ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, এক নেতার বাড়িতে রোগী দেখতে না যাওয়ায়, ওই নেতার গুণধর ছেলের নেতৃত্বে হাসপাতালের ভেতরেই এক চিকিৎসককে মারধর ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে নেতাকর্মীরা। দেশের এক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিবাদে হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন। হাসপাতাল ও কর্মচারীদের ভাষ্য মতে, ওই উপজেলার ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার ছেলে উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে নিজের পরিচয় না দিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসককে বলেন তার বাবাকে দেখতে যাওয়ার জন্য। তখন চিকিৎসক বিনয়ের সাথে জানান, ওই মুহূর্তে হাসপাতালে আর দ্বিতীয় কোনো চিকিৎসক নেই। জরুরি বিভাগ খালি ফেলে বাইরে গেলে রোগীদের অসুবিধা হবে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসার পর রোগী দেখতে যাওয়া সম্ভব হবে। প্রকাশিত সংবাদ মতে, একথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওই নেতার ছেলে ডাক্তারের শার্টের কলার চেপে ধরে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ফোন পেয়ে কয়েকজন যুবলীগ নেতা হাসপাতালে ছুটে যায় এবং তারা সবাই মিলে ডাক্তারকে অন্যায়ভাবে লাঞ্চিত করে।
আমরা এসব অন্যায় কর্মকা-ের সংবাদ প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখে থাকি। কিন্তু তার প্রতিকারের সংবাদ তেমন একটা দেখি না। দেখলেও কদাচিৎ দেখে থাকি। তাকে আসলে প্রতিকার বলা যায় না। উচিত বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগীরা এক সময় আপস-মীমাংসায় পৌঁছতে যে বাধ্য হয়, আমরা এমনিতেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা অবগত যে, আমাদের দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গরিব রোগীরা অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বে¡ও চিকিৎসা সেবা পায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানে ডাক্তার থাকে না, এমন অভিযোগ উঠে। অভিযোগও পাওয়া যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধ থাকে না। আবার ওষুধপত্র থাকলেও রোগীরা সেই ওষুধপত্র অনেক সময় পায় না। তা বাইরে বিক্রি হয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো অব্যবহৃত হতে হতে অকেজো অবস্থায় বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকে। গরিব মানুষের স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার মতো এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুকূল পরিবেশই থাকে না। মানুষ খুবই অসহায়ের মতো অনেকটা বাধ্য হয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে যায়। তারা কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে যতটা সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার কথা ততোটা পায় না। তার মধ্যে যদি সরকারি দলের ক্যাডারদের দ্বারা একজন ডাক্তার এমনভাবে অপদস্থ হন বা শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হয়ে অপমানিত হন, তাহলে মানুষ আজ যতটুকু স্বাস্থ্য সেবা পায় ততটুকুও পাবে না। আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদের ডাক্তারদের সম্পর্কে যতই নেতিবাচক ধারণা বা কথাবার্তা আমাদের মনের মধ্যে চলমান অবস্থায় থাকুক না কেন, তাই বলে সবাই যে খারাপ তা নিশ্চয়ই বলা ঠিক হবে না। ধরে নিলাম পত্র-পত্রিকায় আমাদের একশ্রেণির ডাক্তারদের কাজ কারবারের খবর দেখলে আমাদের মধ্যে যারা সচেতন কিংবা যারা কেবল পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত নন, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ, তাদের লজ্জায়, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে হয়। তাই বলেতো আমরা ঢালাওভাবে সবাইকে মন্দ বলতে পারি না। যেসব ডাক্তার প্রকৃত অর্থে মানুষের সেবা করতে চান, সেইসব হৃদয়বান ডাক্তারের আমাদের সেবা করার সুযোগ দিতে হবে। ডাক্তার অন্যায় কিছুতো বলেননি। তিনি রোগী দেখতে যাবেন না এমন কথাও বলেননি। শুধু বলেছেন, এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফেলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাসপাতালে দ্বিতীয় কোনো ডাক্তার নেই। জরুরি বিভাগ ফেলে গেলে অসুবিধা হবে। ডাক্তারের এই বক্তব্যের মধ্যে কোনো অন্যায় হয়েছে বলে মনে হয় না। যুবলীগ নেতারা যদি মনে করেন যেহেতু তারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাদের অন্যায় আবদার সবাইকে শুনতে হবে, না শুনলে তাদের মারধর খেতে হবে, তাহলে ভুল করবেন। তাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার জোরে আজকে যারা ইচ্ছেমত অন্যায় কাজ করে যাচ্ছেন, ক্ষমতা যখন হাতছাড়া হবে তখন তারা কি করবেন? নেতারা ক্ষমতার জোরে যতই অন্যায় করেন না কেন, ক্ষমতা হারিয়ে একদিন দেখবেন কোথাও মূল্যায়িত হচ্ছেন না। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যারা উচ্চ পর্যায়ের নেতা আছেন, তাদের উচিত অধস্তন নেতাদের বুঝানো কোনো সরকারি হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তাররা, কোনো সরকারি দলের নেতাদের বাড়ির বেতন ভোগী কর্মচারী নন। তারা জনগণের সেবা করার জন্যে এ পেশায় প্রবেশ করেছেন। আর তাদের বেতন-ভাতাও জনগণ দিয়ে থাকে। সরকারি দলের ফান্ড থেকে দেয়া হয় না।
নেতারা কথায় কথায় বলেন, আমরা জনগণের সেবা করছি। ভালো কথা, তারা দেশবাসীর সেবা করছেন। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যুবলীগ নেতা একজন ডাক্তারকে মারধর করে মানুষের কোন সেবাটা করলেন? একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ডাক্তারের শরীরে হাত তুলে আর যা-ই হোক না কেন, তা জনসেবা হয় না। তা যা হয়, তা হচ্ছে অন্ধ ক্ষমতার চর্চা। অথচ আমাদের নেতাদের প্রায়ই দেখা যায় অন্ধ ক্ষমতার নির্লজ্জ চর্চা করতে গিয়ে সকল ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তুলতে। মাঠে-ময়দানে বক্তব্য দেয়ার সময় মুখে বলেন এক কথা। কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের মুখের কথা আর কর্মের মধ্যে কোনো মিল নেই। আমরা সাধারণ মানুষ মনে করি, সরকারি দলের বড় নেতাদের তৎপর হতে হবে অধীনস্ত নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে। মানুষ এখন সবকিছু কাছ থেকে কিংবা দূর থেকে প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে বুঝতে চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষ কারো রক্ত চক্ষুকে এখন আর আগের মতো ভয় করে চলে না। কেননা এখন আর সেই দিন নেই। এখন সবকিছুর পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মূল্যবোধ এবং মননের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তন সহজ-সরল মানুষের চিন্তার জগতকে নিবিড়ভাবে প্রভাবিত করছে। সময় এসেছে মানুষের জাগরণের। জাগ্রত মানুষ একবার ক্ষেপে গেলে অবস্থাটা কি হয়, অতীতে আমরা এদেশে অনেকবার দেখেছি। নেতাদের বুঝতে হবে ক্ষমতায় তারা চিরদিন থাকবেন না। আজকের দিনে উপজেলা পর্যায়ে জেলা পর্যায়ে ক্ষমতার জোরে মানুষের রাতের ঘুম, মনের শান্তি যারা নষ্ট করেন তারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বন্ধু হতে পারেন না। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা শুধু যে সরকারি হাসপাতালে গিয়েই ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন তা নয়। আমরা পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখতে পাই অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের কার্যাকলাপের নমুনা। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে ক্ষমতাবানদের বড় কর্তারা তাদের নিজ দলীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবেন। যদি তারা কিছুতেই দলীয় উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের ভিতরে রাখতে না পারেন, তাহলে শুধু জনদুর্ভোগই বাড়বে। জনতার অশান্তি যদি বাড়ে তা হলে কি উপরের তলার ক্ষমতাসীন বড় কর্তারা ভালো থাকবেন? ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ক্ষমতার লালসায় একশ্রেণির মানুষের বোধজ্ঞান হারিয়ে যায়। আজকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের দেহে বড় দলের অঙ্গসংগঠনের নেতার হাত তোলায় এই কথা কি প্রমাণ হলো না, তারা ক্ষমতার লালসায় অন্ধ হয়ে গেছেন। তাই বলছিলাম, ক্ষমতাবানদের বোধোদয় হোক। তাদের কর্মীরা ক্ষমতার দাপটে যা করছেন তাতে কেবল পতনই ডেকে আনবে। তাদের জন্যে ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসবে না। ক্ষমতাসীনদের জেনে রাখা উচিত, এই দেশের জনগণ যেমন কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাতে পারে আবার নামাতেও পারে। কথাটা তাদের সকল সময় মনে রাখলে মন্দ হবে না। ভালোই হবে।
লেখক : কবি, গল্পকার ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।