যে ৪ হাজার ৫৫৮ টন চাল বিতরণের কথা জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর।
মৎস্য অধিদফতরের মতে গত ২২ দিনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে সারা দেশে প্রায় ২ হাজার ১শ’রও বেশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বরিশাল বিভাগের ছয় জেলাতেই প্রায় হাজার খানেক মোবইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও সারা দেশে প্রায় ১১ হাজার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এসময়ে। যার মধ্যে বরিশাল বিভাগেই পরিচালিত অভিযানের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এসব মোবাইল কোর্ট ও অভিযানে ১ কোটি ৫৫ লাখ মিটার জাল বাজেয়াপ্ত করা হয়। যার মধ্যে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর বিভিন্ন নদ-নদী থেকেই প্রায় ৩০ লাখ মিটার জাল জব্দ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসময় বিভিন্ন নদ-নদী থেকে বেআইনীভাবে আহরিত ৩০ টনেরও বেশী ইলিশ বাজেয়াপ্ত করে ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ আইন-শৃংখলা বাহিনী। যার মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর নদ-নদী থেকে প্রায় ৫ টন ইলিশ জব্দ করা হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, গত ২২ দিনের অবরোধ চলাকালীন সময়ে সারা দেশে বেআইনীভাবে ইলিশ আহরণের দায়ে প্রায় ১ হাজার ৭শ’ মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার মধ্যে বরিশাল বিভাগেই সাড়ে ৩শ’রও বেশী মামলা হয়েছে। এসময় ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলোর কাছে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সারা দেশে প্রায় ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় ছাড়াও প্রায় ১ হাজার ২শ’ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের প্রায় ১২ লাখ টাকা জরিমানা ছাড়াও ২৭৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, অভিপ্রায়নি মাছ ইলিশ প্রতিদিন স্রোতের বিপরীতে প্রায় ৭১ কিলোমিটার বিচরণ করে থাকে। ইলিশ সারা বছর ডিম ছাড়লেও আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে পরে শতকরা ৬০-৭০ ভাগেরও বেশী মা ইলিশ প্রজনন করে থাকে বিধায় ২০০৭ সাল থেকে এ সময়ে আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। এতে করে প্রচুর পরিমাণ মা ইলিশ আহরণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে। ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতিবছর ৪% থেকে ৮%পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতবছর দেশে ইলিশের সহনীয় আহরণ প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল জানিয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরে ৪ লাখ টন অতিক্রমের সম্ভাবনা রয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের ৫০-৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। মায়ানমারে ২০-২৫% এবং অবশিষ্ট ১০-১৫% ভারতে ও ইরানে আহরিত হয়ে থাকে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান ১%-এরও বেশী। মৎস্য সম্পদে একক প্রজাতি হিসেবে এর অবদান প্রায় ১২-১৩%। তবে আমাদের দেশে যখন ইলিশের মূল প্রজনন সময়ে এর আহরণ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তখন ভারতীয় জেলেরা অনেক সময়ই বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সীমা অতিক্রম করে আমাদের সীমার মধ্যে ইলিশ আহরণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমাদের মৎস্য বিজ্ঞানীগণ ইতোমধ্যে দেশের উপকূলীয় প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘ইলিশ প্রজনন এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৮৭-৮৮সালে দেশের অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক জলাশয় থেকে সর্বমোট ইলিশ উৎপাদন ও সহনীয় আহরণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৮৩ লাখ মেট্রিক টন। ৯৪-৯৫ সালে তা ২.১৩ লাখ টন ও ২০০০-০১ সালে ২.২৯ লাখ টনে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০০২-০৩ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদনে পুনরায় বিপর্যয় নেমে আসে। সেসময় উৎপাদন মাত্র ১.৯৯ লাখ টনে হ্রাস পায়। ফলে বিষয়টিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে সরকার মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের ভিত্তিতে ঐ বছর থেকেই ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে ‘জাটকা নিধন বন্ধ’র প্রাথমিক কর্মসূচী গ্রহণ করে। এর পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচীর আওতায় ইলিশ সম্পদ রক্ষাসহ এর ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব প্রদান করায় দেশে ইলিশ সম্পদ গত দেড় দশকে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইলিশের প্রকৃতিক প্রজনন সাফল্য নিরূপন সমীক্ষায় ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে ৩৮.৭২%, ১৭.৬২%, ৩৩.৬৯%, ৩৬.২৭%, ৩৫.৭৯% , ৪১.০২% ও ৩৮.৭৯% প্রজননোত্তর ইলিশ পাওয়া গেছে। যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় আশা ব্যঞ্জকভাবে বেশী ছিল। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ২০১৪ সালে প্রজনন মওসুমে ১১ দিন ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকায় প্রায় ১.৬৩ কোটি ইলিশ আহরণ থেকে রক্ষা পায়। আহরণ রহিত এসব মা ইলিশ থেকে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৫ কেজি ডিম প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত এসব ডিমের ৫০ ভাগ পরিস্ফুটন ধরা হলেও দেশে ২ লাখ ৬১ হাজার ১০ কোটি রেণু উৎপাদিত হয়। যার শতকরা ১০ভাগ বেঁচে থাকলেও ২৬ হাজার ১শ’ কোটি ইলিশ পোনা-জাটকা নতুন ইলিশ প্রজন্মে যুক্ত হয়।
আর এ কারণেই মূল প্রজনন মওসুমের ২২ দিন ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পরেই গত ১ নভেম্বর থেকে পরবর্তী ৭ মাস ইলিশ পোনা জাটকার আহরণ, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ থাকছে। আজ থেকে ইলিশ আহরণ ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও জাটকা আহরণ ও বিপণনে কোন ধরনের আপোষ করা হবে না বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল।
মৎস্য অধিদপ্তরের সুপারিশের আলোকে অন্যান্য বছরের মত এবারও নিম্ন মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেঁতুলিয়া নদীতে মার্চ ও এপ্রিল মাসে এবং পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বর-জানুয়ারী মাসের সময়কালকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখা হবে। এছাড়াও শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকায় মার্চ-এপ্রিল মাসে দেশের ৫ম অভয়াশ্রমে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকবে।
পাশাপাশি বরিশালের হিজলা উপজেলার নাছকাটি পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট, ধুলখোলা পয়েন্ট এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ভাষান চর পয়েন্ট এলাকার মেঘনার শাখা নদী, হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ ও নয়া ভাঙনী নদী এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লতা নদীর ৬০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ ও জাটকার ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেব ঘোষণার সুপারিশ করা হয়েছে মৎস্য বিজ্ঞানীদের তরফ থেকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেষ হয়েছে সাগর-নদীতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ