Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাউন্সিলরের দখলে রাজউকের ২১ প্লট

উত্তরায় ডিএনসিসির ৫১ নং ওয়ার্ড প্রতি মাসে ভাড়া ওঠে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা, পুলিশও টাকার ভাগ পাচ্ছে কিশোর গ্যাং-এর নেতৃত্ব দেন কাউন্সিলর শরীফ মারধর করে ৭ লাখ

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

রাজধানীর উত্তরাতে রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশনের (রাজউক) ২১টি প্লট বেদখল হয়ে আছে। প্লট দখল করে বানানো হয়েছে ফার্নিচার মার্কেট। দখলের নেতৃত্বে আছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শরীফুর রহমান। প্লট রাজউকের হলেও ভাড়ার চুক্তি করেন কাউন্সিলর; বুঝিয়ে দেন দোকানদারদের। সোনারগাঁও জনপদের ১১ নং ও ১৩ নং সেক্টরের মাঝামাঝি জমজম টাওয়ারের পাশে ২১টি প্লট থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা ভাড়া তোলা হয়। যথাসময়ে টাকার ভাগ চলে যায় রাজউকের অসাধু কর্মকর্তাদের কাছে। তাই বেদখল হওয়া প্লট উদ্ধারে কোনো চিন্তা নেই রাজউকের। এছাড়া প্রতিমাসে থানা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যার যার ভাগ চলে যায়। এক রকমের মিলেমিশে প্লট দখল করে গড়ে তোলা মার্কেটের মধু খাচ্ছেন সবাই। শুধু রাজউকের প্লট নয় ১১ নং সেক্টর ও ১৩ নং সেক্টরের ফুটপাতের ওপর সব দোকান থেকে চাঁদা তোলেন এই কাউন্সিলর। এজন্য তার রয়েছে কর্মী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং। প্রভাব বিস্তার করতে অনেকেকে মারধর করেছেন শরীফ। মারধর করে দুই ব্যক্তিকে ৭ লাখ টাকা জরিমানাও দিয়েছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরার সবচেয়ে বড় ‘উপরি টাকার’ উৎস এই ফার্নিচার মার্কেট। মার্কেটের বেশিরভাগ প্লট লিখিত দলিল করে ভাড়া দিয়েছেন কাউন্সিলর শরীফুর রহমান। কিছু কিছু দলিলে কোন দোকানে কত টাকা ভাড়া উঠবে, সেই ভাড়া থেকে কে কত টাকা ভাগ পাবে, প্রশাসন, রাজউক কত টাকা পাবে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করাও রয়েছে। এক্ষেত্রে একেকজন নেতাকে স্ট্যাম্প করে প্লট বুঝিয়ে দেন কাউন্সিলর শরীফ। পরবর্তীতে সেই নেতা দোকান ভাড়া দেন এবং টাকা তোলেন। সেক্ষেত্রে কাউন্সিলরকে টাকা দিয়েও সেই নেতার কিছু টাকা পকেটে থাকে।
একটি প্লটের ১০০ টাকার তিন পাতার একটি স্টাম্প থেকে জানা যায়, যিনি প্লট বুঝে নিয়েছেন তার প্রতি অনেকগুলো শর্তের মাঝে কয়েকটি হলো কোনো ধরনের ঝামেলা যেন না হয়, সেজন্য নিরাপত্তা দেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দিতে হবে। রাজউক কোনো উচ্ছেদ অভিযান চালালে সেই স্থানে চুক্তি করা ব্যক্তি পুনরায় দোকান তুলতে পারবেন, অন্য কেউ দোকান তুলতে পারবে না। প্লট রাজউক কাউকে বরাদ্ধ দেয়ার আগ পর্যন্ত এ চুক্তি বলবৎ থাকবে। এছাড়া কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে লিখা হয়, অমুক অমুক নেতা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা পাবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কেটের একটি প্লটের দোকান মালিক ইনকিলাবকে বলেন, প্রতি মাসে মার্কেট থেকে ৫৪ লাখ টাকা ভাড়া তোলা হয়। টাকার তিন ভাগের দুই ভাগ যায় কাউন্সিলর শরীফের কাছে, আর এক ভাগ যিনি প্লট নিয়েছেন তিনি রাখেন। টাকা তোলার জন্য কয়েকজনকে রাখা হয়েছে। এই টাকা থেকে স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ নেতারা ভাগ পান। রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা এবং উত্তরা পশ্চিম ও তুরাগ থানা পুলিশকেও টাকা দেয়া হয়। তিনি আরো জানান, ১১ নং সেক্টরের ২০ নং রোডে ওয়াসার একটি প্লট দখল করে মাংসের দোকান ভাড়া দিয়েছেন শরীফ। প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া পান তিনি।
কাউন্সিলর শরীফের হয়ে ভাড়া তোলার কাজ করেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, প্রতি মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ভাড়া উঠে মার্কেট থেকে। এছাড়া ফুটপাত থেকেও লাখ লাখ টাকা তোলা হয়। রাজউক যেন উচ্ছেদ অভিযান না চালায় সেজন্য প্রতিমাসে রাজউকের কিছু কর্মকর্তার কাছে টাকা পাঠানো হয়।
কাউন্সিলর শরীফুর রহমানের হয়ে প্লট দখল বাণিজ্যের সাথে আরো যুক্ত রয়েছেন, তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক নূর হোসেন, কৃষক লীগ নেতা ইউনুস, কবির হাসান, উত্তরা পশ্চিম থানা ছাত্রলীগে সভাপতি শাকিলুজ্জামান বিপুল, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম শুভ, যুবলীগ নেতা প্রদীপ কুমার গুহ, যুবলীগ নেতা সোহেল, যুবলীগ নেতা সাব্বির আহমেদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জহির, খোকন, ছাত্রলীগ নেতা জিদান। বিএনপি নেতা কাউন্সিলর শরীফের ডান হাত টাকলা জসীম, বাল্যবন্ধু গুজা বাবু। টাকলা জসীম বিএনপি নেতা ঢাকা-১৮ আসনের এমপি প্রার্থীর বাহাউদ্দিন সাদীর ঘনিষ্ঠ। টাকলা জসীম কাউন্সিলর শরীফের হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, গ্রুপ মেইনটেইন করে। আর জহির ও খোকন সকল চাঁদার টাকা তোলে।
উত্তরা পশ্চিম থানা ছাত্রলীগে সভাপতি শাকিলুজ্জামান বিপুল গাউসুল আজম রোডে ১২-১৩ মোড় থেকে ময়লার চৌরাস্তা পর্যন্ত ফুটপাতের টাকা তোলেন। ফার্নিচার মার্কেটের ৬৩ নং প্লটের দখল তার। শিনশিন জাপান হাসপাতাল থেকে চাঁদা চাইলে, না দিলে ভাঙচুর চালায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মামলা করতে গেলে অন্যদের নামে মামলা নিলেও বিপুলের নামে মামলা নেয়নি পুলিশ।
শরীফের হয়ে সকল টাকা তোলে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নাম ভাঙিয়ে চলা জহির ও খোকন। মার্কেটের ২০ নং প্লটের দখলে রয়েছেন জহির। প্রত্যেক দোকান ও ফুটপাত থেকে টাকা তোলে তারা। সাউথ ব্রিজের সামনে ফলের দোকান থেকে টাকা তোলে জহির ও খোকন। ১২ নম্বর ময়লার মোড়ের পরে কবরস্তানের পাশে বাঁশেরপট্টি থেকে টাকা তোলে খোকন। এছাড়া মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ করে যুবলীগের প্রদীপ কুমার গুহ। ছাত্রলীগ নেতা বিপুলের ঘনিষ্ঠ প্রদীপ। গরিবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউ থেকে ফুটপাতের টাকা তোলে কাউন্সিলর শরীফের বাল্যবন্ধু ঘুজা বাবু।
উত্তরার একজন আওয়ামী লীগ একজন সিনিয়র নেতা ইনকিলাবকে বলেন, ৪-৫ বছর আগেও শরীফ এমন ছিল না। কোন ঝুট ঝামেলায় শরীফ জড়াতো না। কাউন্সিলর হবার পর টাকলা জসীমের বুদ্ধিতে চাঁদাবাজিতে জড়িয়েছে শরীফ।
মারধর করে ৭ লাখ টাকা জরিমানা :
কাউন্সিলর হয়েও কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে ৫১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফুর রহমানের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের উঠতি বয়সের কিছু কর্মী এলাকার ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের নেতৃত্ব দেয় ছাত্রলীগ নেতা শাকিলুজ্জামান বিপুল, যুবলীগ নেতা প্রদীপ, সাব্বির, ছাত্রলীগ নেতা জিদান। যার সাথে সমস্যা হয় কিংবা কাউন্সিলরের কাজের প্রতিবাদ করেন এ কিশোর গ্যাং দিয়ে তাদের শায়েস্তা করেন কাউন্সিলর শরীফ। গত ১১ ডিসেম্বর ১১ নং সেক্টর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কার্যকরী সদস্য মাহবুব ইসলামকে প্রদীপ ও সাব্বিরকে দিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগ শরীফের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে সালিশে ২ লাখ টাকা জরিমানাও দিয়েছেন। এ বিষয়ে মাহবুব ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, কোােন কারণ ছাড়াই তাকে মারধর করা হয়েছে কাউন্সিলর শরীফের নির্দেশে। তিনি আরো বলেন, কাউন্সিলরের কারণে ভয়ে আছেন তাই এর বেশি কিছু বলতে চান না তিনি।
এর আগে ২০১৯ সালে ডা. মাহি ইমতিয়াজের মাথা ফাটিয়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছেন কাউন্সিলর শরীফ। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরই এ ঘটনা ঘটান তিনি। ডা. মাহি ইনকিলাবকে বলেন, ২০১৯ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনে অন্য প্রার্থীর হয়ে তিনি কাজ করেছিলেন। নির্বাচনের দিন একটি বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। সেই জেরে নির্বাচনে জয়লভের ২০ দিন পরে কাউন্সিলর শরীফ একটি তালা দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেন। সে সময় তিনি একটি দোকানে বসে ছিলেন। এরপর সলিশে ৫ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছেন কাউন্সিলর শরীফ।
এ বিষয়ে জানতে ডিএনসিসির ৫১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শরীফুর রহমানের অফিসে কয়েকবার গিয়েও পাওয়া যায়নি। এছাড়া একাধিকবার ফোন ও মেসেজ দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ফার্নিচার মার্কেট থেকে পুলিশের চাঁদার ভাগ পাওয়ার বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা জোনের ডিসি মোর্শেদ আলম ইনকিলাবকে বলেন, আমি বিষয়টি জানি না। ভাড়ার যে চুক্তির কথা বলেছেন তা আপনার কাছে থাকলে আমাকে পাঠান। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে চুক্তির কাগজ পাঠানো হলে পরবর্তী সময়ে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
উত্তরার প্লট দখলের বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান আমিন উল্লাহ নূরী ইনকিলাবকে বলেন, এ বিষয়টি আমি জানতাম না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দ্রুতসময়ের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালাব। এ সময় তাৎক্ষণিক মোবাইল ফোন করে রাজউকের উত্তরার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে উচ্ছেদ চালানোর নির্দেশ দেন। তিনি আরো বলেন, অনেক সময় আমরা অভিযান চালানোর জন্য পর্যাপ্ত ফোর্স পাই না। তাই উচ্ছেদ চালাতে দেরি হয়। এ বিষয়ে ঢাকা-১৮ আসনের এমপি হাবিব হাসান ইনকিলাবকে বলেন, আমি সব সময় দখল চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে। রাজউক বা সিটি করপোরেশন যখনই উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে আমি তাদের সহযোগিতা করেছি, ভবিষ্যতেও করব।



 

Show all comments
  • Abu Sadak Badal ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:৫৬ এএম says : 0
    লীগের প্রায় সবগুলো কাউন্সিলররা উঃ দঃ একেই লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md.Rashadujaman ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:৫৭ এএম says : 0
    Very bad news
    Total Reply(0) Reply
  • Ibrahim Hussain Noyon ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:৫৭ এএম says : 0
    Free the plot from culprit as soon as possible
    Total Reply(0) Reply
  • হুমায়ূন কবির ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৩৭ পিএম says : 0
    ওরা খাবে নাত কে খাবে? এখন নেতা হয় অন্যেরটা মেরে খাওয়ার জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • Abdullah Fatheha ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৩৮ পিএম says : 0
    শুধু উওরায় কেন সারাদেশে আমাদের আওয়ামিলীগ ছাএলীগ যুবলীগের নেতা কর্মীগন জোর জুলুম করে সরকারি জায়গা ও অসহায় পাবলিকের জায়গা জমিন দখল করে এই ভাবে ভোগ করি বেচাকেনা করি কোটি কোটি টাকা ইনকাম করিতেছে প্রশাসন তাদের বড় সহায়ক
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Sadak Badal ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৩৮ পিএম says : 0
    লীগের প্রায় সবগুলো কাউন্সিলররা একেই লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Mdsujon ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:৫০ পিএম says : 0
    উত্তরা বাইলজুরী মৌজা ৫৯০ দাগ খতিয়ান নং ৬৮ এই জমি তার দাদা বিক্রি করে যাওয়ার পর তার বাবা আবার বিক্রি করে এখন আমরা বেদখলে আছে যদি কিছু করতে পারেন তাহলে আপনাদের অর্ধেক দিয়ে দেয়া হবে। আমাদের নামে খারিজ নেহি দলিল আছে বায়া দলিল আছে পর্চা আছে সেটি খতিয়ান যার কাছে বিক্রি করেছে তাদের নামে দয়া করে কেউ উপকৃত করেন। ...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ