Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চল্লিশ বছর পরে সংগ্রহ করা দুটি যাত্রীবাহী নৌযান বিআইডব্লিউটিসির গলার কাঁটা

প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : রাষ্ট্রীয় জাহাজ চলাচল প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসি অর্ধ-শতাধিক কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি যাত্রীবাহী নৌযান সংগ্রহ করে লোকসানের বোঝা ক্রমশ ভারী করলেও তা থেকে উত্তরণে দায়িত্বশীল মহলে তেমন কোন হেলদোল নেই। এমনকি এসব নৌযানের ‘পরিচালন লোকসান’ কমাতে অপেক্ষাকৃত কম লোকশানী নৌপথে পরিচালনারও কোন উদ্যোগ নেই। প্রায় ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সংগৃহীত এমভি বাঙালী ও এমভি মধুমতি নামের এসব নৌযানে যাত্রীদের ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্য আনতেও বাস্তব কোন কর্মসূচি নেই। এর মধ্যে এমভি বঙালী নামের নৌযানটির কিছু সংস্কারসহ যাত্রী সুবিধাসমূহ বৃদ্ধির (?) লক্ষ্যে গত ২৯ অক্টোবর থেকে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্সে রয়েছে। নৌযানটি ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বিআইডব্লিউটিসির কাছে হস্তান্তরের কথা থাকলেও আরো একমাসের সময় বৃদ্ধি করে গত ৩১ জানুয়ারীর মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করার ওয়াদা করা হলেও চলতি ফেব্রুয়ারী মাসেও তা সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে সংস্থার চেয়ারম্যান ও পরিচালক (কারিগরি)সহ প্রকল্প পরিচালক কয়েক দফায় চট্টগ্রামে ডকইয়ার্ডে নৌযানটি পরিদর্শনও করেছেন।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীতে কিছু পরিত্যক্ত ও আধা-সরকারী নৌ-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে রাষ্ট্রীয় জাহাজ চলাচল প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসি গঠনের প্রায় ৪০ বছর পরে ২০১২ সালে সংস্থাটি দুটি নতুন যাত্রীবাহী নৌযান সংগ্রহে চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স-এর সাথে এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতি নামের দুটি নৌযান নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে চুক্তির নির্ধারিত সময়ের প্রায় চারমাস পরে ২০১৪-এর মার্চে এমভি বাঙালী ও দেড় বছর পরে এমভি মধুমতি জাহাজটি গতবছর মে মাসের শেষভাগে বিআইব্লিউটিসি’র কাছে হস্তান্তর করে ওয়েস্টার্ন মেরিন। ২০১৪-এর ২৯ মার্চ এমভি বাঙালী ও গত বছর ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব নৌযানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেন।
কিন্তু ২০১৪Ñএর ১০ এপ্রিল এমভি বাঙালী বাণিজ্যিক পরিচালনে যাত্রী পরিবহন শুরু করার পরেই এতে নানান অসংগতি ধরা পরে। নৌযানটিকে যাত্রীবান্ধব করে তৈরি করতে পারেনি বিআইব্লিউটসি। এমনকি পুরো নৌযানটিকে একটি ‘গুদামঘর’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। উপরন্তু নৌযানটির পরিচালন ত্রুটির কারণে এর প্রপেলার তিন দফায় খুলে নদীতে পড়ে গেছে। রাডার-সুকানও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তৃতীয় তলার কথিত প্রথম শ্রেণীর কক্ষগুলো যাত্রী ভ্রমণ উপযোগী ছিল না।
এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করাসহ কিছু যাত্রী সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করে বিআইডব্লিউটিসি। কিন্তু ২৬.৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এমভি বাঙালীর এসব সংস্কার কাজের জন্য নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি আরো ২.২২ কোটি টাকা দাবি করেছে। বিআইডব্লিউটিসি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়র অনুমোদন নিয়ে এ বাড়তি খরচ করে নৌযানটি সংস্কার সহ কিছুটা যাত্রীবান্ধব করতে সম্মতি দিলেও গত সাড়ে ৩ মাসেও সে কাজ সম্পন্ন হয়নি। উপরন্তু নৌযানটি গত বছর ২৯ নভেম্বর ডকিং করার পরে এখনো এর তলা বা খোলর কাজ সম্পন্ন করাসহ রং-এর কাজটিও হয়নি। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি এখন পুরো নৌযানটি রং করার জন্য বাড়তি অর্থ দাবি করছে।
গত বৃহস্পতিবার সংস্থার চেয়ারম্যামন ও পরিচালক সরেজমিন এমভি বাঙালী পরিদর্শন করলেও নৌযানটি রং করার বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি এখনো। তবে ওয়েস্টার্ন মেরিন চলতি মাসের মধ্যে তলার অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে এমভি বাঙালীকে কর্ণফুলী নদীতে ভাসানের কথা জানিয়েছেন। মার্চের প্রথমভাগেই তারা নৌযানটি বিআইডব্লিউটিসির কাছে হস্তান্তরে আশাবাদী বলে গতকাল প্রতিষ্ঠনটির দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হয়েছে। তবে ১৫ মার্চের পরে নৌযানটি কর্ণফুলী হয়ে ভাটি মেঘনার সাগর মুখ অতিক্রম করতে না পারলে তা বরিশাল বা ঢাকাতে পৌঁছান অসম্ভব হয় পড়তে পারে। ১৫ মার্চ থেকে ঐ নৌপথটি ডেঞ্জার জোন হিসেবে চিহ্নিত সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের কাছে। ফলে সে সময়কালে অভ্যন্তরীণ রুটের কোন নৌযান ঐ নৌপথ অতিক্রমে বিধি-নিষেধ থাকবে। ফলে ১৫ মার্চের মধ্যে বাঙালীকে ঢাকা বা বরিশালে ফিরিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই।
তবে এসব সংস্কারের পরেও এমভি বাঙালী বা এমভি মধুমতি যাত্রী পরিবহন করে লোকসান এড়াতে পারছে না। মাত্র ২৪৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে সাড়ে ৭শ’ যাত্রী বহনক্ষম এসব নৌযানে ঘণ্টায় ২শ’ লিটার জ্বালানি প্রয়োজন। কিন্তু ধারন ক্ষমতার পূর্ণ যাত্রী নিয়ে চললেও নৌযান দুটি পরিচালন মুনফাও অর্জন করতে পারবে না বলে মনে করছেন বিআইডব্লিউটিসিরই দায়িত্বশীল মহল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহলটির মতে এসব নৌযানের হাল ও খোলের নকশার কারণে অনেক শক্তিশালী ইঞ্জিন সংযোজন করায় জ্বালানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে যাত্রীভাড়া দ্বিগুণ করা হলেও এসব নৌযানের লোকসান এড়ানো যাবে না। এছাড়া বেসরকারী নৌযানের চেয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র যাত্রী ভাড়া বেশি হবার কারণে ইতোমধ্যেই সংস্থার আয়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বেসরকারী নৌযানসমুহ যেখানে ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঢাকাÑবরিশাল নৌপথে চলাচল করছে, সেখানে বিআইডব্লিউটিসির নৌযানে ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রীও ভ্রমণ করে না। ভাড়া বেশি হবার পাশাপাশি এসব নৌযানের সময়সূচিও যাত্রীবান্ধব নয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপরন্তু এমভি বাঙালী ও এমভি মধুমতি’র মত মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয়ের নৌযান তার নির্ধারিত রুটের পরিবর্তে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত অধিক দূরত্বে অল্পসংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল করায় লোকসানের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি ট্রিপে এসব নৌযানের লোকসান ৩ লক্ষাধিক টাকা বলে জানা গেছে। অথচ নৌযান দুটি যদি বেসরকারী নৌযানের সাথে প্রতিযোগিতা করে শুধুমাত্র ঢাকাÑবরিশাল নৌপথে যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী উভয়প্রান্ত থেকে রাত ৯টায় ছাড়া হয়, তাহলে লোকসান অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে অনা সম্ভব বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহালমহল। তবে প্রায় ৫৬ কোটি টাকার এসব ‘স্বেতহস্তী’ যাত্রী পরিবহনে না দিয়ে ঘাটে বেঁধে রাখলেই লোকশানের কোন ঝুঁকি নেই বলে দাবি দুষ্ট লোকদের।
এসব ব্যাপারে নৌযান দুটিার প্রকল্প পরিচালক জানান, আমরা চেষ্টা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এমভি বাঙালীকে বাণিজ্যিক পরিচালনে ফিরিয়ে দিতে। তবে নৌযান দুটির অত্যধিক জ্ব্ালানি ব্যয় সম্পর্কে তিনি কোন মন্তব্য করেন নি। পরিচালক (কারিগরি) ‘নৌযান দুটির নকশা যথাযথভাবে হয়নি বলেই বড় মাপের ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়েছে’ এমন দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ না করলেও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। জিএম-বাণিজ্য জানান, লোকসান এড়িয়ে নৌযাগুলো চালানোর পথ খোঁজা হচ্ছে ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চল্লিশ বছর পরে সংগ্রহ করা দুটি যাত্রীবাহী নৌযান বিআইডব্লিউটিসির গলার কাঁটা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ