ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
কে এস সিদ্দিকী ; চোর-ডাকাতের কোনো ধর্ম থাকে না। চুরি, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি করে মানুষের অর্থ লুট করাই তাদের পেশা ও নেশা। কথায় বলে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। চোর, ডাকাত, হামাদ, দস্যু, দুর্বৃত্ত সবাই একই চরিত্রের। ওরা নানা রূপ ধারণ করতে পারে। শয়তানি প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে যত সব অন্যায়-অপকর্ম করাই ওদের ধর্ম। ওরা যে কোনো সম্প্রদায়ের লোক হতে পারে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই শ্রেণির লোক সকল দেশে, সকল যুগে বিদ্যমান ছিল, আছে। ওদের কাহিনীতে ইতিহাস পরিপূর্ণ। ভ--সাধক-দরবেশ বা সাধুসজ্জন সেজে ওরা শয়তানের পীঠে সওয়ার হয়ে চলতে পারে। ওদের অসংখ্য রূপ আছে। ধর্মীয় রূপ ধারণ করতে পারলে কম খরচে অধিক লাভের সুযোগ অনেকটা সহজ। কিছু ধর্মীয় বুলি আওড়াতে পারলে প্রবঞ্চনা প্রতারণার পথের বাধা শয়তানই দূর করে দেয়। বিশেষত ভ--তাপসরা সরল মানুষদের সহজে কাবু করে নেয়। ইতিহাসে এরূপ ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। এরূপ ভ--তাপসরা যদি কোনো সতর্ক-সচেতন লোকের পাল্লায় পড়ে তাহলে তারও সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। ‘কিতাবুল আজকিয়া’ (বুদ্ধিমানদের গ্রন্থ) নামক এ গ্রন্থে বহু অদ্ভুত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অনেক খ্যাতনামা লেখক এ গ্রন্থের বরাতে বিভিন্ন কাহিনী-ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আল্লামা কামালুদ্দীন দামিরী সাফেঈ তার বিখ্যাত ‘হায়াতুল হায়ওয়ান’ নামক (জীবজন্তুর ইতিহাস) গ্রন্থে বাগুলুন অর্থাৎ খচ্চর শব্দের বর্ণনা দিতে গিয়ে একটি কাহিনীর উল্লেখ করেছেন। তারই সূত্রে আমরা সে কাহিনীটি এখানে উদ্ধৃত করছি, যা পাঠ করলে অনুমান করা কঠিন হবে না যে, বর্ণচোরার দল কীভাবে ধর্মীয় রূপ ধারণ করে সন্ত্রাসী কায়দায় মানুষকে লুট করে নিজেদের আখের গোছানোর অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে। সমাজের এরূপ দুষ্টু চরিত্রকে চিনতে হবে। তাদের শুধু চিনলেই চলবে না, তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার পাশাপাশি তাদের ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর তৎপরতা প্রতিহত করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। এবার ঘটনাটি পাঠ করা যাক। কোনো কোনো লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী, একবার জনৈক ফওজি সৈনিক কোনো উপলক্ষে সিরিয়ায় একটি জনপদ ধরে যাচ্ছিলেন। কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করার পর তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। তার পক্ষে অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তার সোয়ারী ছিল একটি মাদি খচ্চর। তার প্রয়োজনীয় সফর সামগ্রী খচ্চর বহন করছিল। সন্ধ্যা বেলাও ঘনিয়ে আসছিল। ফওজি এক বিশাল গির্জা ঘর দেখলেন। দেখলেন, সেখানে একজন পাদ্রি বসবাস করেন। পাদ্রি তাকে দেখে স্বাগত জানান এবং তিনি তার এখানে রাত যাপন সম্পর্কে জানতে চান, যাতে তিনি ফওজির মেহমানদারি করার ব্যবস্থা করতে পারেন। তাই ফওজি পাদ্রির অতিথিপরায়ণ মনোভাব দেখে মুগ্ধ হন এবং সেখানে রাত যাপনে রাজি হয়ে যান।
ফওজি বর্ণনা করেন, আমি যখন গির্জা ঘরে প্রবেশ করি, তখন সেখানে পাদ্রি ব্যতীত কাউকে দেখতে পাইনি। এ সময় পাদ্রি আমার খচ্চরটি একদিকে নিয়ে বেঁধে রাখেন এবং তার খাবারের জন্য চারা ঘাসের ব্যবস্থা করেন এবং আমার জিনিসপত্র একটি কক্ষে নিয়ে রেখে দেন। পাদ্রি গরম পানি নিয়ে আসেন। ভীষণ শীত পড়ছিল। এটি ছিল বরফ পড়ার সময়। তিনি আগুন জ্বালান এবং খুবই উত্তম খাবার পেশ করেন। আমি খাবার গ্রহণ করি। রাতের এক প্রহর শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি শোবার প্রস্তুতি পূর্বে তার কাছ থেকে জেনে রাখি যে, বাথরুম কোন দিকে। তিনি বললেন, বাথরুম উপরে এবং সেখানে যাওয়ার পথও আমাকে দেখিয়ে দেন। এরপর পাদ্রি চলে যান।
আমি বাথরুম করার জন্য যখন উপরে উঠি এবং বাথরুমের দরজায় পা রাখি তখন একটি বিশাল কংকর ভূমি দৃষ্টিগোচর হয় এবং যখন তাতে পা রাখি তখন ধপাস করে ওই ময়দানে পতিত হই, যা গির্জা ঘরের বাইরে অবস্থিত। মনে হয় ওই বদবখত ছাদটি এভাবে ঝুলন্ত বানিয়েছিল যে, তাতে সামান্য ভারী জিনিস স্পর্শ করা মাত্র পড়ে যায়। আমি পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে চিৎকার করতে থাকি, কিন্তু পাদ্রির কোনো সাড়াশব্দ নেই। শরীরে আমার চোট লাগলেও কোনো হাড়গোড় ভাঙেনি। এ বরফ রজনীতে কড়া শীতে থরথর করে কাঁপছিলাম। এ সময় ওপর থেকে একটি ভারী পাথর এসে পড়ে। যদি তা আমার ওপর পতিত হতো তাহলে আমার রক্ষা ছিল না। আমাকে পিশে ফেলত। আমি সেখান থেকে বের হয়ে পালানোর চেষ্টা করি। সে সময় আমি পাদ্রিকে গালাগাল করতেও শুনতে পাই, যা আমার প্রতি বর্ষণ করা হচ্ছে। এতে আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, আর যাই হোক, এসব কারসাজি এ কমবখত পাদ্রির দুষ্টমি, যে আমাকে লুট করার এবং আমার প্রাণনাশের চেষ্টায় রত।
আমি যখন মেহরাব হতে বের হয়ে আসি, তখন বরফ পড়ছিল। এ অবস্থায় আমি খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার সারা শরীর এবং কাপড় ভিজে একাকার। তখন আমি চিন্তা করতে থাকি, প্রাণরক্ষার কোনো উপায় বের করতে হবে। তা না হলে ভোর হওয়া পর্যন্ত শীতে ঠক ঠক করে হয়তো আমি মরেই যাব। সে সময় আমার মনে একটি উপায় জাগ্রত হয় যে, এক-দুই-তিন কেজি ওজনের পাথর তালাশ করে কাঁধে বহন করে এদিক সেদিক হয়ে মাঠে পালিয়ে যাব। সুতরাং এ উপায়টি আমি অবলম্বন করি, যার ফলে শরীরে উত্তাপ সৃষ্টি হতে থাকে। অতঃপর পাথর ফেলে দিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর আবার শীতের আক্রমণে অস্থির হয়ে পড়ি। ফের পাথর উঠিয়ে পূর্বের ন্যায় ব্যায়াম করি। মোট কথা, সকাল পর্যন্ত এরূপ অবস্থা ছিল। সূর্য উদয়ের পূর্বে আমি গির্জার দরজা খোলার শব্দ শুনতে পাই। আমি অগ্রসর হয়ে দেখতে পাই পাদ্রি বের হচ্ছেন। তিনি আমাকে রাতে অবস্থান করা স্থানে অর্থাৎ ছাদের ওপর থেকে পতিত স্থানে তালাশ করেন এবং সেখানে আমাকে না পেয়ে বলতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত লোকটি কোথায় পালিয়ে গেল? আমি পাদ্রির কথা শুনেছিলাম। ইত্যবসরে পাদ্রি সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আমি তার পেছনে পেছনে যেতে থাকি; আস্তে আস্তে গির্জায় প্রবেশ করি এবং কপাটের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকি। পাদ্রি আমাকে তালাশ করে না পেয়ে ফিরে আসেন এবং এসেই দরজা বন্ধ করতে থাকেন, আমি একদিকে লুকিয়ে দাঁড়ানো। যখনই তিনি ফিরে আমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন দ্রুত আমি খঞ্জর বের করে তাকে নিচে ফেলে দেই এবং বুকে চেপে বসে খঞ্জর ঢুকিয়ে তাকে খতম করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। অতঃপর গির্জার দরজা বন্ধ করে উপরে উঠি। পূর্ব থেকে যে আগুন জ্বলছিল, তা লাকড়ি দিয়ে আরো প্রজ্বলিত করি এবং শরীর ভালোভাবে সেকে তপ্ত করি। অতঃপর শরীরের ময়লা কাপড় খুলে অপর কাপড় পরিধান করি এবং পাদ্রির চাদর ঢেকে শুইয়ে পড়ি। নির্ঘুম অবস্থায় রাত কেটেছিল, তাই গভীর নিদ্রা হয়। আসরের সময় জাগ্রত হই। তখন খুব খিদে পেয়েছিল। জাগ্রত হওয়ার পর গির্জায় ঘোরাফেরা করি। বাবুর্চিখানায় গিয়ে দেখি খাবারের বিরাট সমাহার। তৃপ্তির সাথে খাবার খাওয়ার পর মনে হলো নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, মনেও বেশ ফুর্তি অনুভব করতে থাকি।
গির্জার চাবিগুলোও আমি সেখানে পেয়ে যাই এবং শান্তিপূর্ণভাবে আমি প্রত্যেকটি কক্ষ খুলে দেখতে থাকি সেগুলোতে সব প্রকারের দ্রব্যসামগ্রীর সম্ভার, মূল্যবান জিনিসপত্র, সোনা, রূপা, সোয়ারির হাওদা, নানা প্রকারের যন্ত্রপাতি এবং বহু রকমের জিনিসপত্রে পরিপূর্ণ। এসব কিছু পর্যবেক্ষণ করার পর আমার বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, পাদ্রি ছিল এক প্রকারের ডাকাত, যে কোনো মোসাফিরকে একাকী সে পথে গমন করতে দেখলে আমার সাথে যে ধরনের আচরণ করেছে, অনুরূপ আচরণ অন্যান্যদের সাথেও করে থাকে এবং তাদেরকেও প্রতারণা-ধোঁকার মাধ্যমে দ্রব্যসামগ্রী কেড়ে নেয়। এখন আমি চিন্তা করেছি যে, এ বিশাল ভা-ার আমি এখান থেকে কীভাবে স্থানান্তর করব এবং নিজের ব্যাপারে এ পথে যাতায়াতকারীদের সন্দেহ যেন না হয়। হঠাৎ একটি উপায় মনে হলো যে, ভোরে পাদ্রির পোশাক পরিধান করি এবং গির্জায় গিয়ে ছাদে ঘোরাফেরা করতে থাকি। নিচ দিয়ে চলাচলকারীরা মনে করতে থাকে যে আসল পাদ্রি রয়েছে। আর যারা নিকট দিয়ে চলাচল করে, তাদেরকে দেখে আমি অন্যদিকে মুখ করে থাকি।
এভাবে কয়েক দিন অতিবাহিত হয়ে যায়, কিন্তু কেউ আমার অবস্থা জানতে পারেনি। এরপর অনেক অনুসন্ধানের পর আমি দুটি থলে সংগ্রহ করি এবং সেগুলোতে উত্তম ও মূল্যবান জিনিসপত্র ভর্তি করি। অতঃপর পাদ্রির পোশাক খুলে ফেলে আমার নিজের পোশাক পরিধান করি। থলে দুটি আমার খচ্চরে বোঝাই করে পার্শ্ববর্তী একটি বস্তিতে গমন করি এবং বাসা ভাড়া করে সেখানে অবস্থান করতে থাকি। সুযোগ মতো গির্জার মালসামানগুলো খচ্চরে বহন করে এ বাসায় স্থানান্তর করতে থাকি। যেহেতু সামান ছিল বিপুল পরিমাণে, তাই খচ্চরের বোঝার সমপরিমাণ করে প্রথম দিকে স্থানান্তরের কাজ চলতে থাকে। এসব সামান ছিল কমমূল্যের কিন্তু ছিল মূল্যবান ও উত্তম। তবে ভারী ও বৃহদাকারের জিনিসপত্র সেখানে রেখে দেই। সর্বশেষে একদিন এই ব্যবস্থা করি যে, বহু খচ্চর ও গাধা ভাড়া করে এবং শ্রমিক নিয়ে গির্জার অবশিষ্ট সকল ভারী জিনিসপত্র উঠিয়ে নিয়ে একটি কাফেলার সাথে চম্পট দেই এবং গণিমতের সমস্ত মালসামান নিজের বাড়িতে নিয়ে আসি। দামি মূল্যবান জনিসিপত্র প্রচুর ছিল। হিসাব করার পর দেখা গেল আশি হাজার দেরহাম। প্রচুর আশরফি এবং বিপুল পরিমাণের উত্তম উৎকৃষ্ট দ্রব্যসামগ্রী আমার হস্তগত হয় এবং এগুলো হতে অতি দামি মালসামান আমি জমিনে পুঁতে রাখি, যার খবর কেউ জানে না।
পাদ্রি নামের এক ডাকাতের কবলে পতিত হওয়া এক সৈনিকের আত্মরক্ষার এবং তথাকথিত পাদ্রিকে হত্যা করে তার গির্জার সমূদয় অর্থ-সম্পদ গণিমতের মাল হিসেবে অধিকার এক অভিনব ও দুঃসাহসিক বিস্ময়কর কাহিনী। সৈনিকের উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা কেবল তাকেই ডাকাতের কবল হতে মুক্ত করেনি, বরং এ দুর্ধর্ষ ডাকাতকে কৌশলে হত্যা করে নিরীহ মানুষকে তার হিং¯্র থাবা হতেও নিরাপদ ও মুক্ত করে। এরূপ দুঃসাহসিক নির্ভীক ও বুদ্ধিমান সৈনিক যে সমাজে বাস করে সেখানে ভ--প্রতারক এবং দস্যু-দুর্বৃত্তদের ঠাঁই হতে পারে না। তাই এ সৈনিকের প্রশংসনীয় ভূমিকা একটি স্মরণীয় আদর্শিক ঘটনা হিসেবে গণ্য হয়ে আছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।