Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আব্বাসউদ্দীনকে নিয়ে কেন এই আত্মপ্রবঞ্চনা?

প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:৩৫ এএম, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬

স্টালিন সরকার
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়’ ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ কালজয়ী এ গানগুলোর কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের জন্মদিন নীরবেই চলে গেল। হিন্দুত্ববাদী শিল্প-সংস্কৃতি-সংগীতের রমরমা বাজারে ইসলামি গানের মাধ্যমে ‘মুসলিম জাগরণ সৃষ্টি’ করা এই শিল্পীর ১১৫তম জন্মদিন ছিল ২৭ অক্টোবর। ১৯০১ সালে তৎকালীন ভারতের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোন্ গান করেননি? আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান, উর্দুগান সবই গেয়েছেন দরাজ গলায়। তৎকালীণ সময় মুসলমানদের প্রতিকূল পরিবেশে ইসলামি গান উপমহাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমানদের সংস্কৃতির বারতা তুলে ধরেছেন। এখনো ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে ... ’ গান শুনতে উন্মুখ হয়ে থাকেন কোটি কোটি মুসলমান। বাংলা গানের মুসলিম রেঁনেসার এই শিল্পী কি অবহেলিতই থাকবেন? তাঁর জন্মদিন পালনে কোথাও কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। অথচ অন্যান্য কবি-শিল্পীদের স্মৃতি ধরে রাখতে কতই না আয়োজন। আব্বাসের জন্মদিনে বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহকরা নীরব থাকবেন স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, ইসলামি ধারার দল ও সামাজিক সংগঠন নীরব কেন? সংগীতাঙ্গনে ইসলামি ধারার গানকে মূলধারায় নিয়ে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় করেছেন যে শিল্পী সে শিল্পীর জন্মবার্ষিকী নীরবে চলে গেল?
উপনিবেশিক শাসনামলে এ অঞ্চলের মানুষ যখন নানান কিচিমের গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন; তখন মুসলমানরাও সেই শ্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। দেশজ শিল্প-সংস্কৃতিতে গজল, কাওয়ালি, হামদ-নাত ছাড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্ম-পরিচয়ের তেমন কিছুই ছিল না। তখন আব্বাসউদ্দীন তার কণ্ঠে মুসলিম হৃদয়ে ইসলামি গানের নবজাগরণ সৃষ্টি করলেন। কবি নজরুল ইসলাম লিখতেন আর আব্বাসউদ্দীন তা গাইতেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের যখন সাংস্কৃতি জগতে সুর-তরঙ্গ লহরিতে একেবারেই অচেনা অবস্থা তখন কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও সুর করা রোজা, নামাজ, হজ, জাকাত, শবেবরাত, ঈদ, ফাতিহা, নাতেরসূল, ইসলামি গজল প্রভৃতি গান গেয়ে আব্বাসউদ্দীন বাঙালী অঞ্চলে ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি করেন। তখন থেকে শুরু হয় সংস্কৃতিতে মুসলিম সমাজের জাগরণ।
ইংরেজ শাসনামলে মুসলমানদের জন্য ছিল বৈরি পরিবেশ। সংগীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের তেমন সমৃদ্ধ গানও ছিল না। ওই বৈরী সময়ের বিজাতীয় সংস্কৃতির শ্রোত ঠেলে উত্থান ঘটে আব্বাসউদ্দীনের। উপমহাদেশে ইসলামি সঙ্গীতের খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা-প্রচলন ছিল না। এমনিতেই মুসলমানদের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ; তারপর বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাদর্শ। মুসলিম সমাজে কেউ কেউ ‘গান হারাম’ এমন প্রচারণা করতেন। আব্বাসউদ্দীন মুসলমান নাম নিয়েই গান শুরু করেন এবং তার বিশেষ গায়কী ঢং ও সুরেলা কণ্ঠ প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে নিয়ে আসেন ইসলামি গান। ইসলামি গান যে এতো জনপ্রিয় হতে পারে আব্বাসউদ্দীনের যুগের আগে মানুষের মধ্যে সে ধারণাই ছিল না। আধুনিক, ইসলামি গান, পল্লীগীতি সব গানই তার কণ্ঠে ছিল। তবে পল্লীগীতিতে মৌলিকতা বেশি। তাঁর দরদী কণ্ঠে বিশুদ্ধ উচ্চারণ ভঙ্গি, অনুপম সুরেলা কণ্ঠ, তাল-লয় ও মাত্রাজ্ঞান সমন্বিতের মাধ্যমে নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করে। ইসলামী গান যে অন্য যে কোনো গানের চেয়ে মানুষের হৃদয়ে বেশি নাড়া দেয় সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন।
ধরলা, তিস্তা ব্রহ্মপুত্রসহ রংপুর অঞ্চলের নদী অববাহিকার মানুষের প্রাণের গান ভাওয়াইয়া। এই ভাওয়াইয়া ওই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিকে করেছে বেগবান। দুঃখ-বেদনা, সুখ-সমৃদ্ধি সর্বোপরি যাপিত জীবন উঠে এসেছে ভাওয়াইয়া গানের কথায়-সুরে। তার রচিত ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই...’ গান রচনার কাহিনী গত মাসে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে শুনেছি। কত বড় মাপের শিল্পী হলে তাৎক্ষণিক এমন গান লেখা সম্ভব! গানের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে জাগরণ সৃষ্টিকারী সেই আব্বাসউদ্দীনকে অবহেলা কি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মুল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের আত্মপ্রবঞ্চনা নয়?
সনাতন ধর্মের কালচারের সুতিকাগার কোলকাতা মহানগরীতে শিল্পী জীবন শুরু করেন আব্বাসউদ্দীন। অন্যান্য শিল্পীদের ভিড়ে পাত্তা পাচ্ছিলেন না। নানা প্রতিকূলতায় কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানিতে দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন বিমল দাশগুপ্তের সহায়তায়। শৈলেন রায়ের লেখা গান দুটি হলো ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝরে গো’ এবং ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়’। অতপর লোকগীতির পাশাপাশি ইসলামি গান সংযোজন করেন। ইসলামি গান গেয়ে আব্বাসউদ্দীন তৎকালে সংস্কৃতিক অঙ্গণে অনুপস্থিত বাঙালি মুসলমানের দীনতা ঘুচান। অথচ ইসলামি গান মানুষ পছন্দ করনে না এ কারণে তার গান রেকর্ড করতেই চাইতো না কোম্পানি। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন সুর দিয়েছেন আর আব্বাসউদ্দীন বলিষ্ঠ দরদি কণ্ঠে সে গান গেয়েছেন। ওই গান মুসলিম সমাজকে নাড়াই দেয়নি; অন্যান্য ধর্মালম্বীদের হৃদয় জয় করেছে। তিনি পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়ার পাশাপাশি ৮৪টি ইসলামি গান রেকর্ড করেন। কাজী নজরুলের গান তার কণ্ঠের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে মুসলিম রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটে। যার ইসলামী গান এখনো বাংলার মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন তুলছে সেই শিল্পী প্রতি আমাদের কেন এই অবহেলা?



 

Show all comments
  • md abdul kadir ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৫৮ এএম says : 0
    আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে শিকড়হীন জাতি হিসাবে পরিচয় দিচ্ছি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আব্বাসউদ্দীনকে নিয়ে কেন এই আত্মপ্রবঞ্চনা?
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ