Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

একাদশ সংসদে এ ধরনের বিরোধীদল চায় না আওয়ামী লীগও

বিরোধীদলের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ : রওশনকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিদেশীরা

প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাবিবুর রহমান : নানা কারণে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিদেশীরাও। বিরোধীদল সক্রিয় না থাকায় আড়াই বছরেরও বর্তমান জাতীয় সংসদকে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একাদশ সংসদের এরকম কোনো বিরোধীদল আসুক তা চায় না আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের ঘাটতি নিয়ে পথচলার সমালোচনা মুছতে চায় দলটি। এদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বিরোধীদলকে গুরুত্ব না দেয়ায় সাধারণে মানুষের মধ্যে বিরোধী দলের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আইন প্রণয়ন, মুলতবি প্রস্তাব আনা, সংসদীয় কমিটিগুলোতে সক্রিয়তা, সরকারের সাধারণ সমালোচনায় কোনো কিছুতেই বিরোধী ভূমিকা পালন করতে পারছে না জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। পৌনে তিন বছরের বেশিরভাগ সময়ে সরকারী ও বিরোধীদল মিলে জাতীয় সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সমালোচনা করে সময় কাটিয়েছে। বিএনপিবিহীন বর্তমান জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। এ সংসদে ৯১টি আইন পাস হয়েছে। এসব অধিবেশনে কোনোটিতেই সরকারকে বিরোধীদল জাতীয়পার্টির মুখোমুখি হতে হয়নি। আবার কোনো মুলতবি প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়নি এ দলের পক্ষ থেকে। ৪০ জন এমপি নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান চলমান সংসদে। এর বিপরীতে ১৬ জন স্বতন্ত্র এমপি অনেক বেশি সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই স্বতন্ত্র জোটের রুস্তম আলী ফরাজী ও হাজী মো. সেলিম সরকারের সমালোচনা করে সংসদকে এখনো কিছুটা প্রাণবন্ত করে রেখেছেন। তারা অবশ্য সংসদেই জাতীয় পার্টিকে ‘পাতানো বিরোধীদল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তবে সরকারি দল মনে করছে, দশম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি আড়াই দশকের সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি ভেঙ্গে দিয়েছে। তারা সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করছে। সরকারি দলের মুখে বিরোধীদলের প্রশংসাও এই সংসদের অন্যতম আকর্ষণ। বিরোধীদল সরকারের বিরোধিতা করেনি এবং ফাইল ছুঁড়ে মারেনি।
সংসদের কার্যক্রম বিশ্লেষণকারীদের মতে, জাপার চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা ও মুজিবুল হক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করায় সংসদে বিরোধীদল হিসেবে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্বতন্ত্র এমপি রস্তম আলী ফরাজী, হাজী সেলিমসহ আরও কয়েকজন একাধিকবার জাপাকে ‘কাগুজে বিরোধীদল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য এ বিতর্কে সরকারী দলের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা জাপার সমর্থনে কথা বলেছেন।
বিরোধীদল হিসেবে জাপা বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর ওয়াকআউট করেছিল। এ ছাড়াও তারা বিভিন্ন কারণে একাধিকবার ওয়াকআউট করেছে। এর বাইরে পৌনে তিন বছরে সরকারী ও বিরোধীদলকে কোনো বিষয়ে বড় ধরনের বিতর্কে জড়াতে দেখা যায়নি। বেশিরভাগ সময়ে দুটি দল সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সমালোচনা করে সময় কাটিয়েছে।
বিরোধীদল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, জাতীয়পার্টির বর্তমান বিরোধীদল সংসদ বর্জন করে সংসদকে অকার্যকর করে না। বিরোধীদল সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা এবং মন্দ কাজের নিন্দা করে।
আইন পাসে নিষ্ক্রিয় বিরোধী দল
দশম অধিবেশন পর্যন্ত বর্তমান সংসদে ৯১টি আইন পাস হয়েছে। এসব বিল পাস নিয়ে সরকারী দলকে কখনো প্রধান বিরোধীদলের বাধার মুখে পড়তে হয়নি। তবে আইন পাসের সময় বিরোধীদলের এমপিদের অংশগ্রহণ অপেক্ষাকৃত কম ছিল। জাপার এমপি ফখরুল ইমাম নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিলের ওপর নোটিশ দিয়েছেন। হাতে গোনা কয়েকটি বিলের ওপর নোটিশ দিয়েছেনÑ কাজী ফিরোজ রশিদ, নুরুল ইসলাম ওমর, মাহজাবীন মোরশেদ, সেলিম উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, এম এ হান্নান এবং রওশন আরা মান্নান। বাকিরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এ প্রসঙ্গে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, বিরোধীদল সংসদে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে এবং সংসদীয় কাজে ভূমিকাও রাখছে। বিল পাসের ক্ষেত্রে তারা নিয়মিত নোটিশ দিচ্ছে। প্রয়োজনে ওয়াকআউট করছে কিন্তু সংসদ বর্জন করছে না। এজন্য বর্তমান সংসদ আগের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
মুলতবি প্রস্তাব নেই প্রধান বিরোধী দলের
চলমান সংসদে বিরোধীদল হিসেবে জাতীয় পার্টি থেকে একটি মুলতবি প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়নি। স্বতন্ত্র সংসদ রুস্তম আলী ফরাজী সাতটি মুলতবি এবং হাজী সেলিম ১৪টি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। মুলতবির বিষয় ছিল, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বাতিল নিয়ে আলোচনা, জলবায়ু প্রকল্পে লুটপাট, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে না কমানো, গ্যাস-সংকট, পেট্রলবোমা মেরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলের ট্যাংকারডুবিসহ বিভিন্ন  বিষয়ে। তবে যথাযথ মনে না করায় স্পিকার প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেননি।
জানা গেছে, বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করায় প্রথম থেকেই এই সংসদ নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। দেশ-বিদেশেও এ নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। এত সমালোচনা সত্ত্বেও দশম জাতীয় সংসদেই অর্জিত হয় দুটি বড় অর্জন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এছাড়াও সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সাবের হোসেন  চৌধুরী জাতিসংঘ মহাসচিবের নারী, শিশু, কিশোর ও স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টা পরিষদেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভায় হিউম্যান রাইটস কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের আরেক সংসদ সদস্য এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।
সূত্র জানায়, চলতি মাসে চীনের প্রেসিডেন্টের সম্মানে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ নৈশভোজের আয়োজন করেন। ওই ভোজে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও রওশন এরশাদসহ বিরোধীদলের সদস্যরাও আমন্ত্রণ পান। কিন্তু জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের নেতা হয়েও চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে না পারার মনোকষ্টে অসুস্থতার ভান করে ওই ভোজেও অংশ নেননি রওশন এরশাদ।
এর আগে গত বছরের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সফরের আগে জানা যায়, সফরকালে মোদি বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করবেন। কিন্তু সফরকালে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। বৈঠক করা তো দূরের কথা, মোদি বিরোধীদলীয় নেতার রওশন এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেও আগ্রহ দেখাননি। পরবর্তী সময় জাপার চেয়ারম্যান এরশাদের অনুরোধে রওশানের সাথে নামমাত্র সাক্ষাৎ করেন বারতের প্রধানমন্ত্রী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিরও সাক্ষাৎ পায়নি এ দলটি। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি চীনের রাষ্টপ্রধানের আগমনকে ঘিরেও জাপার পক্ষ থেকে প্রত্যাশা ছিল তার সাথে বিরোধীদল হিসেবে বৈঠক করার সুযোগ পাবে। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এতে করে দলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দারুণভাবে হতাশ। এ প্রসঙ্গে সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপিকে নিয়ে বিশেষ করে শহীদ জিয়া ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাতীয় সংসদে যেভাবে আক্রমণাত্মক ভাষায় বক্তব্য দেয়া হয় তা সত্যিই দুঃখজনক। এটি কার্যপ্রণালীবিধির সুস্পষ্ট লংঘন। এ সংসদকে দেশবিদেশীরা সংসদ সদস্যদের পাতানো সংসদ বলছে। একই সাথে পাতানো বিরোধীদলকেও বড় বড় রাষ্ট্রগুলো গুরুত্ব দিচ্ছে না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ইনকিলাবকে বলেন, শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকায় সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সংসদীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটিগুলো শক্তিশালী হলে দুর্নীতি কমবে। মন্ত্রণালয়গুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। সুপারিশ মানার বিষয়টি বাধ্যতামূলক না হওয়ায় মন্ত্রণালয়গুলো সংসদীয় কমিটির কথাবার্তা আমলে নিচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মোঃ আলী আশরাফ বলেন, বর্তমান বিরোধীদল ভাল ভূমিকা পালন করছে। তবে আগামী একাদশ সংসদে এর চেয়ে আরো ভাল বিরোধীদল আশা করছে সরকার ও দেশবাসী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: একাদশ সংসদে এ ধরনের বিরোধীদল চায় না আওয়ামী লীগও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ