Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্রিটিশ আইনে চলছে ব্যাংকিং ঋণের সকল দায় ম্যানেজারের!

প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সোহাগ খান : ১৯৪০ সালের আইনে চলছে এখনো বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ব্যাংকিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হলেও আসেনি ঋণ আইনে পরিবর্তন। এই পুরনো আইনের কারণে পরিচালনা পরিষদের অনুমোদিত ঋণের দায় বর্তাচ্ছে শাখা ব্যবস্থাপকের উপর। এই সুযোগে চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সরকার কর্তৃক নিয়োজিত পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন। আর ফেঁসে যাচ্ছেন ‘চাকরি টিকিয়ে রাখার ভয়ে’ উপরের নির্দেশে ঋণের প্রস্তাব উত্থাপনকারী শাখা ব্যবস্থাপক। এটাকে ব্যাংক আইনের একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুর্নীতিবাজ পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা যাতে পার পায় সে জন্যই এত পুরনো আইন বহাল রাখা হয়েছে। এই আইনে পরিবর্তন আনলেই আর্থিক কেলেঙ্কারি অনেকাংশে কমে যাবে বলে মত দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক খলিলুর রহমান চেীধুরী (এফসিএ) বলেন, ঋণ মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ শাখা ব্যবস্থাপকদের চাপে রাখতেই এই আইন পরিবর্তন করছে না। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ একজন শাখা ব্যবস্থাপকের ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা থাকে সর্বোচ্চ ৩০ লক্ষ টাকা। সে এই পরিমাণ ঋণের ক্ষেত্রে অনিয়ম করলে দায়ী থাকবে। কিন্তু ৩০ কোটি বা ৩০০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে পরিচালনা পরিষদ। বোর্ডে ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। এই ঋণে শাখা ব্যবস্থাপককে দায়ী করার কোন যোক্তিকতা নেই। শাখা ব্যবস্থাপক শুধুমাত্র তথ্য উপস্থাপনকারী, এরপর যাচাই-বাছাই করে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট; অনুমোদন করে পরিচালনা পরিষদ। “তাহলে শাখা ব্যবস্থাপক একা দায়ী থাকবে কেন”Ñ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
বৃহৎ ঋণের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও অনুমোদনকারী কতৃপক্ষের দায়ী রাখার বিধান তৈরি হলেই খেলাপি ঋণের হার ও আর্থিক কেলেঙ্কারী কমে আসবে বলে মনে করেন প্রবীণ এই ব্যাংকার।
রূপালী ব্যাংক মতিঝিল কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ফাইভ এস ট্রেডিং কর্পোরোশনের স্বত্বাধিকারী কামরুজ্জামান বলেন, আমি ২ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা ঋণ সুবিধা ভোগ করছি যার বিপরীতে ৩ বছরে ব্যাংককে ৭২ লক্ষ টাকা লভ্যাংশ দিয়েছি। কিন্তু ঋণটি অনুমোদনের সময় শাখা থেকে সহায়ক জামানত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে ঋণ প্রস্তাব প্রেরণের পর বিভাগীয় কার্যালয় ও প্রধান কার্যালয় থেকেও আমার সবকিছু পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শনের পর বিভিন্ন ঘাটতি তথ্য নিয়ে প্রধান কার্যালয় ঋণটি অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু ঋণ অনুমোদন পত্রে ৪৫টি শর্তের মাঝে ৪১টি শর্তে শাখা ব্যবস্থাপক দায়ী থাকবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা একজন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। কারণ সব দায়ই যদি শাখা ব্যবস্থাপকের উপর বর্তায় তাহলে বিভাগীয় কার্যালয় বা প্রধান কার্যালয়ের প্রয়োজন কি ছিল?।
অগ্রণী ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক (উপ-মহাব্যবস্থাপক) বলেন, আমাকে বরিশাল থেকে ঢাকায় বদলি করে আনা হয়েছিল শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে। তৎকালীন এমডি স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ঢাকা এসে পরিবারের সাথে গত দুবছর থাকলেও এখন তিন মাস ধরে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়েছে। আমার শাখা থেকে এমডি স্যার প্রায় ১০ জন গ্রাহককে ঋণ পাইয়ে দেন যাদেরকে আমি চিনতাম না। কিন্তু হামিদ স্যার জোর দিয়ে বলাতে আমি ঋণ প্রস্তাব পাঠাই। একজন গ্রাহকের ক্ষেত্রে জমির মৌজা রেট অনুপাতে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হলে জিএম অফিস তা ফেরত দেয়। জিএম আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, এমডি স্যার ত্রিশ কোটি টাকার এলসি খুলতে বলেছেন। না খুললে তোমাকে ট্রান্সফার এবং সেই সাথে ব্যাখ্যা তলবও করা হবে। পরে আমি ভয়ে জমির মূল্য বাড়িয়ে প্রস্তাবটি পরিবর্তন করে দিই এবং মাত্র তিনদিনের মধ্যে ৩০ কোটি টাকার এলসি অনুমোদন হয়। এখন গ্রাহক একটি টাকাও জমা দিচ্ছে না। এমনকি ফোর্সড লোন করার জন্য ডাউন পেমেন্টের টাকা আদায় করতেও কষ্ট হচ্ছে। এমনকি বাকি ৯ জন গ্রাহকও এমনই অবস্থা টাকা ফেরত দেয়ার নাম নেই। ঋণ অনুমোদনের পূর্বে জিএম অফিস এবং প্রধান কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শন করলেও এখন তারা ব্যাখা তলব করছে আমাকে। এমনকি ঋণ প্রদানে সর্বোচ্চ অথরিটি এমসিসির সদস্যরাও আমাকে দায়ী করছে। আমার ক্ষমতা মাত্র ২০ লক্ষ টাকা প্রদানের। যাদের নির্দেশে ঋণ প্রস্তাব পাঠিয়েছি তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। আমি হচ্ছি বলির পাঠা।
অগ্রণী ব্যাংকের এই ব্যবস্থাপক আরও বলেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে দুদিন পর কোনো ব্যাংকই আর ম্যানেজারি করার জন্য অফিসার খুঁজে পাবে না।
বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শাখা ব্যবস্থাপক শুধুমাত্র নামমাত্র ব্যক্তি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে। তিনি শুধু তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেন। এরপর প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয় এসকল তথ্য যাচাই করে ঋণ প্রদান করে থাকে। তবে কোন ঋণ খেলাপী বা আদায় না হলে ব্যাখা তলব, চার্জশীট, এমনকি চাকুরীচ্যুত হয় শাখা ব্যবস্থাপকরা। অথচ ঊর্ধ্বতনদের চাপেই এসকল ঋণ প্রস্তাব প্রেরন করে থাকেন তারা। কিন্তু যত দোষ তাদের উপরেই বর্তায়। কারণ উপরের স্তরের কর্মকর্তারা নিজেদের বাঁচাতেই অযোক্তিক সকল শর্ত জুড়ে দেন অনুমোদনের ক্ষেত্রে। বর্তমানে তিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিবর্তনের ফলে প্রায় শাতাধিক শাখা ব্যবস্থাপক বিপাকে আছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ম্যানেজারি করা আর গলায় ফাঁসি নেয়া একই কথা। ঊর্ধ্বতনরা নিজেরা বাঁচার জন্য প্রত্যেকটি শর্তে শাখা ব্যবস্থাপকদের পেচিয়ে রাখেন। যাতে উপরে থেকে অনিয়ম হলেও নি¤œস্তরের কর্মীরা পার না পায়। এসকল অযৌক্তিক শর্ত প্রত্যাহার করা উচিত। যারা ঋণ অনুমোদন করবেন তারাই দায়ী থাকবেন। তবে শাখা ব্যবস্থাপক বিতরনের শর্ত লঙ্ঘন করলে দায়ী হতে পারেন। এসকল অযোক্তিক শর্ত দেশের অর্থনীতির গতিপথ শ্লথ করছে বলে আমি মনে করি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, একটি শাখার ব্যবস্থাপক শাখাটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যাক্তি। তিনি যদি উপরের চাপে মাথা নত না করেন তাহলে তো আর বিপদে পরবেন না। তবে ঋণের শর্তগুলো আসলেও ম্যানেজারদের কাছে বিপজ্জনক। যদি কোনো শাখা ব্যবস্থাপক শর্তগুলো পরিবর্তনের জন্য অভিযোগ করে তবে আমরা তা পরিবর্তনের জন্য পরিপত্র জারি করতে পারি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্রিটিশ আইনে চলছে ব্যাংকিং ঋণের সকল দায় ম্যানেজারের!
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ