Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঝিনাইদহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক

প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এস এম সাখাওয়াত হুসাইন
ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুর। ঝিনাইদহ শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে উপজেলার দত্তনগরে অবস্থিত, হেমেন্দ্র নাথ দত্তের সবজি খামার এখন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বীজ উৎপাদনকারী খামার হিসেবে পরিচিত। ২ হাজার সাতশত ৩৭ একর জমি নিয়ে ৫টি বিভাগে অবস্থিত খামারে উৎপাদিত বীজ দেশের প্রয়োজন মিটিয়েও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। বছরে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন বীজ উৎপাদনকারী এই খামারে আউশ, পাট, গম, মুগ, নেরিকা, কলাই, ভুট্টা, হাইব্রীড ধান, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশের ২৩টি বীজ উৎপাদনকারী খামারের মধ্যে দত্তনগরে মথুরা বীজ খামারটি শীর্ষ স্থানে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর কৃষি খামারটিতে বিএডিসির নিয়ন্ত্রিত একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর সেটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমনও আশা করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সেটি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর প্রস্তাবিত নাম ‘ঝিনাইদহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ দেয়া হয়েছিল। উপজেলার মহেশপুরের ‘দত্তনগর কৃষি ফার্ম’ এলাকায় এ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এজন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নিদের্শ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দিতে রাজি না হওয়ায় তা ঝুলে আছে এখনও।
দত্তনগর ফার্ম ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ১৯৪০ সালের দিকে হেমেন্দ্র নাথ দত্ত এ খামারটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার ছিলেন। সেনাবাহিনীর জন্য তাজা সবজি উৎপাদনের জন্য নিজ গ্রাম দত্তনগরে খামার করেন। রেলপথে দর্শনা স্টেশনে সবজি বহন করে কোলকাতায় নিতেন। পরে সেখানে হেলিপ্যাড স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রতিদিন হেলিকপ্টারে করে কোলকাতায় শাকসবজি সরবরাহ করে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হেমেন্দ্র নাথ দত্ত দত্তনগর ছেড়ে কোলকাতায় চলে যান। সেই সময় তার কর্মচারীরা এটি দেখাশোনা করতেন। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দত্তনগর খামারটি অধিগ্রহণ করে এবং কৃষি বিভাগের কাছে সব দায়িত্ব অর্পণ করে। ১৯৬২ সালে ফার্মের যাবতীয় সম্পত্তি কৃষি উন্নয়ন করর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই থেকে বিএডিসি প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের বীজ উৎপাদনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
বীজ উৎপাদনকারী এই খামারে ৫ জন উপ পরিচালক, স্টাফ আছে ৬০ জন, প্রতিদিন ১ হাজার ৫শ’ লোক কাজ করে। মোট ২হাজার ৭৩৭ একর জমির মধ্যে আবাদী প্রায় ২ হাজার ৫শ’ একর জমি। সেচের জন্য রয়েছে ৩৬টি গভীর ও ১৩টি অগভীর নলকূপ এবং ১০টি পাওয়ার পাম্প। এসব খামারে মোট ২ হাজার ৭৩৭ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে আবাদি জমি রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫শ’ একর। বাকি জমির মধ্যে ৬০০ একর নিচু ও প্রায় ১০০ একর জমি জুড়ে বিল আছে। ৫ খামারের মধ্যে গোকুলনগর খামারে ৫৭০ একর, পাতিলা খামারে ৬০৩ একর, মথুরা খামারে ৪৯০ একর, করিঞ্চা খামারে ৫৭০ একর ও কুশাডাঙ্গা খামারে ৪৮০ একর জমি রয়েছে। এছাড়া এখানে অফিস ভবন, কর্মকর্তাদের বাসভবন রয়েছে। এখানে বড় বড় মেশিনের সাহায্যে ফসল কাটা ও মাড়াই করা হয়। এছাড়া ফার্মে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি মহিষ প্রজনন কেন্দ্র। উৎপাদিত বীজগুলো বিএডিসির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এশিয়ার অন্য দেশেও রপ্তানি করা হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দত্তনগরে সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানানো হয়। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে শিক্ষামন্ত্রলায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সুযোগসুবিধা ও ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্যরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি পজেটিভ রিপোর্ট জমা দেন। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের থেকে আজ অবধি কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের ১৭ নভেম্বর প্রস্তাবিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্যরা উপজেলার দত্তনগর কৃষি ফার্ম এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর ড. আবদুল হাকিমকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের একটি সম্ভাব্য যাচাই কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন ইউজিসি সদস্য ড. আতফুল হাই শিবলী, ইউজিসির পরিচালক (গবেষণা ও প্রকাশনা) ড. লুৎফে আলম এবং উপ-সচিব (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) ফেরদৌস জামান। প্রস্তাবিত এলাকা পরিদর্শন শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি রিপোর্ট জমা দেয় কমিটি। সে সময় ইউজিসির একটি সূত্র জানিয়েছিল, তারা সরকারের কাছে ইতিবাচক রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। তবে প্রস্তাবিত এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে নতুন করে প্রচুর পরিমাণে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। বাকি সব উপাদান ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষে বলে পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদন থেকে সে সময় জানা যায়।
ভৌগোলিক দিক থেকে স্থানটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করার সম্পূর্ণ উপযোগী। এটি তিনটি (যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা) জেলার সংযোগস্থল। উপরন্তু খুলনা বিভাগে কোন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তাই এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে খুলনা বিভাগের সব জেলার ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি বিষয়ক গবেষণা আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে ‘ঝিনাইদহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশে বর্তমানে ৪টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো হলো ময়মনসিংহে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,’ গাজীপুরে অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’, সিলেটে ‘সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ‘শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।’ এছাড়াও দেশে কয়েকটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক কৃষি অনুষদ রয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল আজম চঞ্চলের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, কৃষিপ্রধান এলাকা হিসেবে গবেষণার জন্য হলেও ঝিনাইদহের দত্তনগরে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনেক। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে দত্তনগর ফার্মের ১শ’ একর জমি চেয়েছিল। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় তা দিতে রাজি হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ঝিনাইদহে হোক, তবে এ জমি তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যোগাড় করতে হবে। ফলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি ঝুলে গেছে। তিনি বলেন, এ ফার্মে সাড়ে ৩ হাজার একর জমি রয়েছে। এর অনেক জমিই ব্যবহার করা হয় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য কিছু জমি পেলে ভাল হতো।
ঝিনাইদহসহ বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি প্রস্তাবিত ‘ঝিনাইদহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ বাস্তবায়নে অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
লেখক : সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঝিনাইদহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক
আরও পড়ুন