পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হাজার সুরে, হাজার ভাষায়/এই দুনিয়া ঘেরা/ আর মাতৃভাষা বাংলা আমার/ সকল ভাষার সেরা। কবি ফররুখ আহমদের কবিতার পংক্তিমালার এই আবেগকে বুকে ধারণ করে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে যারা অগ্রণি ভূমিকা রেখেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর তাদের অন্যতম। যে ক’জন সাহসী বীর সন্তান মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদেরই একজন অধ্যাপক অবদুল গফুর। মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র দু’মাস আগে পরীক্ষা বর্জন করে ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। দেশপ্রেম, ভাষাপ্রেমের এমন মহৎ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পার হলেও এই বীর ভাষা সৈনিকের আজও যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। ভাষা সৈনিক হিসাবে জাতির এই সূর্ষ সন্তানের আজও মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
একটি জাতির মূল ভিত্তি হল তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি। আর জাতির এই মূল ভিত গড়ার কারিগর হলেন কিছুসংখ্যক মহৎ ব্যক্তি ও প্রতিভাবান মানুষ। তাঁদের মেধা, মনন, অক্লান্ত শ্রম, ত্যাগ ও অপরিসীম সংগ্রাম-সাধনার বিনিময়ে জাতির বুনিয়াদ গড়ে ওঠে। তারাই জাতির গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতার ধারক-বাহক। দুর্ভাগ্যবশত অনেক সময় আমরা জাতির এসব কৃতি-সন্তানদের যথোচিত সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি না, তাঁদের মূল্যায়ন করি না। অনেকে অবজ্ঞা-অবহেলায় লোকচক্ষুর অন্তরালে অনাদৃত-অবহেলায় জীবনযাপন করেন। এভাবেই একদিন তাঁদের জীবনাবসন ঘটে। অধ্যাপক অব্দুল গফুরও তেমনি একজন মহৎ ব্যাক্তি যিনি অনেক অবজ্ঞা-অবহেলায় অনেকটা অন্তরালে জীবনযাপন করছেন। ৯৪ বছর বয়সের এই ভাষা সৈনিকের মুখের ভাষাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। স্মৃতি এখন তার সাথে প্রতারণা করতে শুরু করেছে। কাউকে হঠাৎ করে চিনতে পারছেন, মুহুর্তেই আবার চিনতে পারছেন না। মুখের কথাও লেগে লেগে আসসে, স্পষ্ট হচ্ছেনা। রোগে-বার্ধক্যে তিনি এখন শয্যাশায়ী। তার ছেলে তারিক আল বান্না জানান, সম্প্রতি ইউরিন ইনফেকশন জনিত জটিলতার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এখন সে জটিলতা কিছুটা কমেছে। বর্তমানে বাসায় আছেন। তবে স্মৃতি শক্তি কমে যাচ্ছে।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুরের জীবনব্যাপী সাধনা ও নিষ্ঠাপূর্ণ অবদান যেমন গৌরবময় তেমনি বিস্ময়কর। ইংরাজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে কৈশোর জীবনেই তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি তার কৃতিত্বপূর্ণ শিক্ষা-জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করেছে যে প্রতিষ্ঠান সেই তমদ্দুন মজলিশের কর্মকান্ডে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আত্মনিবেদিত। আন্দোলন-সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদনাসহ অন্যান্য কাজে তিনি সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। জীবনে তার সাফল্য অনেক। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতা ও জ্ঞান-চর্চায় তিনি অপরিসীম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তাইতো এদেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস-বুদ্ধিজীবি হিসাবে অগ্রসেনানীদের প্রথম কাতারে অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল গফুরের নামও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। সেই ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালারদের একজন অধ্যাপক আব্দুল গফুর। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ এই সৈনিক আজীবন সংগ্রাম, ত্যাগ ও বিসর্জনের মধ্য দিয়ে জীবনাতিপাত করেছেন। কয়েকবার সরকারি চাকরিকে বিসর্জন দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। অধ্যাপক গফুরের মতো ব্যক্তি জাতির বাতিঘর স্বরূপ। তাঁর মেধা, মনন, মহত্ত¡, শ্রম, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, শিক্ষা-আদর্শ, সরল ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ জীবন-যাপন পদ্ধতি নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেম, জাতিগঠন ও উচ্চ মানবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত করে।
কবিতা বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ বলেন, আমাদের ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রসেনানী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর। তিনি শুধু রাজপথে দাবি আদায়ে নয়, বাংলাভাষার উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার জন্য তিনি নিরলসভাবে কলম চালিয়ে গেছেন। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা থাকে সম্মানিত করতে পারিনি। অনেক আগেই তাকে একুশে পদকে ভ’ষিত করা উচিত ছিল। এ বিষয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বিশিষ্ট ভাষা-সৈনিক, প্রবীণ লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক আব্দুল গফুরের জন্ম ১৯২৯ সনের ১৯ ফেব্রæয়ারি (আনুমানিক)। দিনটি ছিল ফাল্গুন ও রমজান মাসের মঙ্গলবার। জন্মস্থান বৃহত্তর ফরিদপুর (বর্তমান রাজবাড়ী) জেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। পিতা ও মাতার নাম যথাক্রমে হাজী হাবিল উদ্দিন মুন্সী ও শুকুরুন্নেছা খাতুন। অধ্যাপক আব্দুল গফুরের শিক্ষা জীবন শুরু হয় পিতার প্রতিষ্ঠিত গ্রামের মক্তবে। এরপর পাবনা জেলার তালিম নগর জুনিয়র মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদ্রাসা থেকে ১৯৪৫ সনে অনুষ্ঠিত হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলা ও আসামের মধ্যে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে সরকারী নজরুল কলেজ) থেকে ঢাকা বোর্ডের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। ছাত্র জীবনেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ফাইনাল অনার্স পরীক্ষার মাত্র দু’মাস আগে ভাষা আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলন সংগঠনকারী প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিসের কাজে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে আত্মনিয়োগ করায় অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এরপর ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ইংরাজি বিভাগে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হন। পরে ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি (সমাজকল্যাণে) এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুরের কর্মজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। জীবনের শেষ পর্যায়েও তিনি সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তবে এর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি দীর্ঘকাল অন্য পেশায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ‘পাক্ষিক জিন্দেগী’তে তার সাংবাদিক জীবনের সূচনা। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর সহ-সম্পাদক ও সম্পাদক, এরপর যথাক্রমে ‘দৈনিক মিল্লাত’ (১৯৫৭) ও ‘দৈনিক নাজাত’ (১৯৫৮)-এর সহকারী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর আদি পূর্বসূরী দারুল উলুম (ইসলামিক একাডেমী)-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট (১৯৫০-৬০) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি এক বছর সমাজ কল্যাণ অফিসার হিসাবে চট্টগ্রামে চাকরী করেন। পরে উক্ত চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ (১৯৬৩-৭০) এবং ঢাকা আবুজর গিফারী কলেজে (১৯৭২-৭৯) সমাজকল্যাণের অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘দৈনিক আজাদ’-এর বার্তা সম্পাদক, ১৯৭২-৭৫ ইংরাজি ‘দৈনিক পিপল’-এর সহকারী সম্পাদক, ১৯৭৯-৮০ ‘দৈনিক দেশ’-এর সহকারী সম্পাদক এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর প্রকাশনা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর সূচনা (১৯৮৬) থেকে অদ্যাবধি এর ফিচার সম্পাদক পদে কর্মরত রয়েছেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর যখন যে পেশায়ই নিয়োজিত থাকুন না কেন, সবসময়ই তিনি লেখালেখির মধ্যে ব্যস্ত জীবন অতিবাহিত করেছেন। তবে তার রচিত অধিকাংশ গ্রন্থই এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ইসলাম, বিপ্লবী ওমর, পাকিস্তানে ইসলামী আন্দোলন, কর্মবীর সোলায়মান, সমাজকল্যাণ পরিক্রমা, কোরআনী সমাজের রূপরেখা, খোদার রাজ্য (শিশুতোষ গ্রন্থ), ইসলাম কি এ যুগে অচল, ইসলামের জীবন দৃষ্টি, রমজানের সাধনা, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, আসমান জমিনের মালিক (শিশুতোষ গ্রন্থ), শাশ্বত নবী, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আমার কালের কথা (আত্মজীবনী গ্রন্থ), স্বাধীনতার গল্প শোনো (শিশুতোষ গ্রন্থ), ভাষা নিয়ে লড়াই (শিশুতোষ গ্রন্থ যন্ত্রস্থ) প্রভৃতি। এছাড়াও ইংরাজি ও বাংলায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইসলাম ও সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে তার আরও প্রায় এক ডজন পান্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এ হান্নান বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর আমাদের চেতনার বাতিঘর। তার মতো মহৎ দেশপ্রেমিকের হাত ধরেই এদেশে কৃষ্টি-সংস্কৃতি তথা রাজনীতি বিকশিত হয়েছে। অথচ জাতির এই কৃতি সন্তানের যথাযথ সম্মান আজও আমরা দিতে পারিনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদকের তিনি অন্যন্য দাবিদার হলেও তা থেকে অদ্যাবধি বঞ্চিত। এম এ হান্নান এই ভাষা সৈনিকের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা ঢাকা কলেজে তার নামে একটা চেয়ার এবং ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি সড়ক নামকরণের মাধ্যমে তাকে সামান্য হলেও সম্মান দেওয়ার দাবি জানান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।