Inqilab Logo

সোমবার ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ কার্তিক ১৪৩১, ০৯ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভুটানের পুলিশ যেন উপকারী বন্ধু

প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইকবাল হাসান নান্টু, থিম্পু থেকে ফিরে : দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ ভুটান। দেশটি ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। ভুটানের উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত।
ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। ভুটান সার্কভুক্ত একটি রাজতন্ত্র রাষ্ট্র। ভুটানের রাজধানী থিম্ফু। ভুটানের আয়তন ৪৬,৫০০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী থিম্পু। ভুটানের অধিবাসীরা ভুটানি নামে পরিচিত। ২০০৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভুটানে ৬,৭২,৪২৫ জনের বসবাস। সম্প্রতি ভুটানের রাজধানী থিম্ফুতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের প্লেঅফ-২। আমারও সুভাগ্য হয়েছিল ম্যাচ কাভার করার। আমরা বাংলাদেশ থেকে ১৪-১৫ জন সংবাদকর্মী ভুটান গিয়েছিলাম এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের প্লেঅফ-২ এর ম্যাচ কাভার করতে।
আমার সহযাত্রী হিসেবে ছিলেন বাসসের রোকন চৌধুরী, ক্রীড়ালোকের সহকারী সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শামীম, নিউ নেশানের মঈন আহমেদ ও কামাল হোসেন বাবলু, বিটিভির মাহবুব, দৈনিক মানবজমিনের স্যামন হোসাইন, দৈনিক নওরোজের গোলাম মোস্তফা, নিউজনেট ২৪ ডটকম-এর কবিরুল ইসলাম, একুশের কণ্ঠের জামির হোসেন জামির প্রমুখ। ভুটানে বাংলাদেশ বনাম ভুটানের ফুটবল ম্যাচ কাভার করতে গিয়ে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। ১০ অক্টোবর ম্যাচের আগের দিন দুপুরে হোটেল আরিয়াতে ছিল দু’দলের সংবাদ সম্মেলন। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সংবাদটি কাভার করার জন্য। বাংলাদেশের সব সংবাদকর্মীর যেহেতু একই হোটেলে অবস্থানের সুযোগ হয়নি, তাই সবাই আলাদা আলাদাভাবে সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন। বিপত্তিটা ঘটে ঠিক এরপরই। আমিসহ মোস্তফা, জামির এবং মঈন সংবাদ সম্মেলনের পর নিজ হোটেলে ফিরে আসি। হোটেলে বসেই আমরা আমাদের দেশের নিজ নিজ অফিসে ছবি পাঠাব। ট্যাক্সি বিদায় করে ক্যামেরা খুঁজতে গিয়ে মঈন দেখেন তার ক্যামেরা ব্যাগ, পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র ট্যাক্সিতেই রয়ে গেছে। বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো এমন অভিজ্ঞতায় মঈন ঠা-ার মধ্যে ঘেমে একাকার। স্ট্যান্ডে গিয়েও সেই ট্যাক্সিড্রাইভারকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ট্রাফিক পুলিশের শরণাপন্ন হলেন। অগত্যা ট্রাফিক পুলিশ স্বান্ত¦না দিয়ে বললেন, যদি ব্যাগটি চালকের হাতে পড়ে, তাহলে ফেরত পাবার সম্ভাবনা বেশি। আর যদি কোনো যাত্রীর হাতে পড়ে তাহলে চান্স ফিফ্টি-ফিফ্টি। সেই ট্রাফিক পুলিশ থানায় কমপ্লেইন করতে বললেন। হোটেলে ফিরে অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে আমি, মঈন ও মোস্তফা রওনা হলাম থানার উদ্দেশ্যে। যে ট্যাক্সিতে করে থানায় যাচ্ছিলাম, সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার জানালেন, ভুটানের নাগরিকরা সৎ। তারা কখনো অন্যায় কাজ করে না। সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার থানায় পৌঁছার পর ভাড়াও নিলেন না। কেন নিলেন না এর জবাবে তিনি বলেন, ভিনদেশী মেহমানদের আপৎকালীন সময় আমরা আন্তরিতকার সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই ও পথহারা পথিককে পথ দেখাতে আমরা ভাড়া নেই না। আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ছোট্ট একটা শহর থিম্পু। সাজানো-গোছানো। এখানকার মানুষগুলো ঠিক তেমনই যেন। ফুলের মতোই তাদের স্বভাব। আমাদের জন্য আরো বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। তারা কমপ্লেইন লিপিবদ্ধ করে বললেন, চলেন আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দেই। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বললেন, সম্ভবত আপনাদের হোটেলের সিসিটিভির ফুটেজে ওই ট্যাক্সির ছবি পাওয়া যাবে। ওই ফুটেজ থেকেই তাকে আমরা পাকড়াও করে ফেলব। কিন্তু ফুটেজ দেখে ট্যাক্সি নাম্বারটা বোঝা গেল না। অবশেষে সেই পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, চলুন আপনাদের কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যাই। এখানকার সিসিটিভি ফুটেজে নিশ্চয়ই নাম্বারটা পাওয়া যাবে। হলোও তাই। নাম্বারটা পাওয়া গেল। সেই নাম্বার থেকেই পুলিশ তখনই বের করে ফেললেন তার মোবাইল নাম্বার ও বাড়ির ঠিাকানা। পুলিশ তাকে মোবাইল করলেন। কিন্তু সেই ফোন ধরলেন তার স্ত্রী। বললেন, তার স্বামী আজ মোবাইল নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছেন। তাকে জানানো হলো, তিনি বাড়ি আসামাত্রই যেন পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ করে। তাকে একটি টেলিফোন নাম্বারও দিয়ে দেয়া হলো। এরপরই পুলিশ আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেয়।’
ঘণ্টাখানেক পরই পুলিশ আসেন আমাদের খোঁজে। পুলিশ এসে বললেন আমাদের সাথে চলুন। আমরা থানায় গিয়ে দেখি আমাদের বহনকারী ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে। এতে আমাদের মনে আশার সঞ্চার হলো। আমরা রীতিমতো অবাক। তখন আমরা থানার ভেতরে গিয়ে দেখি পুলিশ অফিসারের রুমে ট্যাক্সি ড্রাইভার ও পাশে একটি মহিলা। পরে জানতে পারি এ মহিলা ট্যাক্সিড্রাইভারের স্ত্রী। ঘটনার বিবরণে পুলিশের প্রশ্নের জবাবে ট্যাক্সিড্রাইভার বলেন, আমি তো ওনার ব্যাগ দেখিনি। দেখলে আমি হোটেলে দিয়ে আসতাম। পরে পুলিশ ট্যাক্সির পেছনের ব্যাকঢালা খোলে দেখেন পেছনে পড়ে আছে। তখন পুলিশ হারানো মালামাল উদ্ধার করেন এবং আমাদের হাতে তুলে দেন। ব্যাগটি ফেরত পেয়ে মনে হলো আমরা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ব্যাগের চেইন খুলে দেখলাম সবই ঠিক আছে। কোনো কিছুই ওলোট-পালোট হয়নি। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিলাম। পুলিশকেও ধন্যবাদ দিলাম তাদের দক্ষতা দেখে। ভাবলাম আমাদের দেশের পুলিশ যদি এমন হতো!
ভুটানের রাজধানী থিম্পু খুব ছোট্ট শহর। খুবই সুন্দর। পরিপাটি। মনে হবে জীবন্ত এক ছবি। কোথাও ময়লা-আবর্জনা চোখে পড়ল না। সবচেয়ে বড় বিষয় একজন ভিক্ষুক দেখিনি। ভুটানিরা পুলিশকে ভীষণ ভয় পায়। অথচ পুলিশের কাছে কোনো আর্মস নেই। এমনকি লাঠিও নেই। গোটা শহরটাই সিসিটিভির আওতাভুক্ত। জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হওয়া কিংবা ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটা অপরাধের মধ্যে পড়ে। পুলিশ চাইলে আপনাকে জরিমানা করতে পারে। আরো অবাক বিষয় থিম্পুর কোথাও আপনি প্রকাশ্যে সিগারেট খেতে পারবেন না।
এতসব দেখার পর মনে হলো আমরা অনেক পেছনে পড়ে আছি। থিম্পুবাসীর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভুটানের পুলিশ যেন উপকারী বন্ধু
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ