Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীর সড়কে চরম নৈরাজ্য

যত্রতত্র উঠা-নামা করছে যাত্রী : বাড়ছে বিশৃঙ্খলা

কামাল আতাতুর্ক মিসেল | প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০২ এএম

কোনও নিয়মই মানা হচ্ছে না রাজধানী ঢাকায় চলাচলরত গণপরিবহনে। সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা-কেউই তোয়াক্কা করছে না কোন নিয়মনীতির। চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে যাত্রীদের প্রাণহানি, অঙ্গহানি হচ্ছে। আবার একইভাবে নামতে গিয়ে চাকায় পিষ্ট হওয়ার ঘটনাও নতুন নয়। এমন নৈরাজ্য বন্ধে বেশ কয়েক মাস আগে পুলিশ কিছু নির্দেশনা জারি করলেও তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে গণপরিবহনে যত্রতত্র ওঠানামা করায় এতে যেমন যানজট হচ্ছে, তেমনি সড়কে বিশৃঙ্খলাও বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিবহন খাতে নিয়ম-নীতির অভাবেই এ অবস্থা। কেবল সদিচ্ছার মধ্য দিয়েই এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করছেন তারা। আর বাস মালিক সমিতি বলছেন সুপরিকল্পিত বাস স্টপেজের অপ্রতুলতার কারণেই চালকরা বাধ্য হচ্ছেন যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠা নামা করাতে।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে লাগানো নতুন সাইনবোর্ড ‘এখানে বাস থামবে না’, ‘বাস থামানো নিষেধ’, ‘বাস স্টপেজ শুরু’ কিংবা ‘বাস স্টপেজ শেষ’সহ নানা ধরনের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। এই সকল সাইনবোর্ডে কোনো উপকারে আসছে না বা নিয়ম মানা হচ্ছে না বাসচালক কিংবা যাত্রীদের সচেতন করতে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকেও তেমন তাড়া দিতে দেখা যায়নি। মোড়ে এসে বাসগুলোর মধ্যে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা আগের মতোই রয়েছে। ফলে সড়কে মহাবিশৃঙ্খলা সহজে পিছু ছাড়ছে না রাজধানীবাসীর।

গত দু’দিনে রাজধানীর যেসব স্থানে এমন সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে সেসব স্থানে গিয়ে দেখা যায়, নিয়ম মেনে নির্ধারিত স্থানে থামছে না বাস, বরং আগে যেভাবে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো হতো সেভাবেই চলছে। পল্টন মোড় থেকে গুলিস্তান আসতে বাস স্টপেজ মুক্তাঙ্গনের সামনে থাকলেও বাস থামে পল্টন মোড়েই। বাংলামোটর মোড়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর জন্য নতুন করে বাস স্টপেজ করা হয়েছে। ফলে বাংলামোটর থেকে কারওয়ান বাজার যেতে যে বাস স্টপেজ আছে, সেটিও কাজে লাগছে না। ফলে জায়গাটি খালি পড়ে থাকে।

মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে পল্টন-শাহবাগ হয়ে চলমান গাড়িগুলোকে দেখা গেছে শাপলা চত্বর থেকেই যাত্রী ওঠাচ্ছে। চত্বরের একটু সামনেই করা হয়েছে নতুন বাস স্টপেজ। তবে কেউ সেখানে অপেক্ষা করে না। সবাই শাপলা চত্বর থেকেই অনিরাপদে গাড়িতে উঠছে। আবার নতুন বাস স্টপেজের সাইনবোর্ড অনেকের চোখে পড়ছে না। কারণ সাইনবোর্ডের আশপাশে হকাররা বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছে। এতে বাসগুলো আগের জায়গায় থেমে আগের মতোই মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনেই যাত্রী ওঠানো-নামানোর কাজ করছে। দৈনিক বাংলায় ডিউটিরত ট্রাফিক পুলিশ আনোয়ার বলেন, যারা নিয়ম মেনে বাস চালাচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় আমাদের লোকবল পর্যাপ্ত না থাকায় কেউ কেউ নির্বিঘেœ চলে যাচ্ছে। তবে ধীরে ধীরে সবাই অভ্যস্ত হলে এমন সমস্যা আর থাকবে না।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা। নটরডেম কলেজের সামনে দিয়ে সড়কে দ্রত গতিতে ছুটে চলেছে বিভিন্ন গণপরিবহন। সড়কের মাঝে হঠাৎ থামলো জোনাকি পরিবহনের একটি বাস। ভেতর থেকে নামছেন ১ নারী ও এক শিশু যাত্রী। তখনো সড়কের মাঝে দাঁড়ানো বাসের দুই পাশ দিয়েই ছুটে চলেছে পেছনে থাকা গণপরিবহনগুলো। তখনো সড়কের মধ্যবর্তীস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন বাস থেকে নামা যাত্রীরা। শিশুটিকে কোলে তুলে সড়কের এক পাশে যাওয়ার জন্য তারা বার বার হাত তুলে ইশারা করছেন চলন্ত বাস, প্রাইভেটকার ও সিএনজি থামানোর জন্য। শিশুটি ভয়ে কান্না করছে।
সড়কের পাশের মানুষজনও সেদিকে তাকিয়ে আছেন। এভাবে কেটেছে প্রায় ৩ মিনিট। পরক্ষণে অন্য পরিবহনের একটি বাস তাদের সামনে এসে দাঁড়ালে তারা সড়কের এক পাশে যান। তখন সড়কের মাঝখানে দাঁড়ানো যাত্রী মৌমিতা বলেন, অল্পের জন্য আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন। বাসের ড্রাইভার আমাদের রাস্তার ওপর নামিয়ে দিয়েছেন। তাদেরকে অনেক বার বলেছি সাইট করে নামানোর জন্য। তারা আমার কথা শুনলো না। এমন চিত্র রাজধানীতে নিত্যদিনের ঘটনা। রাজধানী ঢাকা শহরের প্রত্যেকটি সড়কেই অহরহ ঘটছে এমনটি।

মতিঝিলের পর রাজধানীর পল্টন। চলন্ত বাস থেকে ঝুঁকি নিয়ে পথে নামলেন মোস্তাফিজুর রহমান। কেন ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামলেন, জানতে চাইলে সহজ স্বীকারোক্তিতে দায় চাপালেন চালক হেল্পারের ওপর। আমি নামতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওরা প্যাসেঞ্জার পাওয়ার জন্য নামতে বলেছিল। এজন্য আমি নেমে এসেছি। বলছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, যারা রুট পারমিট দেয় তারা একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করে যাত্রী ধরার একটা প্লানিং করেছে। সবাইকে যদি এক ছাতার নিচে নিয়ে এসে এক রংয়ের বাস যদি দেয়া যায়, দিনের শেষে যদি যারা যার শেয়ার নেয়া যায় এবং চালককে ব্যবসা করতে না দিয়ে তাকে যদি বেতনভুক্ত করা যায় তাহলে একটা দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখা যাবে।

এদিকে যাত্রী নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার কথা স্বীকার করে বাস মালিক সমিতি বলছে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, অ্যাসোসিয়েশন থেকে স্পষ্টভাবে বলেছি, কোনোভাবেই চুক্তিতে গাড়ি চালানো যাবে না। আমরা আশাবাদী এতে কিছু হলেও কাজ হবে।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর সড়কে বেশি প্রাণ গেছে ফুটপাতে থাকা পথচারীর। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ১১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পথচারী ৬২ জন, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ৩৩ জন এবং অন্যান্য যানবাহনের (বাস, রেকার, প্যাডেল রিকশা, প্যাডেল ভ্যান, অটোভ্যান, ঠ্যালাগাড়ি ইত্যাদি) যাত্রী ও আরোহী ২৪ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব দুর্ঘটনায় ১৭২টি যানবাহন স¤পৃক্ত। দিনের পর দিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়লেও কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না সড়কে এ মৃত্যুর মিছিল। বাস স্টপেজে না দাঁড়িয়ে এভাবেই গন্তব্যে যাওয়ার যে যেভাবে পারছেন বাসে উঠছেন। আর এতে করে সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ছে হাজারো প্রাণ। তাই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শুধু নিয়ম দিয়ে এড়ানো সম্ভব নয় সড়ক দুর্ঘটনা। এর জন্যই চাই সঠিক নীতিমালা ও সুপরিকল্পিত পরিবহন খাত।

এ প্রসঙ্গে মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। প্রতিটি এলাকায় পুলিশ রয়েছে, তারাই বাসচালক, হেলপার, যাত্রীদের জানাচ্ছে বাস স্টপেজের বিষয়ে। রাস্তার সব জায়গায় নজরদারি করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাসচালক, হেলপার, যাত্রীসহ সবারই সচেতনতা দরকার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজধানীর সড়কে চরম নৈরাজ্য

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ