Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মওলানা ভাসানী ও কাগমারী সম্মেলন

প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া  : মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন। এর মধ্যে তার অবিস্মরণীয় কীর্তি ১৯৫৭ সালের ‘কাগমারী সম্মেলন’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর তাৎপর্য বিশেষভাবে স্বীকৃত।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় রূপমহল সিনেমা হলে। এই অধিবেশনে বলা হয়-“......পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, যে সব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়েছে।” ৫৬-র ১৯-২০ মে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনেও যুদ্ধজোটের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়। তাতে বলা হয়, “কোনো বৈদেশিক শক্তির লেজুর”-হিসেবে না থেকে পাকিস্তান সরকারের উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। এই জাতীয় প্রস্তাব আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার বিতৃষ্ণার কারণ হয় এবং মওলানা ভাসানী হন তাদের বিরাগভাজন।
দুটি প্রধান বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য বিরোধে পর্যবষিত হয়, যার একটি অবহেলিত শোষিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আর অপরটি সকল সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ। এই দুটি বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপসপ্রবণ ও নমনীয়। পক্ষান্তরে মওলানা ভাসানী ছিলেন অনড় ও আপসহীন। অবশ্য এই দুটি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না। এগুলো ছিল আওয়ামী লীগেরই নীতি। দলের দুই প্রধান নেতার মধ্যে যখন মতবিরোধ চরমে তখনই মওলানা ভাসানী দলীয় প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি। মওলানা ভাসানী যখন কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেন তখন তারই প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তদুপরি ওই সময়ে বৈদেশিক নীতি বিশেষ করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদনসহ ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সামরিক চুক্তি’ ও ‘বাগদাদ চুক্তি’ সংস্থার সদস্যভুক্তির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো দ্বৈততা চরম আকার ধারণ করে বলে কাগমারী সম্মেলনটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে বৈদেশেক নীতির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে মতবিরোধ নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে কাগমারী সম্মেলনের ঘোষণা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর অন্তরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক সম্মেলনে রূপ নেয়। এই সম্মেলনকে ঘিরে যেমন পাকিস্তানী ‘দর্শনে’র সমর্থকরা বিরূপ সমালোচনায় মুখর হয়, তেমনি আওয়ামী লীগের মুখপাত্র বলে পরিচিত এবং প্রকৃত প্রস্তাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক পত্র-পত্রিকাগুলোও কাগমারী সম্মেলনকে সুনজরে না দেখে বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিরূপ সমালোচনা করে। উল্লেখ্য, কাগমারী সম্মেলনের মাত্র স্বল্প সময়ের মাথায় আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অপসারণ এবং সবশেষ ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ও সামরিক শাসন জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এসব কারণেই স্বাধীন জাতি রূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমি নির্মাণে কাগমারী সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ।
কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার গরিব চাষী, মজুর, ছাত্র, যুবক ও জনসাধারণের প্রতি এক আবেদনে মওলানা ভাসানী বলেন: “এদেশে শুধু মন্ত্রী, মেম্বার, সরকারি কর্মচারীদের নহে এদেশ অগণিত জনসাধারণের দেশ। যাহারা এদেশ পরিচালিত করেন, তারা শতকরা ৯৫ জন গরিব চাষী, মজুর, কামার, কুমার প্রভৃতি শ্রেণীর জনসাধারণের টাকা দিয়েই চলে। ............ পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের দাবি এবং ২১ দফার বাকি ১৪ দফা দাবি পূরণের জন্য বিচ্ছিন্ন জনশক্তিকে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
দেশের নানাবিধ সমস্যার সমাধানের উপায় উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমি আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি হতে সপ্তাহব্যাপী সন্তোষের কাগমারীতে এক বিরাট সম্মেলন আহ্বান করেছি। দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করে জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন জোরদার করুন।”
৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়-* সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক, * ঐতিহাসিক ২১ দফা আদায়ের ডাক, * চাষী-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সকল শ্রেণীর মিলনের ডাক, * পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক, * ২১ দফার পূর্ণ রূপায়নের জন্য আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হতে মুক্তির মহান সনদ, যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই।---মওলানা ভাসানী
যখন তার দল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং আতউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন এই বক্তব্য দিয়ে একটি মহাসম্মেলনের আয়োজন খুবই তাৎপর্য পূর্ণ এবং সহজবোধ্যও বটে। কাগমারী সম্মেলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান-সহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার প্রায় সকল সদস্যই যোগ দেন। কাগমারী সম্মেলন সফল করতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। তার বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য সদস্যরা হলেন : ইয়ার মোহাম্মদ খান, কাজী মো. ইদরীস, ফকির সাহবুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সদর ইস্পাহানী, আবু জাফর শামসুদ্দিন। সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এই সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তায় তোরণ নির্মিত হয়। সেই তোরণগুলির নামকরণ করা হয় বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং ব্রিটিশ বিরোধী উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে। উল্লেখযোগ্য তোরণগুলোর নাম হলো- হযরত মোহাম্মদ (সা.) তোরণ, মহাত্মা গান্ধী তোরণ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী তোরণ, কাজী নজরুল ইসলাম তোরণ, মহাকবী ইকবাল তোরণ, নেতাজী সুভাস বোস তোরণ, হাজী শরিয়তউল্লাহ তোরণ, শহীদ তিতুমির তোরণ, প-িত জহরলাল নেহেরু তোরণ, হাজী মোহাম্মদ মহসীন তোরণ, সি.আর.দাস তোরণ, লেলিন তোরণ, স্ট্যালিন তোরণ, মাও সেতুং তোরণ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তোরণ, বায়রন তোরণ, শেলী তোরণ, মাওলানা রুমী তোরণ, হযরত ইমাম আবু হানিফা তোরণ, হযরত ইমাম গাজ্জালী তোরণÑ এভাবে ৫১টি তোরণের নামকরণ করেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে।
এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়কের। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্নো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। জহরলাল নেহেরু, বিধান চন্দ্র রায় ও জামাল আবদুল নাসের চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করেন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তার ভাষণের এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তার সুপরিচিত ও সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ঐ ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতাদের মতে, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তার জন্যে প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প ওই ‘আসসালামু আলাইকুম’ ধ্বনীর মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল।” সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্যে মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দু’ধরনের বক্তব্যই রাখেন। উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপরও দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এই বলে যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলেও সামরিক-বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্য নীতি পালিত না হলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলবে ৮ ফেব্রুয়ারি মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. কাজী মোতাহের হোসেন।
কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক- বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল-কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। এ নামকরণ যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তা আলোচনার প্রয়োজন নেই। কাগমারী সম্মেলনে অধিবেশনের আলোচনা ও প্রস্তাবসমূহ সর্বসম্মত না হলেও সাংস্কৃতিক সম্মেলনটি সূচারু রূপে সমাপ্ত হয়। এই সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানী ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগের সাথে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠে।
প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং তাদের সহকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে নীতির প্রশ্নে আপসের কোন সুযোগ ছিল না। তারা বলেছিলেন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন হয়েই গেছে এবং মার্কিনপন্থি জোটভুক্ত পরররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলেও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনীহা ছিল। এসব প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিচল ও আপসহীন। তিনি তার মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তবে দল ত্যাগের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোন উচ্চবাক্য করেননি। যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাই নন-আপ্রাণ চেষ্টায় দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে তোলেন, যে দলটির পতাকার নিচে সমবেত করেন দেশের সকল এলাকার সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে, যে দলটি কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন, যে দলের প্রধান তিনি, সেই দল পরিত্যাগ করার মুহূর্তে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু আদর্শ ও নীতির সঙ্গে আপস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণ এবং তার ‘আসসালামু আলাইকুম’ যে বিতর্কের সূচনা করে তাতে প্রধামন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, বিব্রত হন, পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে একটি নমনীয় বিবৃতিও প্রদান করেন, যা ৫৭-র ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সমস্ত পত্র-পত্রিকার প্রকাশিত হয়। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন, পক্ষান্তরে সম্মলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এই নিয়ে দুই দল ছাত্রদের মধ্যে প্রচ- মারামারিও হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বামপন্থিদের সাথে একটি বোঝাপড়ার চেষ্টা চালান, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ১৯৫৫ সালের মে অধিবেশনের প্রস্তাবাবলী পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবি ইত্যাদি নিয়ে সে সভায় দীর্ঘ আলোচনা চলে। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার সমর্থকদের মার্কিন ঘেঁষা ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ও তার অনুগতরা অবিচল থাকেন। উভয় পক্ষই তাদের এই অনমনীয় মনোভাবের পরিণতি কি তাও তারা জানতেন। আদর্শগত অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙন অবশ্যসম্ভাবী হয়ে পড়ে।
সম্মেলনের পর ২৬ মার্চ ১৯৫৭ মওলানা ভাসানী একটি প্রচারপত্র বিলি করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন’- ‘ভাইসব, উভয় পাকিস্তানের সংহতি ও মিলন নির্ভর করে একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের উপর। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ব্যতিত সাড়ে চার কোটি বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সমাজ জীবনে মুক্তি অসম্ভব।........... গদীর মোহে মুসলীম লীগের সহিত হাত মিলাইয়া সারে চার কোটি বাঙালিকে চিরকালের জন্য কৃতদাস বানাইতে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিসর্জন দিয়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাস করে ছিল, তারাই পুনরায় সাম্রাজ্যবাদী ও কোটিপতি শোষকদের সহিত হাত মিলাইয়া বর্তমানে আমার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি, পোস্টার, বিজ্ঞাপন ছড়াইয়া সারাদেশময় মিথ্যা প্রচার শুরু করেছে। এসব কুচক্রিদের দেশবাসী ভালো করেই চিনে। তারা গত ৯ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’
কাগমারী সম্মেলনের পরই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং এক পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং আওয়ামী লীগের ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে জনমত প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তানের মেহনতী জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।
ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীকার আন্দোলনের সূচনা হয়। সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করতে এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী যে গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন তা আজো আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা-মানচিত্র রক্ষার সংগ্রামে এবং সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও লড়াইয়ে এখনো অনুপ্রেরণা যোগায়।
লেখক : রাজনীতিক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মওলানা ভাসানী ও কাগমারী সম্মেলন
আরও পড়ুন