পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মেহেদী হাসান পলাশ : জাতীয় সংসদের বিগত অধিবেশনে পাস হওয়া পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধনীকে বৈষম্যমূলক ও বাঙালি বিদ্বেষী বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞ ও পার্বত্য বাঙালি নেতৃবৃন্দ। পার্বত্য বাঙালিরা একে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি বিতাড়নের হাতিয়ার বলে আখ্যা দিয়ে এ আইনের বিরুদ্ধে হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে গত ৩ মাস ধরে।
বাঙালিদের অভিযোগ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে বাঙালি, পাহাড়ি, সরকারিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় সব জমি আওতাভুক্ত করা হয়েছে। অথচ বিচারক হিসেবে ৫ জনের ৩ জনই উপজাতি এবং ২ জন সরকারি প্রতিনিধি রাখলেও পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। অন্যদিকে ২০০১ সালের আইনে মতবিরোধের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলা হলেও ২০১৬ সালের সংশোধনীতে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতীয় বিচারক প্যানেলে চেয়ারম্যান ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছেন।
তাছাড়া এই আইনের বিভিন্ন ছত্রে এমন কিছু শব্দ বা শর্ত যুক্ত করা হয়েছে যা চরমভাবে বাঙালিদের স্বার্থ পরিপন্থীÑ তাই তারা এই আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন সামরিক দায়িত্বের অভিজ্ঞতালব্ধ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহীম বীরপ্রতীক এ প্রসঙ্গে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন যাবৎ বিরাজমান যে সমস্যা, তার অনেকগুলো আঙ্গিক আছে। একটি আঙ্গিক হলো ভূমি। অর্থাৎ ভূমির মালিকানা, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ভূমিব্যবস্থাপনা, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ভূমির ব্যবহার ইত্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন যাবৎ একটি অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব বিরাজমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা বলতে চেষ্টা করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল প্রকার ভূমির একচ্ছত্র মালিক হচ্ছে পাহাড়ি জনগণ। অপরপক্ষে বাংলাদেশ সরকার এবং সচেতন বাংলাদেশীরা মনে করেন যে, ভূমির মালিক পাহাড়ি জনগণ, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের আইন মোতাবেক মালিকানাপ্রাপ্ত অন্য সব নাগরিক। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন পক্ষের ব্যক্তিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ বিরাজমান। এরূপ দ্বন্দ্ব বা বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারি ব্যবস্থা কাম্য।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনটি যেই অক্ষরে এবং যেই স্পিরিটে বা চেতনায় আছে, আমি মনে করি তার অন্তর্নিহিত বা গোপন লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে বাঙালিদের ভূমিহীন করা; বিশেষত ঐ সব বাঙালি, যারা ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সালে সেখানে বসতি করেছিলেন। যদি ঐ বাঙালিরা ভূমিহীন হয়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপে তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করার কাজটি বিতাড়নকারীদের জন্য অত্যন্ত সহজ হয়ে যাবে। বাঙালিদের বিতাড়ন করা হলে, সেটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হবে। এ ছাড়া সরকারি মালিকানাধীন বা সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে এমন জায়গা-জমির মালিকানাও হুমকির মুখে পড়ার বৃহৎ সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি। যদি এ মুহূর্তে বিদ্যমান অক্ষরের ও চেতনার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন বাস্তবায়ন হতেই থাকে।
জেনারেল ইব্রাহীম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। বর্তমানে তারা প্রকাশ্যে স্বায়ত্তশাসিত জুম্মল্যান্ড প্রদেশের জন্য সশস্ত্র ও নিরস্ত্র আন্দোলন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিরা চলে এলে সেখানকার জনভারসাম্য বিনষ্ট হবে। ফলে সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা আরো জোরদার হয়ে পড়বে।
তাই ভূমিসংক্রান্ত আইন বিশারদরা এবং সচেতন নাগরিকদের প্রতি আমার আবেদন, তারা যেন সংবিধানসম্মত বা আইনানুগ পদ্ধতিতে সরকারের ওপর নেতিক চাপ প্রয়োগ করেন; আইনটিকে বাস্তবসম্মতভাবে সংশোধন করার জন্য।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ২ জুন স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির ঘ খ-ের ৪, ৫ ও ৬ ধারা মোতাবেক ২০০১ সালের ১৭ জুলাই জাতীয় সংসদে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাস হয়। এরপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই মন্ত্রিসভায় এই আইনের সংশোধনী গেজেট আকারে পাস হয়ে গত ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস হয়। নতুন আইন অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এই কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ বা তার মনোনীত প্রতিনিধি, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান বা তার প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার/অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। এতে সার্কেল চিফ বা তার প্রতিনিধি, আঞ্চলিক পরিষদ বা তার প্রতিনিধি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা উপজাতীয় সদস্য হবে। চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিব সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বাঙালি বা পাহাড়ি যে কেউ হতে পারে। কিন্তু পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি সেখানে রাখা হয়নি। এছাড়াও কমিশনের বিচারিক আইনে উপজাতীয়দের সামাজিক আইন প্রথা, রীতি ও পদ্ধতিকে নির্ধারণ করায় তা বাঙালিদের বিরুদ্ধে যাবে। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বিশেষ করে পুনর্বাসিত বাঙালিদের সরকার খাস জমিতে পুনর্বাসন করায় সেখানে উপজাতীয় সামাজিক আইন গণ্য করা হয়নি।
এখানে উল্লেখ্য, উপজাতীয়দের সামাজিক আইনের কোনো লিখিত রূপ নেই। ফলে সমাজ ও গোত্রভেদে তাতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এতে করে বাঙালিদের পক্ষে এই কমিশনে সঠিক বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে তাদের দাবি। অন্যদিকে কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ না থাকায় বাঙালিরা কমিশনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশঙ্কা করছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক এমপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভুঁইয়া ইনকিলাবকে বলেন, আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে এই আইনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি বিতাড়ন করার চেষ্টা চলছে। সরকারের ভূমি বরাদ্দের একটি সাংবিধানিক নিয়ম আছে, কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর প্রথাগত নিয়মকে এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাহাড়িদের প্রথাগত এই ধারণাটি অত্যন্ত অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট এবং আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে ভিত্তিহীন। তাই এ ধারণা কখনো কোনো রাষ্ট্রীয় বিচারিক আইন হিসেবে বিচার্য হতে পারে না। কেননা, কিরূপে পাহাড়িরা তা বাস্তবায়ন করবে তা নির্দিষ্ট নয়। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে উপজাতীয় প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক আক্রোশে দুর্বলদের ভূমি কেড়ে নেবে। শুধু বাঙালি নয়, সংখ্যালঘিষ্ঠ উপজাতীয়রাও এই আক্রোশের শিকার হয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়বে।
পার্বত্য বাঙালি অধিকার আন্দোলনকারী সংগঠন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন ভুঁইয়া ইনকিলাবকে বলেন, সংশোধিত ভূমি কমিশন আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি বিতাড়নের হাতিয়ার। এটি বৈষম্যমূলক ও বাঙালি বিদ্বেষপ্রসূত একটি আইন। এখানে বিচারক হিসেবে যারা অংশ নিচ্ছেন তারা কেউ নির্বাচিত বা সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণকারী নয়। ফলে তাদের কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। ফলে এ কমিশন একটি স্বেচ্ছাচারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি ইনকিলাবকে বলেন, এই আইনে বাঙালি-পাহাড়ি বিচার করা হয়নি। যাকে বিচারপতি করা হয়েছে, তিনি একজন আইনের মানুষ। সকলেই এখানে অভিযোগ করতে পারবে। তথ্য-উপাত্ত বাছাই, বিচার-বিশ্লেষণ করে যার পক্ষে যাবে তিনি জমি পাবেন। শান্তিচুক্তি হওয়ার আগেও এভাবে অনেক কথা বলা হয়েছে যে, দেশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে। কিন্তু তা কি হয়েছে। কাজ শুরু হোক, দেখুক কোনো ভুল হলে তখন বলবে। কাজ শুরু করার আগেই বিচার-বিবেচনা ছাড়া এমন মন্তব্য করা ঠিক নয়।
একই কথা বললেন পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ইনকিলাবের সাথে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, আমাদের ওপর আস্থা রাখুন, আমাদের কাজ করতে দিন, আমাদের কাজ দেখুন। তারপর বিচার করবেন। কাজ শুরু করার আগে ধারণা থেকে কোনো কিছুকে বিতর্কিত করা ঠিক নয়। ওরা পাহাড়ি-বাঙালি যা-ই হোক তারা যখন ভূমি কমিশনে আসবে তারা সকল মানুষের মেম্বার। তারপরও আমরা দেখি কতটুকু কি করতে পারি। এটা মিনিমাইজ করতে পারি। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা হ্রাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি আগেও ক্ষমতাবান ছিলাম না, এখনো ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রশ্নটা ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাহীনের নয়। আমরা অভিযোগ পেলে উভয় পক্ষকে ডাকব এবং উভয় পক্ষকে কিছু কিছু অপশন দেবো। তারা নিজেরা নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে নেবেন। এটাই হলো আমাদের মটো। আপনি যাদের কথা বলছেন তারা যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় যেটা বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের ওপর কোনো জুলুম হবে তখন আমার মনে হয় আমার কিছু করার এখতিয়ার আছে। আইনের কোথায় আছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওখানেই আছে। কারণ বলা হয়েছে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কাজেই আমাকে বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।