পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মার্কিনীদের কাছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মূলে দেশে গণতন্ত্রের প্রকট সঙ্কট : পঙ্কজ ভট্টাচার্য
প্রভাবশালীদের অনুকম্পা পেতে এটার প্রয়োজন পড়ে : অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী
দেশের সব খবরকে পেছনে ফেলে এখন সামনে চলে এসেছে লবিস্ট বিতর্ক। বাইডেন প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শুরু হয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ি। দেশের বড় দুই দল একে অপরের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ তুলেছেন। দুই দলের এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও তর্ক-বিতর্ক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। নেটিজনদের কেউ এ নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করছেন; কেউ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেউ মাঠের বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ্যে অবস্থান নিয়ে মন্তব্য-বক্তব্য ছুড়ছেন। কেউ বা লিখছেন এসব গণতন্ত্রহীনতার ফসল।
মূলত দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ঘোষণা দেন ৭ কর্মকর্তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে যেভাবে প্রয়োজন তদবির করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য প্রকাশের পর দেশের শীর্ষস্থানীয় এক পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয় ‘আওয়ামী লীগ ২০০৪ সালের ২৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর করা হয়। আওয়ামী লীগ এই খবরকে ‘আজগুবি’ খবর হিসেবে অবিহিত করেছে।
গত ১৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বিএনপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। ১৯ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বøু স্টার স্ট্র্যাটেজিস এবং রাস্কি পার্টনারস নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট নিয়োগ দেয় বিএনপি। লবিস্ট নিয়োগে বিএনপি খবচের হিসেব জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ লবিস্ট নিয়োগ করেছে সেটা আড়াল করতে বিএনপির বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগের কল্পকাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ লবিস্ট নিয়োগ বিতর্ক দেশের গÐি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়। তবে যেসব দেশের সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, গণতন্ত্রহীন, কর্তৃত্ববাদী সে সব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রভাবশালী দেশগুলোকে নিজেদের পক্ষ্যে রাখতে লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু যে সব দেশে আইনের শাসন রয়েছে, গণতান্ত্রিকভাবে সরকার নির্বাচিত হয় সে সব দেশের লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজন পড়ে না।
জানতে চাইলে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, এমন রাজনীতি করে যে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকতে এবং বিএনপির ক্ষমতায় যেতে লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। এগুলো আমাদের মাথায় ঢোকে না। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে এসব করছে। এক দল অন্য দলকে দেশবিরোধী প্রচারণার অভিযোগ তুলছে। আসলে বিদেশে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা হচ্ছে নাকি সরকারবিরোধী প্রচারণা সেটা বুঝতে হবে। রাষ্ট্রবিরোধী আর সরকারবিরোধী এক জিনিস নয়। কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগ তোলা ভয়ঙ্কর। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই রেষারেষিতে রাষ্ট্রের জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ ক্ষমতা ধরে রাখতে কেউ ক্ষমতায় যেতে স¤্রাজ্যবাদী মার্কিনীদের কাছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। দেশের মূল সঙ্কট গণতন্ত্র। এসব তর্কবিতর্ক দেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট চিহ্নিত করছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। যে জাতি যুদ্ধ করে সার্বভৌম দেশের জন্ম দেয় সে জাতির কাছে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের খবর দুর্বোদ্ধ।
লবিস্ট অর্থ কি? যে লবিং করে সে লবিস্ট। লবিংয়ে সোজাসাপ্টা অর্থ হচ্ছে কাউকে বুদ্ধিভিক্তিক বাধ্য করা। যারা কোনো শক্তিশালী গ্রæপের সাথে যুক্ত, যারা কোনো প্রশাসকের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে তা নির্ধারণ করে দিতে পারেন, তারাই হলেন লবিস্ট। এজেন্ডা নির্ধারণ করে দেবার ক্ষমতাকেও লবিং বলা যেতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রথম লবিস্ট নিয়োগের ঘটনা শোনা যায় ১৯৯১ সালে। ’৯০ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূত্র ধরে তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদের দুর্নীতি তদন্তের জোরালো দাবি ওঠে। সে সময় এরশাদের কথিত পাচার করা ১০ বিলিয়ন ডলার খুঁজে বের করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো ইনভেগেস্টনকে (ফেয়ার ফ্যাক্স) নিয়োগ দেয় তৎকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। লবিস্ট নিয়োগে প্রচুর টাকা খরচ করা হলেও ফেয়ার ফ্যাক্স এরশাদের কথিত পাচার করা টাকার হদিস দিতে পারেনি।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে জো বাইডেন সরকার আয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অতপর ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে র্যাবের সাবেক প্রধানসহ র্যাবের ৭ কর্মকর্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানান, র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের চেষ্টায় সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করার কথা ভাবছে। ১৪ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, দেশের স্বার্থে যেখানে তদবিরের প্রয়োজন হবে সেখানে সরকার তদবির চালাবে। গণতান্ত্রিক কারণে এ দেশ সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্রে অনেক ধাক্কা আসে। সব গণতন্ত্রেই অপরিপূর্ণতা আছে। এটা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সময় সময় আমাদের অনেক ধরনের দুর্যোগ আসে। আমরা সেগুলো সমাধান করি। এখনো একটা হয়তো অসুবিধা আসছে। আমরা এটা সমাধান করতে পারব। সংসদের চলতি অধিবেশনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম বলেন, সরকার যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট নিয়োগ করেনি বা করার কোনো পরিকল্পনাও নেই। তবে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগে ৩৭ লাখ ডলার খরচ করছে। প্রতিমন্ত্রী দাবি করে বলেন, এখন পর্যন্ত আটটি নথি পাওয়া গেছে, যাতে দেখা গেছে যে, কিছু বাংলাদেশি নাগরিক কয়েকটি মার্কিন লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে। লবিস্ট নিয়োগের ওই আটটি চুক্তির মধ্যে অন্তত তিনটিতে বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের ঠিকানা মূল ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম বলেন, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট ফার্ম আকিন কোম্পানি অ্যাসোসিয়েটস, বøু স্টার স্ট্র্যাটেজিস এবং রাস্কি পার্টনারসকে নিয়োগ দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনি চ্যানেলের অনুমোদন নিয়ে বিএনপি বৈধভাবে মার্কিন সংস্থাগুলোকে টাকা পাঠিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে নথিগুলোসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়ে তারা টাকা পাঠালে আমরা আশা করি যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নেবে এবং বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জানাবে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব ইসিতে জমা দিতে হয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ বলেছেন, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করা যেতেই পারে। লবিস্ট নিয়োগ করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না সরকারের কর্মকাÐের বিরুদ্ধে প্রচারণা সেটা দেখতে হবে। সরকারি দলের কর্মকাÐের বিরুদ্ধে আর দেশের বিরুদ্ধে এক বিষয় নয়। তাছাড়া মানি লন্ডারিং করে লবিস্ট নিয়োগ করতে হবে এমন নয়। কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি বিদেশে রয়েছেন তারা নিজেরাই অর্থ দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের এই অভিযোগকে ‘ফেক গল্প’ হিসেবে অবিহিত করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের প্রথম লবিস্ট ‘অ্যালক্যাডে এন্ড ফোকে নিয়োগ দেন ২০০৪ সালের ২৯ নভেম্বর। যা কার্যকর হয় ২০০৫ সালের পহেলা জানুয়ারি। ২০০৫, ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে এই লবিস্ট ফার্মকে চুক্তি অনুযায়ী মাসে ৩০ হাজার ডলার হিসেবে সাড়ে ১২ লাখ ডলার অর্থাৎ ১০ কোটির বেশি টাকা দেয়া হয়। এর আগে ড. মোশাররফ বলেছেন, বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। যখন আমেরিকা থেকে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, যখন বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সম্মেলনে দাওয়াত পায় না, তখন এ কথাগুলো উঠছে। আমাদের প্রশ্ন, আগে কেন এগুলো ওঠেনি। নিজেদের অপকর্ম ধামাচাপা দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এসব বানোয়াট অভিযোগ তুলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্র হত্যা করছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, দেশের অর্থনীতি লুণ্ঠন করছে। এগুলো যাতে ধামাচাপা দেয়া যায়, সে জন্য তারা বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে গত ১৪ বছর। এটা যখন পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে, তখন এই সরকার মিথ্যা-বানোয়াট কতকগুলো ডকুমেন্ট দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ ধরনের কথা বলছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, ‘লবিস্ট’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বৈধ প্রক্রিয়া। ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক স্বার্থে এ ধরনের লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রাজনীতিকদের এটার প্রয়োজন নেই। কর্তৃত্ববাদী শাসকদের যাদের বৈধতার সঙ্কট তাদের প্রভাবশালী দেশগুলোর অনুকম্পা পেতে লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। পাকিস্তানের আইয়ুব খান এটা করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ এটা করেছিল। ওই সময় জাতিসংঘ থেকে যে চিঠি আসে তার নেপথ্যে ছিল লবিস্টরা। আওয়ামী লীগের পথ ধরে হয়তো বিএনপি সেটা করেছে। তবে এটা ঠিক দেশের মানুষ বিশ্বাস করে কেউ ক্ষমতায় থাকতে, কেউ ক্ষমতায় যেতে এটা করতেই পারে। কিন্তু এ ধরনের প্রক্রিায় জনগণের কোনো স্বার্থ নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।