Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপরাধীদের আস্তানা কড়াইল বস্তি

প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : অপরাধীদের এক নিরাপদ আস্তানা রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তি। এ বস্তিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বাহিনী। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত এ বস্তির কয়েকটি চক্র। এ বস্তির পার্শ্ববর্তী গুলশান লেক এলাকাতেও রাতেরবেলায় বসে সন্ত্রাসীদের আড্ডা। এ কারণে কড়াইল বস্তি এখন সন্ত্রাসীদের অঘোষিত অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এমনটি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এতে করে গুলশান বারিধারার কূটনৈতিক পাড়াসহ ওই এলাকার নিরাপত্তাও অনেকটা হুমকির মুখে। কড়াইল বস্তি থেকে নৌকা যোগে লেক পারাপার বন্ধ করলেও বিকল্প ব্যবস্থায় এখন লেক পার হচ্ছে বস্তিবাসীরা। ফলে নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও আলোচিত হচ্ছে এলাকাবাসীর মধ্যে। ফেরির মতো ভাসমান এসব ভেলায় পারাপার অব্যাহত থাকায় কাটছে না উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। আগের মতোই অবাধে চলছে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা। তবে পুলিশ বলছে বিভিন্ন কথা।
গুলশান জোনের ডিসি মোস্তাক আহমেদ বলেছেন, কড়াইল বস্তিতে নিয়মিত পুলিশের অভিযান চলে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অপরাধে বেশ কিছু অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারপরেও অভিযোগ পেলেই পুলিশ অপরাধীদের ধরতে যায়। তিনি বলেন, বস্তির লোকজন গরীব শ্রেণীর ফলে তাদের অনেকেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ভাসমান অপরাধীরাও মাঝে মধ্যে এখানে আসে। এদের অপরাধ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, ওই বস্তি থেকে নৌকায় লেক পারাপার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। ভাসমান ভেলা ব্যবহার করাও বন্ধ করা হবে। নিরাপত্তার স্বার্থেই এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গুলশানের কূটনৈতিক পাড়াসহ গুলশান বনানীর অভিজাত এলাকার নিরাপত্তার জন্য নৌকা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে।
কড়ইল বস্তি থেকে গুলশান-বনানী লেকে নৌ-চলাচল বন্ধ আছে ঠিকেই। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থায় ওই লেক পারাপার অব্যাহত রয়েছে। বনানী থানা পুলিশ বলছে, গুলশান-বনানীর কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে গুলশান-বনানী সোসাইটি, সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখন থেকে ভাসমান ভেলাও চলাচল বন্ধ থাকবে।
ওই এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন। ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুর রহমান জানান, কূটনৈতিক জোনের নিরাপত্তার স্বার্থে খেয়া ঘাট বন্ধ রয়েছে। রাজউক রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করেছে। রাস্তা হয়ে গেলে আর ঘাট থাকবে না।
অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে বিভিন্ন সময় কড়াইল বস্তিতে জড়ো হয়। বস্তির কোনো ঘর অথবা লেকের পাশে বসেই চলে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পরিকল্পনা। রহস্যজনক কারণে রাতের বেলায় টহলের দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। এ অভিযোগ স্থানীয় সাধারণ মানুষের। তারা বলছেন, গুলশানের জঙ্গি হামলার পর পুলিশ ওই বস্তি থেকে নৌকা যোগে পারাপার বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থায় বিশেষ ভাসমান ভেলায় পারাপার ঠিকই চলছে। ফলে সন্ত্রাস বা অপরাধীদের প্রতিরোধ করতে পুলিশ যে উদ্যোগ নিয়েছিল তাও এখন হুমকির মুখে। এসব ভাসমান ভেলা দিয়ে শুধু সাধারণ মানুষ নয় সন্ত্রাসীরাও অবাধে প্রতিনিয়ত পাড়াপাড় হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪০ ঊর্ধ্বে ওই বস্তির একজন বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী জানান, অস্ত্র-মাদক কেনাবেচা, নারী-শিশু পাচার, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও অসামাজিক কার্যক্রমসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে ওই বস্তির অপরাধীরা। এ জন্য মাঝে মধ্যে পুলিশের অভিযান চলে। ঘন ঘন অভিযান হলে অপরাধীরা অন্যত্র পালিয়ে যায়। কিন্তু কিছু দিন পর আবারও সেইসব অপরাধীরা এখানে জড়ো হয়। তিনি আরো জানান, রাজনৈতিক আশীর্বাদ থাকায় প্রভাবশালীদের কারণে অনেক সময় পুলিশও এদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, মহাখালী কড়াইল বস্তিকে কেন্দ্র করে পুলিশের বিশেষ নজরদাবি রয়েছে। প্রায়ই পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। তিনি দাবি করেন, আগের মতো এখন আর সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা কড়াইল বস্তিতে অবস্থান করতে পারে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মহাখালীর কড়াইল বস্তির সন্ত্রাসীরা বেপরোয়াভাবে অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সেখানে ঘটছে না। নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি বহু সন্ত্রাসীও আশ্রয় নিয়েছে। ক্রিয়াশীল রয়েছে অনেক গোষ্ঠীও। এখানে প্রকাশ্যেই চলে মাদক বেচাকেনা। এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেরা ক্রমেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এমনকি অপহরণ, খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
জানা গেছে, রাজধানীর আলোচিত কড়াইল বস্তিতে গণধোলাইয়ে মারা যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন মশার উত্থান হয়েছিল এই বস্তিতেই। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী অঢেল অর্থবিত্তের মালিক গোলাম রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরও বড় হয়েছিলেন বস্তিতে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আশির দশক থেকেই কড়াইল বস্তি সন্ত্রাসীদের আস্তানা এবং রাজধানীর অন্যতম মাদক স্পট হিসেবে সুপরিচিত। এ বস্তি উচ্ছেদে সরকারের পক্ষ থেকে বহুবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও এখন পর্যন্ত এই বস্তিটি বহাল তবিয়তে আছে। মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের মজুদ এবং সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই কড়াইল বস্তি। দখল নিয়েও বহুবার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এখন আর আগের মতো সংঘর্ষ না হলেও অপরাধ থেমে নেই। কড়াইল বস্তিতে অভিযান চালিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আগেও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন।
মহাখালীর একজন ব্যবসায়ী জানান, রাজধানীতে অন্যায়-অপরাধ, দখল-খুন-চাঁদাবাজির সাথে জড়িত মহাখালী কড়াইল বস্তির সন্ত্রাসীরা। সর্বমোট ১৭০ একর আয়তনের এই বিশাল বস্তিতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষের বসবাস। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরো লোকালয়টি গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে এবং অবস্থান করছে অবৈধ দখলদার, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা। অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর গা-ঘেঁষে দিনে-দিনে বেড়ে ওঠা এই কড়াইল বস্তিতে কেউ জমির মালিক, কেউ বাড়ির মালিক কেউবা ভাড়াটিয়া, কেউ আবার হাওয়ার উপরেই বসবাস করছেন। কিন্তু কেউই প্রকৃত মালিক নন। আসল মালিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল, গণপূর্ত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারপরও এখানকার জমির মালিকের অভাব নেই। সেই জমি আবার বিক্রিও হচ্ছে। কখনও জমি কখনও রেডিমেড বাড়ি কখনও জমি বাড়ি এক সাথে বিক্রি হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব জমি আবার কয়েক হাত বদল হয়। হাত যত বদল হয়, ততই বাড়তে থাকে জমির দাম। অনেকে আবার আবাসন ব্যবসা শুরু করেছে সরকারি জমির উপর। গড়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লাব ও রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রতিনিধিদের দিতে হয় এককালীন টাকা। এভাবেই ঠিকে আছে কড়াইল বস্তি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, দিনের বেলায় কড়াইল বস্তির অবস্থা স্বাভাবিকই থাকে। কিন্তু রাতের বেলায় এই চিত্র বদলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকেই বস্তিতে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বাড়ে। বাড্ডা, কচুক্ষেত, খিলক্ষেত, ভাটারা, বেরাইদ, মহাখালী এবং তেজগাঁও এলাকার সন্ত্রাসীরা এই বস্তিতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে। এসব সন্ত্রাসী পুলিশ ও র‌্যাবের তালিকাভুক্ত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে ওই বস্তির সন্ত্রাসীদের রয়েছে সুসম্পর্ক। ফলে তাদের বিরুদ্ধে নেই কোন জোরালো অভিযান। রাতের বেলায় টহল পুলিশ বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী লেকের পাড়ে সন্ত্রাসীদের অবস্থানের খবর পেয়েও কোনো অভিযান চালায় না। ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ২০টি গ্রুপের সদস্যরা কড়াইল বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী লেক এলাকায় অবস্থান করে। বিভিন্ন স্থানে বসে বৈঠক। এসব বৈঠকেই ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি এবং বাসাবাড়িতে চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের পরিকল্পনা হয়। পরিকল্পনা শেষে তারা বেরিয়ে পড়ে; এবং সন্ত্রাসী কর্মকা- শেষে তারা আবার সেখানে ফিরে এসে টাকা ও মালামাল ভাগ-বাটোয়ারা করে। ভাট-বাটোয়ারায় গরমিল হলে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটে। প্রায়ই গুলশান লেকে পাওয়া যায় অজ্ঞাত পরিচয় লোকজনের লাশ।
গোয়েন্দা সংস্থার হিসাব মতে, রাজধানীর বস্তিগুলোতে লক্ষাধিক অপরাধী রয়েছে। তন্মধ্যে বেশিরভাগই কড়াইল বস্তিতে আস্তানা গেড়েছে। তাদের মধ্যে শিশু-কিশোরদের সংখ্যাও কম নয়। তারা বস্তিতে কিশোর সন্ত্রাসী বা বস্তির খুদে রাজা হিসেবে পরিচিত। অনেকের নামে হত্যা থেকে শুরু করে মাদক-ছিনতাই, চুরি, গাড়ি ভাঙচুর ও ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে। মূলত কড়াইল বস্তি অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধীদের আস্তানা কড়াইল বস্তি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ