এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরাও
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। লিঙ্গ সমতার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি
তৌহিদ জামান
“ও আল্লাহ, দিয়া ক্যা আবার তুমি লইয়া গ্যালা, চান্দের ল্যাহান পোলাডারে ভুইল্লা ক্যামন কইর্যা মাইয়াডা মোর বাঁচব! এ্যই পেরোন-প্যান্টুল পড়ব ক্যাডা।” নবজাতকের জামা-কাপড়গুলো হাতে নিয়ে লাশের সামনে বিলাপ করছিল রোকেয়ার মা জোবেদা।
রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল তার সন্তানটি ছেলে হলে নাম রাখবে বাদশাহ আর কন্যা হলে রানী। লোকে ডাকবে তাকে বাদশাহ কিংবা রানীর মা বলে। আনন্দে তার বুকটা ভরে যাবে। এই কদিন আগে পাশের ঘরের মজনুর ছেলের খতনায় আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে দাওয়াত দিয়ে মহাধুমধামে অনুষ্ঠান করেছে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী মেহমানদের দেয়া উপহার-উপটৌকনে বাসার একটি কক্ষের অর্ধেক প্রায় ভরে গিয়েছিল। রোকেয়ারও শখ, সন্তানের উছিলায় এ ধরনের একটা ছোট অনুষ্ঠান হলেও সে আয়োজন করবে। উৎসবে মাতিয়ে তুলবে গোটা এলাকা। সন্তান একদিন স্কুলে যাবে। রোকেয়া নিজেই নিয়ে যাবে স্কুলে। বিকেলে বেড়াবে পার্কে। ঘুমপাড়ানো গান গেয়ে ঘুম পাড়াবে দুলাল ও দুলালীকে। সন্তানকে ডাক্তারি পড়াবে। রোকেয়ার পিতা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। অর্থ ও ডাক্তারের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি তার। তাই মনের দুঃখ ঘোচাতে বিয়ের আগেই সে ঠিক করেছে প্রথম সন্তানকেই ডাক্তারি পড়াবে। সন্তান ডাক্তার হয়ে বিনে পয়সায় গরিব-দুঃখীদের চিকিৎসা দেবে। রোকেয়ার স্বপ্ন সবই মিথ্যে হয়ে গেল তার সন্তান প্রসবের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই।
রোকেয়া বেগমের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন থানার এক অখ্যাত গ্রামে। নদীভাঙনে সব হারিয়ে জীবিকার সন্ধানে স্বামীর সঙ্গে চলে আসে ঢাকায়। স্বামী রফিক ব্যাপারী শুরু করে কাঁচামালের ব্যবসা। রোকেয়া বাসায় মেশিন দিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে দু’পয়সা কামায়। পূর্ব রামপুরার এক বস্তিতে থাকে তারা। মোটামুটিভাবে সংসার চলছে তাদের। বিয়ের তিন বছর পর রোকেয়ার গর্ভে আসে এক সন্তান। টিভিতে স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত দেখে সে। বস্তির কাছেই “সূর্যের হাসি” ক্লিনিক। সেখানে রীতিমতো চেকআপ করায়, টিকা নেয়। সময় ঘনিয়ে আসে। ডেকে আনা হয় একজন স্থানীয় দাইকে। সেই অদক্ষ দাইয়ের হাতে রোকেয়ার কলিজার টুকরা প্রথম সন্তানটিকে বাঁচানো গেল না। পৃথিবীর আলো দেখার সাত ঘণ্টার মধ্যেই চাঁদের মতো ফুটফুটে নবজাতক ছেড়ে গেল সবাইকে। এ সময় কাছেই ছিল রোকেয়ার মা জোবেদা। নবজাতককে হারিয়ে শোকাহত নানী জোবেদাও মূর্ছা যায়। কিছুটা চেতনা ফিরে পেলেই বিড়বিড় করে বকতে থাকেন অদক্ষ দাইকে। আর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে-পোলাডার নাড়ি কাডার পর তোন একছেড়ে রক্ত গেছে, হ্যারপর পোলা আস্তে আস্তে ব্যাহা হইয়া হাত-পাও নীলা অইয়া গেছিল। তয় কিছুডা আলগা বাতাসও লাগছিল মনে অয়। দাই বেডীরও হ্যামন কোন যোগ্যতা নাই। ট্রেনিং পাওয়া দাই আনলে মোর মাইয়ার এমন সর্বনাশ অইত না।” বিশিষ্ট মহিলা চিকিৎসক ডা. সুমিতা খানম বলেন, অদক্ষ ধাত্রীর কারণে দেশে বহু নারী এভাবে রোকেয়ার মতো সন্তান হারাচ্ছেন। রোকেয়ার শিশুটি ধনুষ্টংকারে মারা গেছেন বলে তিনি জানান। দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে দক্ষ ধাত্রীর প্রয়োজনের কথা তিনি উল্লেখ করেন।
অদক্ষ দাইয়ের হাতে দেশে প্রতিদিন ৩৪২ জন শিশু মারা যাচ্ছে। আর্থিক অনটন, স্বামীদের ঝক্কিঝামেলা এড়ানোর প্রবণতা, কাছাকাছি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকার কারণে এখনও দেশের প্রায় ৯০ ভাগ প্রসবকালীন সেবা বাড়িতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে অদক্ষ দাইদের হাতে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার বেড়েই চলছে। দাইদের অদক্ষতার কারণে কখনও কখনও মা ও শিশুকে পঙ্গত্ব বরণ এবং দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার হাজারে ৩.২ জন এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার হাজারে ৪৫ জন। দেশে বর্তমানে শতকরা ১৩ ভাগ প্রসব কাজ দক্ষ ধাত্রী দিয়ে সম্পন্ন হয়। তবে বর্তমান সরকার এ হারকে ৫০%-এ উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে। গ্রাম পর্যায়ে দক্ষ প্রসব সহায়তাকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফজলুর রহমান বলেন, সরকার পরিবার কল্যাণ সহকারী ও মহিলা স্বাস্থ্য সহকারীদের ছ’মাসের ধাত্রীবিদ্যা প্রশিক্ষণ দিয়ে স্কিল্ড বার্থ এটেনডেন্ট গড়ে তোলার কর্মসূচি নিয়েছে যা শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। তিনি আরও জানান, বর্তমান সরকার ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে জরুরি প্রসূতি সেবা (ইওসি) প্রকল্প শুরু করে যা মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এম জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, দক্ষ ধাত্রী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বর্তমান সরকারের মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসের একটি উত্তম ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এসবিএর উল্লেখযোগ্য দিক হলো জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দেয়া। এ প্রশিক্ষণ নিয়ে পর্যায়ক্রমে অধিক হারে দক্ষ ধাত্রী তৈরি হবে এবং সারাদেশে গর্ভকালীন প্রসবকালীন সেবায় আত্মনিবেদিত থাকবে। য় পিআইবি-ইউনিসেফ ফিচার
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।