Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এক ক্রুদ্ধ জাতীয়তাবাদ

প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ধারণা ও তার পরিণামের মধ্যকার পার্থক্য বেশি আকর্ষণীয় হতে পারে না। প্রকৃত পদক্ষেপ যদি গোপনীয়তা ও যথার্থতার ব্যাপারে হয়, তাহলে তাকে ঘিরে থাকা সবকিছুই ফাঁকা অঙ্গভঙ্গি ও অশোধিত রাজনীতিতে পূর্ণ। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক প্রায়শই ভূখ-গত হামলার ক্ষতি পরিমাপ করে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটানো। এটা এ ধারণাকেও বাতিল করে যে ভারতের পক্ষ থেকে কৌশলগত সংযম পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলার সাথে সম্পর্কিত। এ হচ্ছে এক গুরুত্বপূর্ণ ও সিদ্ধান্তমূলক পরিবর্তন এবং তা দেশের মধ্যে নতুন করে আস্থার সৃষ্টি করেছে।
পরিবর্তে আমরা বিপরীতটা দেখি। প্রতীকীবাদ ও ভীতি প্রদর্শনের অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদী উচ্ছ্বাসে সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপ থেকে ব্যক্তিগত গৌরব অর্জনের কাঁচা হাতের চেষ্টার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে একসাথে অতিমাত্রায় বিস্ফোরণ। এ পদক্ষেপের শিকড় যদি শক্তির নতুন ভাষায় নিহিত থাকে তাহলে প্রতিক্রিয়া হয় বহুকালের ভীতি ও উদ্বেগের ফসল।
পাকিস্তানি অভিনয় শিল্পীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আস্থা-সাহসের পরিবর্তে সংকীর্ণমনা ভীতির আভাস দেয়। প্রত্যেকেই এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট আবেগ বুঝতে পারে, কিন্তু প্রাজ্ঞ সমাজ এ ধরনের প্ররোচনায় সাড়া দেয়া থেকে বিরত থাকে। ভারতে তাদের কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে আসলে কিছু অর্জিত হবে না, তা যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় সৈন্যদের অবশ্যই কোনো সাহায্য করবে না, তবে তা আবেগের আতিশয্যের সাথে যুক্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার প্রবণতা সৃষ্টি করে।
সুনির্দিষ্টভাবে এটা বোঝা খুব কঠিন যে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী সি এম দেবেন্দ্র ফড়নবিসকে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও কোনো ছবি মুক্তিপ্রদানের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই যাদের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই, তাদের সাথে একটি আপসরফায় সাহায্য করতে কে বলেছে। অনেকেই বলেছেন যে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক যখন অনেক ভালো ছিল তখন যেসব ছবির কাজ শুরু হয়েছিল, সেগুলোর অভিনেতাদের কাস্টিং নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে যার কোনো অর্থ নেই এবং কারো রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, সেই এতে নাক গলাতে সক্ষম। পাকিস্তানি অভিনেতাদের নিয়ে ছবি করার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে প্রযোজকদের ৫ কোটি টাকা জরিমানা করা এক অদ্ভুত ব্যাপার। আরো কথা, এ ব্যাপারে সরকারের এক জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন রয়েছে।
এ ধরনের একটি পদক্ষেপের কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না এবং যেখানে পাকিস্তানি অভিনেতাদের উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান নেই বলে দাবি করা হচ্ছে তখন এ ধরনের চুক্তির বিষয় তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে ভীতির আবহাওয়া সৃষ্টিতে মদত দেয়া। অধিকসংখ্যক চিত্র নির্মাতা এর আওতায় পড়ছেন আর রাজনৈতিক গলাবাজিজাত ধর্মোপদেশ শঙ্কার কারণ হচ্ছে, সন্তুষ্টির নয়। এটা আমাদের বলছে যে সামান্য পরিমাণ দৈনন্দিন বিনোদনও এখন অদৃশ্য ভীতিতে কলঙ্কিত।
পররাষ্ট্রগতভাবে ভারতের কৌশল যদি হয় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা তাহলে তার জন্য প্রয়োজন হিসেব করা পদক্ষেপ যা ভারতকে দেয় এক উচ্চতর নৈতিক অবস্থানের পাশর্^ প্রতিনিধিত্ব। পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে এ আঙ্গিনাকে পাকিস্তানি জনগণের কাছে সম্প্রসারিত করা বেশি ওজন বহন করবে বলে তা মনে করা যায় না এবং তা ভারতের অবস্থানকে অগ্রহণযোগ্য করবে। যারা দক্ষিণ আফ্রিকা ও বর্ণবৈষম্যের কথা বলেন, তারা ভুলে যান যে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা হয় ক্ষমতাশালী অভিজাতদের সাথে যার প্রতিষ্ঠা এর বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের উপর। পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। সাধারণ পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রের আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ সমর্থনের সিদ্ধান্তের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।
এমনকি অভ্যন্তরীণভাবে মোদি সমর্থনের ভিত্তি তার বৈধতা পেয়েছে এক ধরনের আহত হওয়ার বোধ লালন করা থেকে যা তার প্রতিক্রিয়াকে এক স্বধার্মিকতায় আবৃত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ঘটনার শিকার নিজে যদি শক্তিমান হয় এবং পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে কথিত হামলাকারী তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকৃত বিষয়ে স্পষ্টত নিরপরাধ, তখন মনোভাবের ¯্রােত ঘুরে যেতে শুরু করে। এটা হচ্ছে সে পরিস্থিতি যেখানে এমনকি সরকারের কট্টর সমর্থকরাও এ যাবত নীরবতা পালনকারীদের পাশাপাশি তাদের অনুভূতি সম্পর্কে কথা বলতে বাধ্য হয়। মিডিয়া আয়ত্তাধীন রয়েছে, সুতরাং তারা অভিযোগকে অগ্রাধিকার না দিতে পারে, কিন্তু একটি পর্যায়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা বিজেপিকে বিপুল সাহায্য করেছে, কিন্তু একে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় বিপদ আছে। দেশপ্রেম হচ্ছে এমন এক ধারণা যা যে কোনো কিছুকে শেষপর্যন্ত যৌক্তিকতার রূপ দিতে ব্যবহৃত হতে পারে এবং তা একে নিয়ন্ত্রিত পন্থায় ব্যবহার করা কঠিন করে।
জাতীয়তাবাদকে একটি কীলক ইস্যু হিসেবে ব্যবহারের প্রলোভন যা, উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে আসনগুলোর মেরুকরণে সাহায্য করছে, তা বোঝা সহজ। কিন্তু বিহার অভিজ্ঞতা প্রদর্শন করেছে যে এ আবেদন নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সহজ। তাছাড়া বলিউড যদি জাতীয়তাবাদী বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রধান ক্ষেত্রে পরিণত হয়, তাহলে ছবিগুলোর মুক্তি পাওয়া অব্যাহত থাকবে এবং ক্রোধ কখনো বন্ধ হবে না। যে কেউই অনুমান করতে পারে আমির খানের দঙ্গল মুক্তি পেলে কি ঘটবে।
এ বিষয়ের উপর মোদি সরকারকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে হবে। এটি এক নাজুক ফল্ট লাইন যা ভয় ও ভীতি প্রদর্শনের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে পারে যা কারো জন্য ভালো হবে না। বিশ^ সম্মানিত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি লাভে নরেন্দ্র মোদির চেষ্টায় এটা নিশ্চিত সামঞ্জস্যশীল নয়। এমনকি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও মঞ্চ হিসেবে জাতীয়তাবাদের উপযোগিতা তার অবাস্তবায়িত সম্ভাবনার মধ্যে নিহিত, যদি তা পূর্ণভাবে বিকশিত হয় তাহলে বিষয়টি তার শক্তি হারাবে। রাম জন্মভূমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে এত কিছু বলা হয়েছে যে আজ তা জনসমর্থন পাবার ক্ষমতা হারিয়েছে, এমনকি উত্তর প্রদেশেও।
সকল রাজনৈতিক হিসেবের বাইরে বর্তমান আলোচনার ব্যাপারে গভীর সমস্যাজনক কিছু রয়েছে। আমাদের গুরুত্বকে তুলে ধরার বিপুল প্রয়োজনীয়তা এবং শক্তির অতিরঞ্জিত প্রদর্শন হচ্ছে প্রতিপক্ষকে আমরা কতটা ভয় করি তার একটি নির্দেশক। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চীনা পণ্য বর্র্জনের ব্যাপারে অসংলগ্ন কথাবার্তা বৃহৎ মঞ্চের উপর কারো খেলার সক্ষমতার নিরাপত্তাহীনতাকে প্রকাশ করে। বিশ^ কর্মসূচিতে ভালো করছে এ রকম একটি দেশ থেকে এবং এমন একটি সরকার থেকে যার নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এবং বিশ^াস করার কারণ রয়েছে আগামীতে কিছু সময় ক্ষমতায় থাকবে, তাদের কাছে যে কেউই অধিকতর পরিপক্ব ও আত্মবিশ^াসী আচরণ প্রত্যাশা করে। সূত্র দি টাইমস অব ইন্ডিয়া।
*নিবন্ধকারের নাম সন্তোষ দেশাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এক ক্রুদ্ধ জাতীয়তাবাদ

২৬ অক্টোবর, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ