Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইরাকে পুনরায় ঐক্যের সম্ভাবনা তালগোল পাকিয়ে গেছে

প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : এক মাসেরও বেশি সময় আগে ইরাকি স্থল বাহিনী ও মার্কিন জঙ্গি বিমান যখন রামাদিতে হামলা শুরু করে সে সময় বহু মাস ধরে আটকাপড়া আরো বহু সুন্নী আরব পরিবারের মত গুসুন মোহাম্মদ ও তার পরিবার সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পালিয়ে আসেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইরাকি সৈন্যরা তাকে ও তার ছেলেমেয়েদের একটি আটক কেন্দ্রে ও তার স্বামীকে আরেকটি আটক কেন্দ্রে পাঠায়। তারপর থেকে স্বামীর সাথে তার দেখা বা কথা হয়নি। তাকে ও তার ছেলেমেয়েদের আনবার প্রদেশে এখন একটি জরাজীর্ণ তাঁবুর শিবিরে আটক রাখা হয়েছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত রামাদিতে খুব সম্ভবত আগামী আরো কয়েক মাস তারা ফিরতে পারবেন না। তিনি এখন মরিয়া ও বেপরোয়া। ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, কারাগারে আটক নিরপরাধ লোকদের মুক্তি দেয়া দরকার।
তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক মহিলা করিমা নূরী বলেন, তার অটো মেকানিক ছেলেকেও ইরাকি কর্তৃপক্ষ ধরে নিয়ে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি তার কোনো খবর পাননি। তিনি বলেন, ইরাক সরকার রামাদির লোকদের ইসলামিক স্টেটের (আই এস) প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করে। করিমা বলেন, আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমরা ভীষণ দরিদ্র।
আনবার প্রদেশের রাজধানী রামাদি পুনদর্খল ইরাক সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। আইএসের কাছ থেকে আনবার প্রদেশ ও অন্যান্য স্থান পুনর্দখলে এটি হচ্ছে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে আনবার বিজয়ে ইরাক সরকারের সামরিক লক্ষ্য অর্জিত হলেও গুসুন ও করিমার মত সুন্নী পরিবারগুলো বাগদাদের শিয়া প্রধান সরকারের প্রতি তাদের ভীতি ও অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। তারা বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্য এখনো অর্জিত না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। দু’বছর আগে আইএস যখন ইরাকের সুন্নী এলাকাগুলো দখল করতে শুরু করে তখন যারা তাদের সমর্থন করেছিল, তাদের সবাই একই দুর্দশার শিকার।
আনবারের সামরিক অভিযানের লক্ষ্য আইএস নিয়ন্ত্রিত ফোরাত নদী তীরবর্তী শহর হিত-এর দিকে নিবদ্ধ হলে সমালোচকরা বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির সমর্থন ছাড়া ইরাক বিষয়ে শুধু সামরিক লক্ষ্য অর্জনের আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গি অদূরদর্শী। একই সাথে আইএসের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিজয়ের ফলে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে যা ইরাক ও অন্যান্য দেশ মোকাবেলা করতে হিমসিম খাচ্ছে। এটা সিরিয়া বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত মনে হয় যেখানে ওবামা প্রশাসন বলে আসছে যে সিরিয়া সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই, তাই তারা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইরাকে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ^বিদ্যালয়ের জর্জ বুশ স্কুল অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক সার্ভিসের ডিন রায়ান সি. ক্রোকার বলেন, এখানে কোনো রাজনৈতিক পদ্ধতি নেই যা ৩ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো সুন্নীকে ইরাক রাষ্ট্রে তাদের ভবিষ্যত আছে বলে বিশ^াস করাতে পারবে।
তিনি বলেন, প্রশাসন একটি প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে সীমিত সামরিক অস্ত্র ব্যবহারের চেষ্টা করছে যা শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে এবং আমরা এ চেষ্টা চালাতে ইচ্ছুক বা সক্ষম নই।
রাজনৈতিক সমঝোতা ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত সুন্নী এলকাগুলো পুননির্মাণের উচ্চাকাক্সক্ষী কর্মসূচি গ্রহণ অথবা ন্যূনতম বিদ্যুৎ ও পানির মত প্রধান সেবা পুনরুদ্ধার না করা হলে সে সব এলাকা ভবিষ্যতেও আইএসের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবেই রয়ে যেতে পারে।
ওয়াশিংটনে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনে ইরাক বিশেষজ্ঞ কেনেথ এম. পোলাক উদ্বিগ্ন যে রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া ইরাকে সামরিক সামরিক অর্জন উল্টো ফল দেবে। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে তা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাবে।
ইরাকের এক তৃতীয়াংশ এলাকা সম্বলিত আনবার প্রদেশের বিরাট এলাকাজুড়ে রয়েছে মরুভূমি। এখানেই আইএস আত্মপ্রকাশ করেছিল। আমেরিকার বিরুদ্ধে এ আনবারেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল আল কায়েদা যা দমন করতে ১৩শ’ আমেরিকান সৈন্য ও মেরিন নিহত হয়, শত শত কোটি ডলার ব্যয় হয় সহায়তা ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে যার নাম দেয়া হয় সুন্নী জাগরণ। এ কর্মসূচিতে সুন্নী উপজাতীয় নেতারা অর্থের লোভে ঘুরে দাঁড়ায় ও আল কায়েদার পক্ষ ত্যাগ করে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে।
আমেরিকানরা ইরাক ত্যাগ করার পর প্রধানমন্ত্রী নূরী আল মালিকির গোষ্ঠিনীতির বিরুদ্ধে জবাব দিতে গ্রুপটি ইসলামিক স্টেট নামে পুনরাবির্ভূত হয় এবং শক্তি সঞ্চয় করে। মালিকি সুন্নী জাগরণ গ্রুপগুলোকে নিরাপত্তা বাহিনীর অঙ্গীভূত করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।
আমিরিয়াত ফাল্লুজা মেয়র শেখ ফয়সল এসাবি বলেন, দায়েশ (আইএস) চাঁদ থেকে আসেনি। তারা মাটি থেকে জন্ম নেয়নি। আমাদেরই কিছু লোক দায়েশ হয়েছে। দুর্নীতি, অবিচার, ঘৃণার সংস্কৃতি থেকে আইএসের জন্ম হয়েছে।
লাখ লাখ লোকের শহর রামাদি ইসলামিক স্টেট মুক্ত, তবে এটি ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষজন যাতে ঘরে ফিরতে পারে সে জন্য বিভিন্ন সেবা পুনরায় চালু করতে প্রাথমিকভাবে ১ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ অর্থ জেনারেটর ক্রয় ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য ক্লিনিকের জন্য দেয়া হবে।
প্রাদেশিক গভর্নর সোহাইব আল রাবি জানান, তেলের মূল্য পতনের কারণে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন ইরাক সরকার আনবারের পুনর্নির্মাণ ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে সামান্যই করতে পারবে।
ইরাকে জাতিসংঘের সমন্বয়কারী লাইস গ্রান্ডে বলেন, আইএস রামাদিতে যেভাবে বিস্ফোরক পেতে রেখে গেছে এবং তা যে গতিতে পরিষ্কারের কাজ চলছে তাতে বেসামরিক লোকজনের ফিরতে নয় মাস লেগে যাবে। এর বাইরে ধ্বংস প্রাপ্ত বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের ব্যাপার তো আছেই।
গ্রান্ডে বলেন, ইরাকের অন্যান্য স্থানে মত রামাদিতেও ধ্বংসের মাত্রা প্রচ-। তিনি রামাদিতে ন্যূনতম মৌলিক সেবা চালু জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
আনবার পুলিশ দফতরের বোমা অপসারণকারী ক্রুদের নেতৃত্বদানকারী কর্নেল হামিদ আল জানাবি বলেন, তিনি যে ৪০ জন অফিসারের নেতৃত্ব দিতেন তাদের অর্ধেকই মারা গেছেন। তারা সবাই আগের বছরগুলোতে বোমা অপসারণে মার্কিন প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। অল্প কিছু বোমা অপসারণ বিশেষজ্ঞ ও অর্থ ছাড়া এখন তিনি কাজ করছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় লোকদের মধ্যে এ কাজে যাদের কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে ভবিষ্যতে টাকা দেয়ার আশ^াস দিয়ে তিনি কাজ করতে বলেছেন।
যতই সময় যাচ্ছে কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন যে এখানকার মহাসড়কের বাঁকসংলগ্ন তাঁবু শিবির, মসজিদ ও বাগদাদের ঘনবসতিগুলো যেখানে আনবারের বেসামরিক লোকরা থাকে এগুলোর সবই আগামী প্রজন্মের জঙ্গিদের লালনক্ষেত্র হতে চলেছে।
গভর্নর রাবি বলেন, ফাল্লুজা বড় রকমের মানবিক সংকটের সম্মুখীন। তিনি বলেন, কমপক্ষে ১০ জন লোক মারা গেছে। ওষধ নেই।
আইএস রামাদির হাজার হাজার লোককে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে যে তারা পালাতে চেষ্টা করলে সরকার তাদেরকে আটক করবে।
উম্ম মোহাম্মদ নাম্নী রামাদির এক মহিলা টেলিফোনে বলেন, বিশে^র সকল সৎলোকের জন্য এ বার্তা যে আমরা আইএসের অবিচার এবং সরকার কর্তৃক অজানা ভবিষ্যতের যারা আমাদের আইএসের সমর্থক বলে অভিযুক্ত করে।
যুক্তরাষ্ট্র সুন্নীদের প্রতি রাজনৈতিক ছাড় দেয়ার জন্য এবাদি সরকারের উপ চাপ সৃষ্টি করেছে। যেমন নিরাপত্তা বাহিনীতে অধিক সংখ্যক সুন্নীকে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যাশনাল গার্ড গঠন করা ও জেলখানাগুলোকে আটক সুন্নী-মুক্ত করতে ফৌজদারি বিচার সংস্কার। তবে এখন পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সামান্যই।
এসাবি বলেন, এবাদির ইচ্ছে আছে, কিন্তু তিনি কোনো সংস্কার করেননি। সত্যি বলতে কি, তার কোনো ক্ষমতা নেই।
এটা এ কারণে যে ইরাকের ক্ষমতার বেশির ভাগই আঞ্চলিক শক্তি ইরানের হাতে। তাদের নিয়ন্ত্রিত ইরাকি শিয়া মিলিশিয়াদেরই সমাজের আসল রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখা হয়। তারা ও তাদের মিত্র রাজনীতিকরা সুন্নীদের অন্তুর্ভুক্ত করার এবাদি উদ্যোগের বিরোধিতা করছে।
ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তির পর আশা করা হচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই ও ইরাক সরকারকে সমর্থনের ক্ষেত্রে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। কিন্তু তা হয়নি। বাগদাদে আমেরিকান কূটনীতিকদের তাদের ইরানি প্রতিপক্ষের সাথে সাক্ষাতে উদ্যোগ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রোকার বলেন, ইরাকের উপদলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সহাবস্থানের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র আরো নিবিড়ভাবে কাজ করবে এমন আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ক্ষমতা শূন্যতার কারণেই আইএসের উত্থান ঘটেছিল। সামরিক সাফল্য নয়, একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই তারা শক্তি লাভ করেছিল। সূত্র নিউইয়র্ক টাইমস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইরাকে পুনরায় ঐক্যের সম্ভাবনা তালগোল পাকিয়ে গেছে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ