Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

গলার কাঁটা লেভেল ক্রসিং

নিরাপদ বাহন রেল : দুর্ঘটনায় সিডিউল বিপর্যয় সড়কের সঙ্গে রেলের সমন্বয় নেই। লেভেল ক্রসিংসহ রেল লাইনের আশপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ : অধ্যাপক ড. শাসসুল হক

একলাছ হক | প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

নিরাপদ বাহন রেল এখন অনিরাপদ। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব লেভেল ক্রসিং দিন দিন পরিণত হচ্ছে মৃত্যুফাঁদে। প্রতিনিয়তই প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। গত কয়েকদিনে রেলক্রসিংয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ছয়জন। এসব দুর্ঘটনার সবগুলোই ঘটেছে গেটম্যানের অবহেলায় অথবা অরক্ষিত ও অনুমোদনহীন রেলক্রসিংয়ে। আর দুঘটনার কারণে দেখা দেয় ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়। বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে ট্রেন। এতে দুর্ভোগে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী। দুর্ঘটনা ঘটলেই গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তারপর কি হয় কেউ জানেনা। অরক্ষিত রেল ক্রসিং আর অসচেতনতায় ঢাকাসহ সারাদেশে ট্রেনে কাটা পড়ে বাড়ছে মৃত্যু।

রেলওয়ের তথ্য মতে, সারা দেশে তিন হাজার ৩৯৮টি ক্রসিংয়ের মধ্যে এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। আর অরক্ষিত দুই হাজার ৫৪টি। গেটম্যান নেই ৬৩২টি ক্রসিংয়ে। রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। লেভেল ক্রসিং এগুলোকে বৈধ, অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড) এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। কখনো বাসের সঙ্গে, কখনো মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিস ঝুলিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। পাহারাদার ট্রেন আসার সঙ্কেত পেয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। পাহারাদার নেই এমন অরক্ষিত ক্রসিং আছে অনেক। অবৈধ রেলক্রসিংয়ের মধ্যে রাজধানী ছাড়াও সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও গ্রামীণ সড়ক ও ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা রেল লাইনে সংযোগ রয়েছে।

রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৮৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১১১ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে রেলক্রসিংয়ে ঘটা ৯৬ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৯৯ জন। তাদের প্রায় সবাই ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী।

রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারায়, সে হিসাব রেল র্কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে না। তবে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে রেলপথে ৮৫৫ দুর্ঘটনায় ৯১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যার হিসেবে গড়ে প্রতিবছর ১৭৮ জন মানুষ রেললাইনে মৃত্যুবরণ করছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের মোট অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ও এলজিইডির রাস্তা রয়েছে ৪২৭টি করে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৪, পৌরসভার ১১০, সিটি করপোরেশনের ৩২, একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ২৭, জেলা পরিষদের ১৩ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি। এ ছাড়া ১২৭টি ক্রসিং কার আওতায় আছে তা জানা যায়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রেললাইনের পাশে গড়ে উঠেছে বাজার। খিলগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, এফডিসি মোড়, তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী ও আশকোনা রেলক্রসিংগুলোর একই চিত্র। ট্রেন আসার আগ মুহ‚র্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন। কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই।
দায়িত্বরত গেটম্যানরা বাঁশি বাজালেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। আর অনেক লেভেল ক্রসিং আছে যেখানে নেই কোন গেটম্যান অথবা নেই কোন প্রতিবন্ধকতা। লাইনের দুইপাশের মানুষ প্রবেশ নিষেধ থাকলেও কোন কোন এলাকায় এই রেল লাইনের মধ্যে বসেই অনেকে মোবাইলে গান শুনেন। আবার অনেককে বসে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। রেলের আইন অনুসারে লাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় যেকোনো মানুষ প্রবেশ করলেই তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এমনকি ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটকের মাধ্যমে বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে জমার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব আইন মানেন না কেউই। আবার আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই।

কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অংশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিংয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পরই ট্রেন আসা-যাওয়া করছে। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে অনেকে। এমন অবস্থায় অনেকে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনে শুনে রেললাইন ধরে চলেন। ঘনবসতি এলাকা দিয়ে চলাচলের সময় ট্রেনের হুইসেল শুনতে না পাওয়া। ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করা। নেশাগ্রস্ত হয়ে রেললাইনে চলাচল করছে অনেক উঠতি বয়সের ছেলেরা। রেল লাইনের অরক্ষিত গেটগুলোর আশেপাশে দাঁড়িয়ে মাদক বিক্রি করতেও দেখা গেছে।

এছাড়াও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেল লাইনের বেশকয়েকটি ব্যস্ততম এলাকায় লেভেল ক্রসিং নেই। এই রুটের বেশিরভাগ এলাকায়ই লাইনের উপর বসে বাজার। গেন্ডরিয়া এলাকায় রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠেছে ছোট ছোট শিল্প কারখানা। শিল্পকারখানার মালামাল রাখা হয় রেল লাইনের কাছে। কোন কোন কারখানার পণ্য আবার শুকাতে দেয়া হয় রেল লাইনের উপরে।

রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। রেলপথ মানুষের চলাচলের জন্য নয়। রেলের সব গেটে সাবধানতা চিহ্ন দেয়া থাকে। রেলপথ এলাকায় বেড়া দেয়া থাকে। এসব বেড়া ভেঙেও লোকজন প্রবেশ করে। নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ থেকে বিরত থাকতে হবে। রেল লাইন আছে এমন এলাকাতে সতর্ক হয়ে চলাচল করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শাসসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, মানুষ বাঁচানোর উন্নয়ন করতে হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৌশলী পরিকল্পনা হাতে নেয়া প্রয়োজন। দিন দিন বাড়ছে বসতি। নগরায়নের জন্য রেল লাইনের প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে একটি করে লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়ে গেছে। সব স্থানে বৈধ লেভেলক্রসিং থাকলে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। সড়কের সঙ্গে রেলের কোনো সমন্বয় নেই। শুধু যে লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ তা নয়। রেল লাইনের আশেপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবন্ধক বা পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার কোন অর্থ নেই। রেল লাইনের পাশে ৩ ফুট করে খুঁটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ