ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো. এনামুল হক খান
এককালে গ্রামে শিক্ষার হার খুবই কম ছিল। ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, মানুষের সচেতনতার অভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। নারীদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞানহীন। পুরুষদের অক্ষরজ্ঞান নারীদের তুলনায় বেশি ছিল। তবে গ্রামে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রামে এলাকাভিত্তিক নাটক, যাত্রানুষ্ঠান, পালা গান, জারি-সারি গানের আয়োজন হতো। কিছু পরিবারের পক্ষ থেকে সঙ্গীত ও সংস্কৃতি শিক্ষায় উৎসাহের ব্যবস্থা ছিল বলেই আব্দুল আলীম, আব্বাস উদ্দিন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, অভিনেতা রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেনের মতো উঁচুমানের আরো অনেক শিল্পী আমরা পেয়েছিলাম। আগে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে সম্পৃক্ত হতো, বিনোদনে অংশ নিত। আজ গ্রামে শিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু সংস্কৃতি গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে এখন নাটক-যাত্রা, গান-বাজনা, পালা গান, জারি গানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া গ্রামে খেলাধুলার জন্য যে মাঠগুলো ছিল তার অধিকাংশই ইতোমধ্যে বেহাত হয়েছে। সন্তানরা খেলার মাঠ খুঁজে পায় না। আগে গ্রামের মানুষ ফুটবল, গোল্লাছুট, দারিয়াবান্দা, হাডুডু, কানামাছি, লাটিম খেলাসহ আরো অনেক খেলায় অংশ নিত। গ্রামের শিশুরা আজ খেলার জায়গার অভাবে এসব খেলা ভুলতে বসেছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়।
আগে গ্রামের মানুষের শিক্ষা কম ছিল বলে মুরব্বিরা মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে ছেলের বাবার খড়ের পালার সাইজ দেখত, হালের বলদ কয় জোড়া তা দেখত। বর ভালো চাষাবাদ করতে পারে কিনা খোঁজখবর নিত। আজ লেখাপড়ায় এগিয়েছে বলে পাত্র-পাত্রীর লেখাপড়া কতটুকু তা খোঁজে। চাকরির অবস্থা বা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় ভালোভাবে জেনে বিয়েতে আগায়। ইদানীং প্রায় প্রতিটি গ্রামে কিছু পরিবার বাড়িতে ইমারত গড়ছে, গ্রামের দরিদ্র মানুষও স্বাবলম্বী হচ্ছে। একসময় গ্রামে অধিকাংশ মানুষের ছিল ছনের ঘর, অল্পসংখ্যকের ছিল টিনের ঘর, আর ধনীদের বাড়িতে ছিল ইমারত। লেখাপড়া, চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে মানুষের আয় বাড়ছে। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও লেখাপড়া শিখছে। লেখাপড়ার কারণে মানুষের চিন্তা-চেতনারও পরিবর্তন হচ্ছে। একসময় মানুষের নাম রাখা হতোÑ লাল মিয়া, নীল মিয়া, সবুজ মিয়া, সুরুজ মিয়া, তারা মিয়া, হক্কা মিয়া, ছক্কু মিয়া, ঝাড়– মিয়া, কামলা ইত্যাদি। এখন আর এই রকম নাম রাখা হয় না। এই পরিবর্তন লেখাপড়ার কারণে।
তবে আগের মানুষ ছিল খুবই বন্ধুবৎসল। আত্মীয়-পরিজনদের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও ঈদ আনন্দে দাওয়াত দেয়ার রীতি প্রচলন ছিল। এটা গ্রামের সংস্কৃতির অঙ্গ। তখন আত্মীয়দের জন্য রাত জেগে বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরি করত মেয়েরা। কুলী পিঠা, পাক্কন পিঠা, ফুল পিঠা আরো কত রকমের পিঠা। বিবাহের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য বড় অনুষ্ঠানেও পিঠার ব্যবস্থা থাকত। এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। আগে গ্রামের মানুষ ছিল সহজ-সরল প্রকৃতির, এখনও তেমনই আছে। বাঙালি এখনো গ্রামের খুঁটিনাটি বিবাদ-বিসংবাদ সালিশের মধ্যেমে সেরে নিতে চেষ্টা করে। তারা দেশকে ভালোবাসে, কোন বিষয় সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিলে সেভাবে করতে যায়। তাই তো গ্রামের মানুষের দলবেঁধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল গর্ব করার মতো ঘটনা। তারা সামাজিক কাজকর্মে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নেয়। একে অপরের ব্যথায় ব্যথিত হয়। ভাগ-বাটোয়ারায় তাদের জমি কমেছে বটে কিন্তু আন্তরিকতা কমেনি। মনের ইচ্ছা-অভিব্যক্তি কমেনি। তারা সুযোগ পেলে নাটক, পালা গান, সঙ্গীত চর্চায় অংশ নিতে চায়। তাই তাদের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকা- যেমন : নাটক, নাচ-গান, আবৃত্তিসহ অন্যান্য এবং খেলাধুলার সার্বিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।
এ কথা নিশ্চিত যে, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষা ও সংস্কৃতি উভয়কেই প্রাধান্য দিতে হবে। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোথায়ও অবকাঠামোগত সমস্যা বিদ্যমান। কিছু ইমারতের অনেক স্থানে উপর থেকে পানি পড়ে, ছাদের আস্তর খসে পড়ছে, দরজা-জানালা ভাঙা লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া স্কুলে যাতায়াতে রাস্তার সমস্যা, পয়ঃপ্রণালী, বিদ্যুৎ ইত্যাদির বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। সরকার ইতোমধ্যে ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে বই প্রদান, বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। সরকারি স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করেছে। এতে ছাত্রছাত্রীদের মনে লেখাপড়ায় আগ্রহ বেড়েছে, তারা এখন দলবেঁধে স্কুলে যায়। গ্রামের সকল স্কুলে খেলার মাঠ, সীমানা দেয়াল, বিশুদ্ধ পানি ও সংস্কৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। গান শেখা, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি করা, কোন অনুষ্ঠান হলে কোরআন তেলাওয়াত কীভাবে করতে হয় তা শেখানো জরুরি। দেশের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে হলে শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রামে সংস্কৃতি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।
আর দরকার গ্রামের জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা। কারণ প্রযুক্তি করেছে সভ্যতার পরিবর্তন। যেমনÑ পালকি, ঢেঁকি, কুপি এমন অনেক কিছু আমাদের মধ্য থেকে বিদায় নিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি এর স্থান দখল করেছে। উন্নত প্রযুক্তির সাথে আমাদের সন্তানরা যত বেশি সম্পৃক্ত হবে ততই দেশের মঙ্গল। তাই শিক্ষার অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া জরুরি। দেশে বিপুল কারিগরি কর্মী সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বল্প শিক্ষিতদের হাতেকলমে কাজ শেখানো প্রয়োজন। এতে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে। বিদেশে গিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। রডমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার, বিদ্যুৎ মিস্ত্রিদের দেশ-বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশের সন্তানরা এই শিক্ষার ফলে প্রচুর আয় করবে। আর মেধাবী সন্তানরা যাতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইত্যাদি হতে পারে সে জন্য তাদের প্রতি নিচের ক্লাস থেকে পড়াশোনার নজর রাখা দরকার, দরকারি বই-খাতাপত্র সংগ্রহ, কোনো বিষয়ে দুর্বল থাকলে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা দরকার। উৎসাহ দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ দরকার। এ বিষয়ে শিক্ষক, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটি ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি সকলের সজাগ দৃষ্টি প্রয়োজন।
এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, দেশের কৃষক শ্রেণি যদি শিক্ষিত হয়, ফসল উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। অনুরূপভাবে জেলে, তাঁতি, কাঠমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রি, প্লাম্বার, প্রযুক্তিকর্মীসহ অন্যান্যদের শিক্ষা ও দেশীয় সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত করা জরুরি। এটা দেশের জন্য কল্যাণকর হবে, আর তাদের মনকে উৎফুল্ল রাখতে বিগত ধরাবাহিকতায় গ্রামে সংস্কৃতি চর্চা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এতে দেশে শিক্ষিতের হার বাড়বে, প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়বে, সাংস্কৃতিক অঙ্গন সমৃদ্ধশালী হবে, বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব হবে, মুক্ত চিন্তার মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
লেখক : প্রকৌশলী, বিশিষ্ট সংগঠক ও লেখক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।