Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দিল্লীর সিদ্ধান্তের ফাঁদে ‘গঙ্গা ব্যারাজ’

আলোচনার জন্য আজ ঢাকা আসছে ভারতের প্রতিনিধি দল

প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে বহুল আলোচিত স্বপ্নের ‘গঙ্গা ব্যারাজ’। চূড়ান্ত সমীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরও বারবার ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ এই ব্যারাজের মূল কাজ শুরু করতে পারছে না।
এমন পরিস্থিতিতে ‘গঙ্গা ব্যারাজ’ নিয়ে আলোচনার জন্য আজ সোমবার বিকালে ভারতের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসছে। চার দিনের সফরে আসা আট সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দেবেন দেশটির সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী (এইচএসও) মি. ভুপাল সিং। আগামী ২৮ অক্টোবর সকালে এই প্রতিনিধি দলটি দিল্লীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন। ইতোপূর্বে অজ্ঞাত কারণে এই প্রতিনিধি দলটি তাদের সফর দুই দফা পিছিয়েছে। এছাড়াও চার দফা চিঠির মাধ্যমে ভারত গঙ্গা ব্যারাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশ ভারতের সকল অনুসন্ধানের জবাব দিয়েছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতকে সাথে নিয়েই বাংলাদেশ এই ব্যরাজ নির্মাণ করতে চায়। তিনি এই ব্যারাজ নির্মাণে ভারতের কাছে অর্থনৈতিক সহায়তাও চেয়েছেন। তিনি ভারতকে জানিয়েছেন, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ হলে উভয় দেশই এ থেকে লাভবান হবে।
আর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, ভারতকে আস্থায় না নিয়ে বাংলাদেশ এই ব্যারাজ নির্মাণ করতে আগ্রহী নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে- ভবিষ্যতে যাতে এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কোন ভুল বুঝাবুঝি না থাকে। এমন নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কেও দেয়া হয়েছে। তবে এই ব্যরাজ নির্মাণে চীনের আগ্রহ রয়েছে এবং তারা এখাতে বিনিয়োগ করতে চায়। এ নিয়ে চীনের পক্ষ থেকে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। ব্যরাজটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে- প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
‘গঙ্গা ব্যারাজ’ নিয়ে আলোচনার জন্য আজ বিকালে ভারত থেকে আসা প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেনÑ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইরিগেশন এন্ড ওয়াটারওয়েজ ডিপার্টমেন্টের সচিব নবীন প্রকাশ, মিনিষ্ট্রি অব ওয়াটার রিসোর্চ এর কমিশনার (এফএম) জে. চন্দ্র শেখর আয়ার, সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের পরিচালক, হাইড্রোলজি মি. এনএন রাই, সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের পরিচালক মি. আরআর সামভিরা, ডব্লিউএপিসিওএস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক অনুপম মিশ্র, ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি (পলিটিক্যাল) নিনাদ এস দেশডান্ডে ও মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল এফয়ার্স এর আন্ডার সেক্রেটারি (বিএম) মিস. মিনি কুমাম। এই প্রতিনিধি দলের সাথে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আরও দু’জন যোগ দেবেন।
অপরদিকে, ভারতের সাথে গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাই বাকী।
এই প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেনÑ পাউবো’র অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) মাহফুজুর রহমান, যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশ এর সদস্য জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (গঙ্গা ব্যারাজ) মোতাহার হোসেন, পাউবো’র ফরিদপুর জোনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী কবিবুর রহমান প্রমুখ।
গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে ভারত একাধিকবার আপত্তি দিলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে এই ব্যারাজ ভারতের কোন ক্ষতি করবে না। বরং এ থেকে তারা লাভবানই হবে। বাংলাদেশের এমন বক্তব্যে ভারত আস্বস্ত হতে পারেনি। এজন্য এই ব্যারাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে চার দফা বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশ লিখিতভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের এসব প্রশ্নের তিন দফা জবাব দিয়েছে। ভারত প্রথম দফার চিঠিতে দু’টি বিষয় জানতে চায়। যার অন্যতম ছিল এই ব্যারাজের পানি ‘ব্যাক ফ্লো’ হয়ে ভারতীয় অংশে ভাঙন সৃষ্টি করবে কীনা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জবাবে বলা হয়েছে, এই ব্যারাজটি নির্মিত হলে দু’দেশই উপকৃত হবে এবং কোনভাবেই এর ব্যাক ফ্লো ভারতীয় অংশে ভাঙন সৃষ্টি করবে না।
এরপর দ্বিতীয় দফায় ভারত চিঠির মাধ্যমে গঙ্গা ব্যারাজের ওপর ১৫টি বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার পর ভারত তৃতীয় দফা চিঠি দেয়। এই চিঠিতে ভারত গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে নতুন করে আরও ২টি কোয়ারি দেয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব কোয়ারিরও জবাব দেয়া হয়। সর্বশেষ চতুর্থ দফা চিঠি দিয়ে ভারত ১৩টি বিষয় জানতে চায়। বাংলাদেশ এসব বিষয়েরও জবাব তৈরি করে রেখেছে। সহসাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এসব প্রশ্নের জবাব ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
গঙ্গা ব্যারাজ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে দু’দেশের কারিগরী কমিটির বৈঠকে ভারত তাদের আপত্তিগুলো উত্থাপন করবে। অপরদিকে, আলোচনায় বাংলাদেশ তুলে ধরবে এই ব্যারাজ কেন ভারতের ক্ষতি করবে না- সেসব দিক। এই ব্যরাজটি নির্মাণ হলে ভারত যে লাভবান হবে- বাংলাদেশ এ বিষয়টিও তুলে ধরবে।
ভারত থেকে আগত প্রতিনিধি দলটি ঢাকা পৌঁছেই আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সাভার-মানিকগজ্ঞ হয়ে পাটুরিয়া যাবে। মঙ্গলবার তারা ফরিদপুর সার্কিট হাউজে অবস্থান করবেন। বুধবার তারা পাংশায় প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ এলাকা পরিদর্শন করবেন। এদিন রাতে ভারতীয় প্রতিনিধি দলটি সোনারগাঁও হোটেলে এসে রাত্রি যাপন করবেন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবণ পদ্মায় সকাল সাড়ে ১০টায় আলোচনায় বসবেন। শুক্রবার সকালে তারা কলকাতার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবেন।
এদিকে ভারতের অনুসন্ধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ দিল্লীকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, এই ব্যরাজ নির্মাণ হলে পানি ‘ব্যাক ফ্লো’ হয়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন সৃষ্টি করবেÑ এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ, গঙ্গা ব্যরাজের পানি ‘ব্যাক ফ্লো’ হয়ে কোনভাইে ভারতীয় অংশে আঘাত হানবে না। আর ব্যাক ফ্লো হলেও প্রায় ২শ’ কিলোমিটার দূরে ঢেউ যেয়ে ভারতীয় অংশে ভাঙন ধরানোর প্রশ্নই আসে না। এ জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে যৌথ সমীক্ষা করার প্রস্তাব রাখা হয়।
দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বার্থেই এই ব্যারাজটি নির্মাণ করা প্রয়োজন। কারণ হিসাবে বলা হয়, ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুৃক্তির পর ২০টি বছর কেটে গেছে। আর মাত্র ১০ বছর পরই গঙ্গা পানি চুক্তি নিয়ে নতুন করে ভারতের সাথে দেনদরবারে বসতে হবে বাংলাদেশকে। এই বাস্তবতার নিরিখে রাজবাড়ী জেলার পাংশায় বহুল প্রতীক্ষিত গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ প্রকল্পের মূল কাজ আজও শুরু করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই ব্যারাজ নির্মাণ শুরু হলে ৭ বছরেই তা শেষ করা সম্ভব হতো। মেগা প্রকল্প হিসাবে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এটি স্থান পেয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় ১১৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ব্যারাজের ওপর যে ব্রিজ করা হবে, সেখান থেকে টোল আদায় করা হবে। এ দুটি থেকেই মোট বিনিয়োগের এক-চতুর্থাংশ ফেরত আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এছাড়া প্রায় ১৭টি জেলায় কৃষি ও সেচের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা থেকেই উঠে আসবে বাকি বিনিয়োগ। এই ব্যারাজ নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ, বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পাবনা এবং রাজশাহী বিভাগের ৭টি জেলার ১৯ লাখ হেক্টর কৃষিজমির সেচের পানি সুনিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত হবে বর্ষা মৌসুমে প্রবাহিত পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ ধরে রাখা যাবে এবং মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রসার হবে।
বহুমুখী এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে ২ কিলোমিটার ও প্রস্থ হবে ১৮ মিটার। এতে থাকবে বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার। আরো থাকবে নেভিগেশেন লক, সøুইস গেট, ২৫ মিটার করে দুটি ফিশ পাস গেট, ব্রিজ, রেলওয়ে ও গ্যাস পাইপ লাইন।
ব্যারেজট নির্মাণ হলে গঙ্গা অববাহিকার ১৬টি নদী নাব্যতা ফিরে পাবে এবং বছরজুড়েই এসব নদীতে পানি থাকবে। এছাড়াও প্রতিবছর সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যাবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • মুসা ২৪ অক্টোবর, ২০১৬, ৩:০৩ এএম says : 0
    বাংলাদেশ সরকারের উচিত বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করা, ফারাক্কা নিয়ে কেউ বাংলাদেশকে জিজ্ঞাসা করেনি । গঙ্গ্যা ব্যারেজ প্রকল্প এ দেশের বাচার প্রকল্প ।
    Total Reply(0) Reply
  • আবদুল্লাহ আমজাদ হোসেন ২৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১০:৪৭ এএম says : 0
    ফারাক্কা আমাদের হাজারো সমস্যা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ কি পেরেছে এর একটা চিঠি দিয়ে বাধা দিতে??
    Total Reply(0) Reply
  • Akbor ২৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১০:৪৯ এএম says : 0
    Ora Jokhon Tistha Barej Dise tokhon to Bar Bar Bangladesh thake Onurod korchilo Ai bad amader Des k Onek khotir Korbe Koi tara to amader kotha Sune nai R akhon amara jokhon Gonga baraj Banabo Tokhoni oder matha batha Suro hoye gase India abaro proman korlo Oder Sartho Sobar Age
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দিল্লীর সিদ্ধান্তের ফাঁদে ‘গঙ্গা ব্যারাজ’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ