Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খালের মরণদশায় জনদুর্ভোগ

চট্টগ্রামে দখল দূষণ ভরাটে ৫৭ খাল-ছরা ‘বারো মাইস্যা দুঃখ’ পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনরুদ্ধার মেগা প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে ধীরগতি : খতিয়ানমূলে বেদখলবাজ উচ্ছেদে কঠোর অভিযান চান নাগরিকমহল :

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

এক সময়ে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ ‘সওদাগরী বাণিজ্য পাড়া’ থেকে মালামাল বোঝাই প্রতিদিন শত শত নৌযান চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যেতো চট্টগ্রাম বিভাগের প্রত্যন্ত এলাকায়। সেই চাক্তাই খাল এখন ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’। শুধুই চাক্তাই খাল নয়। এই বন্দরনগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানীর ৫৭টি খাল-ছরার বর্তমানে মরণদশা। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত এসব খাল-ছরা হতে পারতো সম্পদ। আজ তা আপদ ও জনদুর্ভোগের কারণ। নির্বিচারে বেদখল, দূষণ, ভরাটের পরিণামে বেশিরভাগ খাল-ছরার অস্তিত্বই অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে।
খালের জায়গায় খাল নেই। বর্ষা মৌসুম ও তার আগে-পরে মরা, ভরাট, সঙ্কুচিত খাল-ছরাগুলো উপচে গিয়ে দফায় দফায় কাদা-পানিতে ডুবে গিয়ে ঢল বয়ে যায় নগরময়। পানিবদ্ধতায় আর্থিক ক্ষতি হয় শত কোটি টাকার। আর শুষ্ক মৌসুমে চলে ভ‚মিদস্যুদের অবাধে দখলবাজি। এক ডজন সরকারি সেবাদাতা সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা থাকেন নীরব দর্শক। অনেক ক্ষেত্রে কতিপয় স্থানীয় অসৎ জনপ্রতিনিধিসহ রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সমগ্র মহানগরীতে অপদখলে হারিয়ে যাচ্ছে খাল ও ছরার জায়গা। বসতঘর, ঝুপড়ি-খুপড়ি, দোকানপাট, মিল-আড়ত, গুদাম, ক্লাবঘর, সংগঠন-সমিতির অফিস এমনকি সুরম্য ভবনসহ হরেক ধরনের অবৈধ স্থাপনা বসে গেছে। খাল-ছরা, নালা-নর্দমার অবশিষ্ট জায়গাজুড়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। অসহ্য দুর্গন্ধ। খালের বুক আগাছায় ছেয়ে আছে। কয়েক স্তরে পলিথিন, প্লাস্টিক ও অপচনশীল বর্জ্য জমেছে। অপদখলের উদ্দেশে অবাধে চলছে ভরাটকাজ। খাল-ছরা-ঝরণাগুলোর চওড়া, গভীরতা, দৈর্ঘ্য কমে গেছে। নগরীর ৫৭টি খালের এমন মরণদশা। ত্রিশ বছরেরও বেশিকাল যাবৎ চাক্তাই খাল ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’ হিসেবে আলোচিত। এখন নগরীর সব খাল-ছরাকে দুঃখকে ‘বাণিজ্যে’ পরিণত করা হচ্ছে।
একেক সময়ে একেক প্রকল্পের আড়ালে শত শত কোটি টাকা পকেটে ভরছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-প্রকৌশলী-ঠিকাদারের অসৎ সিন্ডিকেট। দেশি-বিদেশি অর্থায়নে অতীতের সেই ‘পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প’, বিদেশি ফর্মুলার নামে ‘সিল্ট ট্র্যাপ’ (বালু আটকানোর ফাঁদ) প্রকল্প থেকে একই অনিয়ম-দুর্নীতির ধারা চলে আসছে। নতুন নতুন নামে প্রকল্প আসছে, ‘কাজ’ আসছে। শেষমেশ টাকা যাচ্ছে খালের পানিতে। কাজের কাজ হয় না কিছুই। প্রতিটি খাল-ছরা, ঝরণা, নালা-নর্দমা পরিণত হয়েছে ‘চট্টগ্রামবাসীর বারো মাইস্যা দুঃখ’।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আশিক ইমরান গতকাল মঙ্গলবার ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান শুষ্ক মৌসুমেই সর্বশক্তি নিয়োজিত করে খালগুলো পুনরুদ্ধার ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কেননা বর্ষাকালে খালের মুখে বার বার বাঁধ দেয়া ও আবার কেটে দেয়া নিয়ে পানিবদ্ধতা এবং কাজে সমস্যা তৈরি হয়। এ পর্যন্ত পানিবদ্ধতা নিরসনে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে যে গতি আশা করা হয়েছিল তা আসেনি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) মেগাপ্রকল্পের জন্য অর্থবরাদ্দ কমই পেয়েছে। তাতে কাজে গতি আসছে না। ভবিষ্যতের জন্য আরো জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার সহকারে খাল পুনরুদ্ধার ও পানিবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। খালগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনরুদ্ধার জরুরি। দখল-ভরাট-দূষণমুক্ত করে খাল-ছরাগুলো স্বাভাবিক ও সচল না হলে চট্টগ্রামকে পানিবদ্ধতামুক্ত করা সম্ভব নয়। খাল-ছরা উদ্ধারের সাথে সাথে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই সাথে খাল-ছরার জায়গা ও তীরভূমি সংরক্ষণও করতে হবে।
চট্টগ্রাম নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দু’টি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সর্ববৃহৎ প্রকল্পটি হচ্ছে সিডিএ’র ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্প। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন বিগ্রেডের মাধ্যমে সিডিএ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে বার বার তাগাদা সত্তে¡ও সিডিএ’র মাধ্যমে প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ মিলছে না। মেয়াদ আগেই শেষ হলেও এ যাবৎ প্রকল্পে প্রায় এক হাজার ৮শ’ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ এসেছে। অর্থ ছাড়ে ধীরগতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় ২০১৭ সালে জুলাই মাসে নেয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হওয়ার আগেই গত ২০ জুন আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুন ধার্য্য হয়েছে। এরফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর পানিবদ্ধতা নিরসন ও খাল পুনরুদ্ধারসহ পুনঃখননে সিডিএ ৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকায় দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এরমধ্যে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে ‘চট্টগ্রাম শহরের পানিবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, স¤প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্প। অন্যটি ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প। প্রথম প্রকল্পটির আওতায় নগরীর ৩৬টি খাল সংস্কার, খনন ও স¤প্রসারণ ছাড়াও খাল দখল করে থাকা প্রায় ৩ হাজার ১৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ২৪০ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার, খাল পাড়ে ১৭৬ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, খালগুলোর এক পাশে ১৫ ফুট চওড়া রাস্তা, অপর পাশে ৫ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ৫৪টি ব্রিজ-কালভার্ট, কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত পাঁচটি খালের মুখে সুইচগেট নির্মাণ এ প্রকল্পে টার্গেট রয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ এখনো অর্ধেকও হয়নি।
উঁচুনিচু পাহাড়-টিলাময়, সমতল, ঢালু, সমুদ্র উপক‚ল, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, খাল-ছরা, ঝরণা, হ্রদ, অনেকগুলো দীঘি-পুকুর মিলিয়ে দুইশ’ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের চট্টগ্রাম মহানগরী ও এর আশপাশের এলাকার রয়েছে ভিন্নধরনের ভ‚-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। বঙ্গোপসাগরের ধারে অবস্থানের ফলে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং সামুদ্রিক জোয়ার-ভাটার নগরী চট্টগ্রাম। প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম শহর এবং কর্ণফুলী নদীর মোহনাকে যুক্ত করে রাখা চাক্তাই ও অন্য ২০টি প্রধান খালসহ মোট ৫৭টি খাল ও ছরা পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবেই সমাধান দিয়ে আসছে। যা এই মহানগরীর শিরা-উপশিরা, প্রাণ প্রবাহ। কিন্তু বর্তমানে কোন খাল-ছরা অক্ষত ও স্বাভাবিক অবস্থায় আর নেই। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় নাজুক অবস্থা উঠে এসেছে।
চট্টগ্রামের নাগরিকমহলে দাবি উঠেছে আরএস, সিএস, পিএস রেকর্ড খতিয়ান মূলে অবিলম্বে খালগুলোকে খালের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হোক। দখলবাজদের বিরুদ্ধে নেয়া হোক কঠোর আইনি ব্যবস্থা। কেননা নগরীতে পানিবদ্ধতার দুঃসহ দুর্ভোগের পেছনে প্রাকৃতিক খাল-ছরাগুলো বেদখল, ভরাট ও দূষণই প্রধানত দায়ী। চাক্তাই খাল ছাড়াও রাজাখালী, ফিরিঙ্গিবাজার, গয়নাছরা, কলাবাগিচা, হিজড়া, মির্জা, বির্জা, মহেশখাল, মরিয়মবিবি, মধ্যম-বদর, টেকপাড়া, জামালখান সাব-এরিয়া, রহমতগঞ্জ, খন্দকিয়া ইত্যাদি খাল-ছরা দখল, ভরাট, দূষণে মৃতপ্রায়। নগরীজুড়ে পানি নিষ্কাশনের পথ অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
বর্ষায় দুয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিতে কাদা-পানি-বালুতে তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর বড় অংশ। সামুদ্রিক জোয়ারের পানি যোগ হলেই ডুবছে অনেক এলাকা। বৃষ্টি ও জোয়ারের দ্বিমুখী চাপে পানিবদ্ধতা ‘ক্রনিক’ সমস্যায় রূপ নিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল-ক্লিনিক, আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী ও গুদামে শিল্পের কাঁচামাল, দোকানপাটসহ পদে পদে ক্ষতি আর লোকসান হচ্ছে ব্যাপক। ৭০ লাখ নগরবাসীর মধ্যে অন্তত ৩৫ লাখ অর্থাৎ অর্ধেকই কোন না কোনভাবে পানিবদ্ধতার শিকার। সারাবছর খাল-ছরাগুলো দখল, ভরাট ও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খালের মরণদশা

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ