পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টলিন সরকার : হে কবি! নীরব কেন- ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়/ বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়? কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি/ দখিন দুয়ার গিয়াছে খুলি?’ (সুফিয়া কামাল)। ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’ (সুভাষ মুখোপাধ্যায়)। প্রকৃতির নিয়মেই সত্যিই আজ শুরু হচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত। শীতের রিক্ততা, শুষ্কতা ভুলিয়ে ফাগুনের আগুন নিয়ে ঋতু-পরিক্রমায় বাংলা ভাষাভাষীদের জীবন রাঙাতে প্রকৃতিতে ফিরে এসেছে এই ঋতুরাজ বসন্ত। ফুলেল বসন্ত, মধুময় বসন্ত, যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনার আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতায় মনঃপ্রাণ কেড়ে নেয়ার ফাল্গুন মাস। মাতাল হাওয়া, উড়াল মৌমাছিদের গুঞ্জরণ, গাছের কচিপাতা আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার সময়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘আজি এ বসন্তে/ কত ফুল ফোটে/ কত পাখি ডাকে/ কত পাখি গায়...’।
প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল আর বন-বনান্তের কাননে কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহলে ভরে উঠেছে চারদিক। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই তরুণ-তরুণীদের মনেও লেগে যাবে রঙের দোলা। হৃদয় হবে উচাটন। রাজধানী ঢাকায় মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে শহরময় ঘুরে বেড়াবে। বাংলা একাডেমির বই মেলা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা নারীর কলতানে হয়ে উঠবে মুখরিত। বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের চারুকলা, বকুলতলার গাছগাছালির পাতার আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকা বসন্তের দূত কোকিলেরা কী মধুর কুহুকুহু ডাকে ব্যাকুল করে তুলবে বাংলা ভাষাভাষী রাজধানী ঢাকার বিরহী নারীর অন্তর! তা না হলে কবি কবি সুফিয়া কামাল কেন লিখবেন ‘সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাল্গুনের দিনে...’। আর কণ্ঠশিল্পী খন্দকার ফারুক আহমদ বাংলা সিনেমায় কেন গাইবেন ‘বাসন্তী রঙ শাড়ি পড়ে/ কোন বঁধূয়া চলে যায়/ ... / পিছনে ফিরে ফিরে চায়’।
ঋতুরাজ বসন্ত বাংলা ভাষাভাষীদের গৌরবের মাস। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর ’৫২ সালে বাংলা ফাল্গুন মাসেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়, যার চূড়ান্ত পরিণত ’৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়। বসন্তেই বাংলার মানুষ দেশমাতৃকার আবেদনে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। এই বসন্তেই বাংলার মানুষ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে। তাই হয়তো কবি ফররুখ আহমেদ লিখেছিলেন, ‘ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী/ ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙানির/ একঝাঁক পাখি এসে ঐকতানে/ গান গায় একসাথে ভোর বিহানে/ আযানের সুর মেশে নীল আকাশে/ শির শির করে ঘাস হিম বাতাসে’। আর আমাদের জাতীয় সংগীতে ‘ফাগুনে তো আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’। সত্যিই তাই। ফাগুন মাসেই আমগাছে মৌল ধরে। আম পছন্দ করেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে কি আছে?
ঋতুচক্রে বছর ঘুরে বসন্ত আসে। বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনে পালিত হয় ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’। এ উৎসব গ্রামেগঞ্জে পালিত যেমন হচ্ছে, তেমনি রাজধানীর শিক্ষিত মহলেও হচ্ছে। নগরে বসবাসরত মানুষের আর্থিক সংগতি থাকায় ঢাকায় কার্যত এ উৎসব পরিণত হয়েছে সর্বজনীন প্রাণের উৎসবে। নাচুনে বুড়ির মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরুকলার ছাত্রছাত্রীরা নেচে ওঠেন সবার আগে। বসন্তের প্রথম মুহূর্তকে ধরে রাখতে সবাই মেতে ওঠে নানা উৎসব ও সাজে। বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে তরুণী ও নারীরা ঘর থেকে বের হন। সে শাড়িতে বাংলার নারীকে অপরূপ দেখায়। অনেক ফুলের বাহারে সজ্জিত হলেও গাঁদা ফুলের রঙকেই পোশাকে ধারণ করতে দেখা যায় তরুণ-তরুণীদের। খোঁপায় শোভা পায় গাঁদা ফুলের মালা। কিশোরী-তরুণীরা ছাড়াও বিবাহিত নারীরাও শিশুদের একই সাজে সাজিয়ে সঙ্গে নিয়ে বের হন। ঘুরে বেড়ান শহরের পথে প্রান্তরে।
বাংলায় এই বসন্ত উৎসবের একটা ঐতিহ্যময় ইতিহাস রয়েছে। মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। তিনিই নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন। অবশ্য ইসলাম এটাকে ধর্ম সমর্থন করে না। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা আজকালের মতো ছিল না। কিন্তু অন্য ঋতুর চেয়ে এই ঋতুকে পালন করা হতো উৎসবের মধ্য দিয়ে আলাদাভাবে। বাংলাদেশে উৎসব পালনের গ্রামে-গঞ্জে প্রচলন থাকলেও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে তেমন জৌলুস ছিল না। আর শহুরে মানুষের মধ্যে তেমন দেখা যায়নি বসন্ত পালন। কিন্তু গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতি বাংলার মানুষের হৃদয়ের যে টান তা তো নতুন নয়। হঠাৎ করেই ঢাকার আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষ দিবসটি পালরেন প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। দিল্লির মুসলিম স¤্রাট আকবর প্রবর্তিত (ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক নেই) ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে রাজধানী ঢাকার শিক্ষিত সমাজ ২১ বছর আগে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সালে প্রতিবছর ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন থেকে বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে ঢাকঢোল পিটিয়েই। মূলত ’৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ গঠন করা হয়। তারাই রাজধানী ঢাকায় এ উৎসব পালন করে থাকে। দিবসটিতে তরুণ-তরুণীরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ধানমন্ডি লেক, বলধা গার্ডেনসহ গোটা শহরকে দিনভর মাতিয়ে রাখেন। ঘুরে বেড়ানো, গান বাজনা, খাওয়া-দাওয়া, নাগরদোলা চড়া ইত্যাদি চলবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। দিনভর চলবে বসন্তের উচ্ছ্বাস প্রকাশ। বাদ যাবে না গণমাধ্যমগুলোও। ফোন, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়; মতামতের লেনাদেনা। কিন্তু সেটা যেন সভ্যতা-ভব্যতা, শালীনতার মধ্যেই থাকে সেটাই কাম্য। কারণ পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে শিক্ষিত কিছু তরুণ-তরুণী যা করছে, তা কোনোভাবেই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের কর্ম নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবছরের মতো এবারও সকাল ৭টায় চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় যন্ত্রসংগীতের মূর্ছনার মধ্য দিয়ে শুরু হবে বসন্ত আবাহন। চলবে দুপুর পর্যন্ত। আবার বিকেলে শুরু হয়ে চলবে রাত পর্যন্ত বসন্ত বন্দনার উৎসব। এ ছাড়া বিকেলে বসন্ত আবাহনের উৎসব চলবে পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক, ধানম-ির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ, উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চ ছাড়াও বিভিন্ন পাড়া মহল্লায়। বাংলা একাডেমির বই মেলায় বাসন্তী উৎসব আলাদা মাত্রা নিয়ে আসবে।
রাজনৈতিক সহিংসতা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা-বিভাজনের কারণে এদেশের মানুষের ঘরে উৎসব কমই আসে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভয়-ভীতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে নগরবাসীকে জীবন ধারণ করতে হয়। ধর্মীয় না হোক প্রকৃতির এ উৎসব সবার মধ্যে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ ও সৌহার্দ্য। ঢাকার রাজপথ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্পট বাসন্তী রঙ ধারণ করুক। আমাদের মেয়ে-বোনেরা একদিন বাসন্তী শাড়ি পরে হারিয়ে যাক না প্রকৃতির মধ্যে। কিন্তু সেটা যেন অশ্লীলতার পর্যায়ে না যায় সে সতর্কতা থাকা আবশ্যক। কারণ মহানবী (সা.)-কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেছেন, ‘বিশ্বাসী মুসলিম নারীদের বলবে, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে; তাদের সতীত্ব রক্ষা করে; মুখম-ল, হাতের কব্জি বাদে দেহের অন্যান্য অংশ উন্মুক্ত না করে; চাদর দিয়ে সারা শরীর মুড়ে নেয় এবং নিজেদের স্বামী, বাবা, শ্বশুর, ছেলে, সৎ ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, মুসলিম নারী, মালিকানাধীন দাসী, অধীনস্থ বৃদ্ধ এবং নাবালক শিশুদের ছাড়া অন্যদের কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে’ (সূরা আন-নূর ২৪:৩১)। তিনি আরো বলেছেন, ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রী-কন্যাদের ও বিশ্বাসী মুসলিম পুরুষদের স্ত্রীদের বলো, তারা যেন নিজেদের গায়ে আবরণ টেনে দেয়। এতে তারা সম্ভ্রান্ত মহিলা হিসেবে পরিচিতি পাবে, ফলে তাদের উত্ত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে’ (সূরা আল-আহযাব ৩৩:৫৯)। শাড়ি নারীর সৌন্দর্য হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। আবার সে শাড়ি যদি হয় বাসন্তী রঙের। বাসন্তী রঙের শাড়ি শুধু কবি, শিল্পীদের নয়; সাধারণ মানুষের চোখেও চমক লাগিয়ে দেয়। সবাই সুন্দরের পূজারি। তবে ইচ্ছা থাকলে বসন্ত উৎসবে বাসন্তী শাড়ি পরে উৎসবের মধ্যেই আমাদের মা-খালা-বোনেরা শালীনতা, সভ্যতা-ভব্যতা রক্ষা করতে পারেন। পোলান্ডের চেসোয়াভ মিউশ নামের এক কবি লিখেছেন, ‘স্পষ্টতই অবশ্যই আমি যা বস্তুত ভাবি না, তা বলিও না/ ভদ্র সমাজের জন্য ভক্তিটক্তিই যথাযথ/ মামুলি শরীরের বিষণœ গোপনীয়তাকে প্রকাশ করা কারও উচিত নয়।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।