Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ছবি তোলার চেয়ে মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা করাই মানবতার দাবি

প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু তাহের
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজা বেগম গত ৩ অক্টোবর বিকেলে সিলেটের এমসি কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পথে মারাত্মক আক্রমণের শিকার হয়। খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল। এ ধরনের অমানবিক, নিষ্ঠুর ঘটনা দেশের মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাকে স্বাভাবিকভাবেই বাড়িয়ে দেয়। সিলেটের জনতা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নামধারী বদরুলকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। খাদিজা এখন চিকিৎসাধীন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। খাদিজার প্রতি সমবেদনা জানাই। মহান আল্লাহতায়ালা যেন তাকে সুস্থ করে তোলেন।
হামলাকারী বদরুল আলমের দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল সিলেট মহানগর। সিলেট জেলা ও অন্যান্য জেলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। আরও একটি মর্মান্তিক সংবাদ হলো, আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে দুই ছাত্রীকে হুমকি দেয়া এবং একজনকে কোপানোর হুমকির অভিযোগের বিষয়টিও সংবাদপত্র থেকে জানা যায়। এটি আরও বেশি ভয়ঙ্কর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমরা একটি চূড়ান্ত অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে চলছি, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধগুলো এক এক করে যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেন দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ বছরের আলোচিত খাগড়াছড়ির স্কুলছাত্রী আয়না মারমা, চাপাই নবাবগঞ্জের স্কুল ছাত্রী কনিকা ঘোষ, ঢাকার উইলস্্ লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের মেধাবী ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা, মাদারীপুরের নিতু মন্ডলের পরে সিলেটের খাদিজা আক্তারের এবং লক্ষ্মীপুরের ডিগ্রী পরিক্ষার্থী ফারহানা আক্তারের ওপর একই ধরনের নৃশংস হামলার ঘটনা দেশের সচেতন মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যেন ক্রমশ বর্বরতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনুভূতি যেন নড়ে উঠে না। প্রকাশ্যে খাদিজাকে কুপিয়ে মারছে, আর আমরা মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ধারণ করছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে নারী-শিশু নির্যাতন বাড়ছে তা দেখে মনে হয়, সমাজ যেন প্রতিদিন অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। ক্ষয়িঞ্চু এই সামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ সমাজ চিন্তাবিদসহ সকলকেই খুঁজে বের করতে হবে। নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ, সহিংসতা, ধর্ষণ, খুন বেড়েই চলেছে। এসব অপরাধ বন্ধ করতে না পারলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এজন্য জাগাতে হবে আমাদের মানসিকতাকে। এজন্য বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ হওয়া দরকার। অপরাধী যখন দেখে অপরাধ করার পরেও শাস্তি হয় না, তখন তার মধ্যে একটা তৃপ্তি কাজ করে। পাশাপাশি অন্য অপরাধীরাও অপরাধ করতে সাহস পায়, বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এজন্য রাষ্ট্রকে আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে, যাতে অপরাধী মনে করতে না পারে আইন ভঙ করা তার কাছে কোন বিষয়ই নয়। জাতি হিসাবে যেখানে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে আমরা সামাজিকভাবে পশ্চাৎগামী হচ্ছি। আলোর দিকে না গিয়ে সমাজ যেন অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল সমতা, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা, দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। দেশের খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদের শ্রম ঘাম, মেধা ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রেখেছেন। নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশের কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসী এবং গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত বিপুল সংখ্যক নারী কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও এইডস্্সহ অন্যান্য রোগ দূর করা, টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে এই উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে-এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। মনে রাখা দরকার, মানবাধিকারই যে কোন সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার অন্যতম নিরিখ। মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি দিয়ে নিরাপরাধ একটি মেয়েকে বর্বরভাবে কোপাচ্ছে, অনেকগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে, বাস্তব ঘটনা এরূপ হতে পারে তা যেন কল্পনা করা যায় না। এ দৃশ্য যেন সিনেমাকে হার মানায়। এ সমস্ত নির্যাতনের ঘটনার ছবি তোলার চেয়ে অপরাধীকে বিরত করার চেষ্টা করাই মানবতার দাবি। এ কাজটি সরকার হয়তো সবসময় তাৎক্ষণিকভাবে করে দিতে পারবে না। মানুষের মানবিক মূল্যবোধ থেকেই ভয়কে দূর করে সৎ সাহসের মাধ্যমে কাজটি করতে হবে। বেশ কয়েকজন মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে চিৎকার শুরু করলে হয়তো বদরুলের চাপাতি থেমে যেত। তাৎক্ষণিকভাবে এ ভূমিকা রাখতে এবং খাদিজাকে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে না পারলেও নরপশুটিকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করতে এবং খাদিজাকে হাসপাতালে নিতে এগিয়ে যায় সিলেট এমসি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জুনেদ আহমদ জনি। চরম বিপদের সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও খাদিজাকে বাঁচানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নেন জনি। এ কাজটি করে জনি মানবিকতা, সাহসিকতা ও মূল্যবোধের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে অসাধারণ চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। খাদিজাকে বাঁচানোর এ উদ্যোগটিও বদরুলকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়া তার ব্যক্তিগত সাহস ও নৈতিক মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে সমাজের কাছে। জনির এই সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখতে চাই না, কেননা যদি বদরুল খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কোনো রকম পালিয়ে যেতে পারতো তাহলে বিচার প্রক্রিয়াই বিলম্বিত হয়ে যেত। সিলেটের সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা ইমরান কবির খাদিজাকে বাঁচানোর জন্য রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে জুনেদ ইমরানরাই মানবিক মূল্যবোধের প্রতীক। তারাই হচ্ছে যুব সমাজের প্রতিচ্ছবি। তারাই আমাদের আশার আলো। খাদিজার ওপর নৃশংসতার মহান জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা ঘটে যা খুবই দুঃখজনক, আমাদের অবাক করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখতে হবে এবং সে তার কৃতকর্মের শাস্তি পাবেই। অপরাধী কোন দল করে সেটা দেখার বিষয় হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে করি। অপরাধীকে অপরাধী হিসাবে না ভাবা আমাদের দেশে একটি কালচারে পরিণত হয়েছে। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীকে অপরাধী হিসাবে আখ্যায়িত করতে নারাজ। আমরা অপরাধীর ব্যক্তিগত পরিচয়কেই বড় করে দেখি। কখনও কখনও অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করে দেখা হয়। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয়কে, ব্যক্তিগত পরিচয়কে বড় করে দেখা কোন অবস্থাতেই উচিত নয়। কোনো অপরাধ সংগঠিত হলে যার দ্বারা অপরাধ সংগঠিত হয় তার রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করাও সবক্ষেত্রে যুক্তিসংগত নয় বলে আমি মনি করি। অপরাধীর পরিচয় হোক অপরাধী। সচেতন দেশবাসী বদরুলের দ্রুত বিচার দেখতে চায়। কেননা “জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড”- বিলম্বে বিচার পাওয়া বিচার না পাওয়ারই নামান্তর। খাদিজার বাবা মাশুক মিয়া জেদ্দা থেকে এসে স্কয়ার হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার মেয়ের মতো অবস্থা যেন আর কোন নারীর না হয়। তিনি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদরুল আলমের বিচার দাবি করেছেন। বদরুলের বিচার হয়তো হবে, কিন্তু এটাও সত্য বদরুল পশু হয়ে জন্মায়নি, অমানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। বদরুলের বাবা-মা তাকে অনেক পরিশ্রম করে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে লেখাপড়া করিয়েছেন। বদরুলের মতো অমানুষের সংখ্যা যেন সমাজে বৃদ্ধি না পায় সে জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। দেশে এখনও ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। খারাপ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশের মানুষ এখনও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সেজন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠ পোষকতায় মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে এক নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনের জন্য সচেষ্ট থাকা দরকার। প্রেমে সাড়া না দেয়ার কারণে মেয়ে শিক্ষার্থীদের যদি এ ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হয়, তাহলে কিভাবে নারী শিক্ষার অগ্রগতি হবে? নারী শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে না পারলে, নারী নির্যাতন বন্ধ না করতে পারলে নারী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হবে না। এ বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সচেতন নাগরিক সমাজ, শিক্ষক-অভিভাবক সকলকেই ভাবতে হবে। কিছু সংখ্যক মানুষ নামধারীদের অমানবিক ও নিষ্ঠুর চাহিদার কারণে সমাজ ব্যবস্থাকে নষ্ট হতে দেয়া যায় না। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের অমানবিক ঘটনার সংবাদ পত্র-পত্রিকাতে ছাপা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই হবে, স্বাধীন সার্বভৌম দেশে এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। নারী নির্যাতনকারী নরপশুদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। বখাটেদের বিরুদ্ধে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারী বাড়াতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট এবং সভাপতি ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন মৌলভীবাজার জেলা কমিটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছবি তোলার চেয়ে মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা করাই মানবতার দাবি
আরও পড়ুন