Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমরা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি’

জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সমাবেশ গুম হওয়া স্বজনদের খুঁজতে গিয়ে নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কা! জাতিসংঘের তদন্ত কমিটিকে আসতে দেয়ার দাবি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

‘আমাদের চোখের পানি নিয়ে এমপি-মন্ত্রীরা উপহাস করে, হাসে। তারা বলে আমাদের স্বামীরা বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে গেছেন। দেশে নাকি গুম নেই। আমাদের কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছায় না। আমরা প্রতিমহ‚র্তে মরে যাচ্ছি। আমরা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। গতকাল শনিবার প্রেসক্লাবে মায়ের ডাক আয়োজিত অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলছিলেন কাঠ ব্যবসায়ি ইসমাইল হোসেন বাতেনের স্ত্রী নাসিমা আক্তার স্মৃতি। এ সময় গুম হওয়া ব্যাক্তিদের স্বজনরা বলেন, পুলিশ, র‌্যাবসহ সরকারের বিভিন্ন অফিসে ঘুরে দেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়াদের সন্ধান পাচ্ছি না। গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের অভিযোগ, তাদের আপনজনরা গুম হয়েছেন সে কথাটিও তাদেরকে বলতে দেয়া হচ্ছে না; হারানো স্বজনের জন্য কাঁদতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি তাদের কেউ গুম হয়নি এই মর্মে সাদা কাগজে সই নেয়া হচ্ছে। তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ স্বজনদের।

মায়ের ডাক আয়োজিত প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল কাদের মাসুমের মা আয়েশা আলী বলেন, মাসুম খুব মেধাবী ছিল। তার ইচ্ছে ছিল সে সরকারি প্রশাসনে চাকরি করবে। মাসুমকে হারিয়ে আমরা অসহায়, অক্ষম, স্তবদ্ধ হয়ে গেছি। মাসুমের বাবা মাসের পর মাস অসুস্থ থাকে। মাসুম আমার একটাই সন্তান তাকে হারিয়ে মাসের পর মাস মাস কষ্ট দুঃখ আর হয়রানির মধ্যে আছি। এটাই কি আমাদের জীবন? আমার একটাই সন্তান, একটাই সম্পদ ছিল। তাকে হারিয়ে আমরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দুঃখ আর হয়রানির মধ্যে আছি।

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার আই বøক থেকে র‌্যাব তাকে ধরে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন মাসুমের মা। তার পর থেকে তিনি আর ফেরেননি। মাসুমের মা বলেন, যারা আমার সন্তানকে গুম করেছেন তারা তো শুনেন না, বুঝেন না, দেখেন না। আমরা কোথায় যাবো। আমাদের একটু ভরসা দিন। তিনি বলেন, পুলিশ ৫-১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ বার বাসায় এসেছে। তারা একেকবার একেক ধরনের কথা বলছে। বিভিন্ন ডকুমন্টে চাচ্ছে। আমাদের কেন এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আমার সন্তান কোথায় আছে, কেমন আছে একটু হদিস দেন। আমরা কষ্ট ব্যথা আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। আমরা কার কাছে যাবো, কাকে বলবো। আমাদের কী অপরাধ। পুলিশ দিয়ে আমাদের আর হয়রানি করবেন না। আমাদের সন্তানের যদি হদিস দিতে পারেন তাহলে আমাদের ডাকেন আমরা যাবো।

২০১৯ সালের ১৯ জুন কাঠ ব্যবসায়ি ইসমাইল হোসেন বাতেনকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে র‌্যাব-৪ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন থেকে তিনি নিখোঁজ আছেন। ইসমাইল হোসেন বাতেনের স্ত্রী নাসিমা আক্তার স্মৃতি বলেন, আমার স্বামী সেদিন যখন বাসা থেকে বের হয়ে যায় তখন আমার সন্তানদের বলে যায় যে আম নিয়ে আসবে। সন্তানরা এখনোও আমাকে বলে বাবা আম নিয়ে আসে না কেন। আমার বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে, সবার তো বাবা আছে আমাদের বাবা নেই কেন। আমি উত্তর দিতে পারি না।

স্ত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, স্বামীর খোঁজে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তিন বছর পর এখন পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করছে, ইসমাইল সত্যিই গুম হয়েছেন কি না। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালের ১৯ জুন ইসমাইল হোসেন নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে নাসিমা আক্তার সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কী আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন, তার বিবরণ দেন। নতুন করে পুলিশি তৎপরতার কী কারণ, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

নাসিমা আক্তার বলেন, কিসের পুলিশ? আমি থানায় গেছি, পুলিশ আমাকে থানা থেকে বের করে দিয়েছে। পুলিশের ডিসি আমার চিঠিটা একবার পড়ল না। বলে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনি র‌্যাবের কাছে যান। পুলিশ এখন তিন বছর পর এসে জিজ্ঞেস করে আমার স্বামী আসলে গুম হয়েছে, নাকি কোথাও চলে গেছে। আমাদের কষ্ট লাগে, ঘেন্না আসে এখন। মন্ত্রীরা আরামে বসে থাকে, আমাদের বিরুদ্ধে যখন কথা বলে, হেলেদুলে বলে, আরে না। বাংলাদেশে কখনো গুম হয় না। উনারা ঋণের দায়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে। এটা কতটা লজ্জার! আমার মনে হয় না সমাজে শ্বাস নিই। আমাদের এখন মেরে ফেলেন। তারা আমাদের চোখের পানি নিয়ে হোলি খেলে। উপহাস করে। আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। আমার বাচ্চারা কখনো হাসে না। স্বামীর সন্ধান চেয়ে এই নারী বলেন, বলেন কোথায় রেখেছেন। লাশটা দেন। আমরা কি কোনো দিন একটা মিলাদ পড়তে পারব?

রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে গুম হওয়া পারভেজের স্ত্রী ফারজানা বলেন, আমার স্বামী যখন গুম হয় তখন আমি ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার ছেলে এখন বাবা বলে ডাকতে পারে। ছেলেটার আমার হার্টের সমস্যা। আমি থানায় জিডি করতে গেছিলাম। কিন্তু জিডি নেয়নি। এখন আবার আমাদের কাছে জিডির কপি চায় পুলিশ। কেন আমাদের থানায় যেতে বলে।

তিনি বলেন, আমার মেয়ে ৪ বছর ধরে মায়ের ডাকের এই অনুষ্ঠানে আসে। আমার মেয়ে হাসে না। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না। সব সময় নীরব থাকে। আমার মেয়ে প্রতি শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। চলতি মাসের ১৫ তারিখ চলে গেলেও এখনো মেয়েকে ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি। তার বাবা থাকলে আমাদের তো কোনো সমস্যা থাকতো না।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি যাদের বাড়িতে পুলিশ গেছে বা যাদের থানায় যেতে হয়েছে বা পুলিশের লিখে দেয়া জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করার জন্য চাপের মুখে পড়তে হয়েছে, তারাই মূলত গতকাল শনিবার মায়ের ডাকের সমাবেশে অংশ নেন। এই সমাবেশে ভুক্তভোগী সব পরিবার ও সাংবাদিক হাজির হওয়ার আগেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া শাখায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা হাজির হন। তারা ভুক্তভোগীদের বক্তব্য রেকর্ড করেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নও করেন। মায়ের ডাকের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও তাদের স্বাগত জানান।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ছাড়াও সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংগঠক ন‚র খান লিটন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি।

মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম বলেন, তদন্ত করলে সাধুবাদ জানাই। আপনারা জাতিসংঘকে কাগজপত্র পাঠাতে চান বলেছেন। আমরা আমাদের স্বার্থেই সহযোগিতা করব। কিন্তু আপনারা এই যে হাফ উইডোদের (প্রায় বিধবা) কখনো দিনে কখনো রাতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। দুই ঘণ্টা আটকে রেখেছেন। তারা ভীতির মধ্যে আছেন। তাদের ফিরে পেতে যা যা করতে হয়, মানবিকতার সঙ্গে করেন।

আফরোজা আরও বলেন, পুলিশ এখন বলার চেষ্টা করছে যে জিডির কপিতে তথ্য গোপন করা হয়েছে। স্বজনেরা যখন গুম হন, তখন পুলিশ মামলা বা থানায় সাধারণ ডায়েরি নিতে চায়নি। তার ভাই সাজেদুল ইসলাম গুম হওয়ার পর তারা ভাটারা থানায় গেলে পুলিশ বলেছে তেজগাঁওয়ে যেতে, তেজগাঁওয়ে গেলে বলেছে উত্তরায় যেতে হবে। ছয়-সাতজনের সামনে থেকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে এই কথা বললে আর জিডি করা যায়নি। বলা হয়েছে, বাসায় ফেরেনি, খুঁজে পাওয়া যায়নি এভাবে লিখতে। এসব কথা আগেও অজ¯্রবার বলা হয়েছে। এখন নতুন করে ধানাইপানাই করা হচ্ছে যে তথ্য গোপন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো একটা স্বাধীন নিরপেক্ষ, বিচারবিভাগীয় তদন্ত চায়। জাতিসংঘের তদন্ত কমিটিকে আসতে দেয়ারও দাবি করে তারা।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, গুমের মধ্য দিয়ে একটা অপরাধ করা হয়েছে এখন সেই অপরাধ ঢাকানোর জন্য আরেকটা অপরাধ করা হচ্ছে। গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সাক্ষর নেয়া হচ্ছে। একজন ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে তা জানতে হবে। কিন্তু, আমাদের পুলিশের সেই জ্ঞান নেই। তিনি বলেন, যারা গুমের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার করতে হবে। গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, পুলিশ এখন বিপদে পড়েছে বলেই গুম হওয়াদের বাড়িতে যাচ্ছে তাদের রক্ষাকবচের জন্য। আন্তর্জাতিকভাবে চাপে থাকার কারণে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাক্ষর নিচ্ছে। তাদেরকে রক্ষাকবচ তৈরি করতে দেবেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, কতটা অমানবিক হলে নিজের দেশের মানুষকে গুম করা যায়। আবার তাদের পরিবারের সদস্যদের নতুন করে হয়রানি করা হচ্ছে। যারা নিজেরা গুম করে তারা এর বিচার করে না। আজ সাদা কাগজে সই করতে চাপ দেয়া হচ্ছে। আমরা এর ধিক্কার জানাই। তিনি আরও বলেন, যারা হুমকি দিচ্ছেন, সাদা কাগজে সই নিচ্ছেন, হয়রানি করছেন তাদের তথ্য রাখতে হবে। অবশ্যই তাদের একদিন বিচার হবে।#



 

Show all comments
  • Imtiaz Imon ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৪৭ এএম says : 0
    আহ! আর কতো?
    Total Reply(0) Reply
  • সুমাইয়া আক্তার পারুল ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৪৯ এএম says : 0
    মাফিয়া হঠাও দেশ বাঁচাও। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Rafiqulalam Milon ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৪৯ এএম says : 0
    এক সাথে রাজপথে নামার আহব্বান জানাই সকলকে
    Total Reply(0) Reply
  • MD Israfil Hossain ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৫০ এএম says : 0
    দল মত নির্বিশেষে আন্দোলন করতে হবে
    Total Reply(0) Reply
  • Md SR Trafder ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৫২ এএম says : 0
    মহান আল্লাহ তালা সইবে না,,
    Total Reply(0) Reply
  • Nurul Alam ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৫৩ এএম says : 0
    পাপের খড়া পূর্ণ হয়েছে তাই মরণ কামড় দিচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Masud Tex ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৫৩ এএম says : 0
    আগামী ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও শুষ্ঠু হতে হবে এ লক্ষ্যে র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সংকেত”- মাইকেল কুগলম্যান, উপ-পরিচালক, এশিয়া প্রোগ্রাম, উইলসন সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র।
    Total Reply(0) Reply
  • Sai Ful Islam ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৩:৫৪ এএম says : 0
    জাতীয় সংঘের তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার চাই
    Total Reply(0) Reply
  • salman ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৪:৫৭ এএম says : 0
    Yeah Allah, Zalim der & Jara ai sob Gum a Jorite selo Tade'r Dhongsho kore daw. Tade'r Pori bar er cow k gum kore daw, tobe ora kosto bujbay. Manobota burudhi ain a e ai oporadh er bechar korte hobe ader.
    Total Reply(0) Reply
  • Khairul Alom ১৬ জানুয়ারি, ২০২২, ৫:০৩ পিএম says : 0
    সকল গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান চাই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ