Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্ত্রাস-বিদ্রোহ-অরাজকতা প্রতিরোধে আলাউদ্দীন খিলজির কৌশল

প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কে এস সিদ্দিকী
(১৪ অক্টোবর প্রকাশিতের পর)
সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির আহ্বানে দরবারের আমির-ওমারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, জ্ঞানী-গুণী এবং চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী সবাই উপস্থিত হন এবং সা¤্রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী বুদ্ধিজীবী বললেন যে, তাদের মতে বিদ্রোহের চারটি কারণ আছে। এসব কারণ হচ্ছে :
(১) বাদশাহের তার প্রজা সাধারণের অবস্থা জানা না থাকা,
(২) সা¤্রাজ্যে মদ্যপানের ব্যাপকতা,
(৩) আমির শাসকদের আত্মীয়স্বজন ও নিকটতমদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে জোট পাকানো এবং
(৪) লোকদের কাছে বিপুল অর্থ সম্পদের সমাহার।
আলাউদ্দীন তাদের পেশ করা সকল বক্তব্য মনোযোগসহকারে শ্রবণ করেন এবং উত্থাপিত চারটি বিষয় রোধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রজা সাধারণের অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য সংবাদ পরিবেশনকারী বিভাগের উন্নয়ন সাধন করেন এবং অসংখ্য গুপ্তচর এই উদ্দেশ্যে নিয়োগ করেন যে, তাকে প্রজাদের সম্পর্কে সর্বপ্রকারের ভালো মন্দ খবর দ্রুত সরবরাহ করবে।এ সকল গোয়েন্দা তাদের তৎপরতা আরম্ভ করে দেয়। তখন অবস্থা এমন রূপ ধারণ করে যে, আমির-ওমারা ও অফিসারদের গৃহে তাদের স্ত্রী-বাচ্চারা যেসব কথাবার্তা বলে, আলাপ-আলোচনা করে সবই বাদশাহের কাছে পৌঁছে যায়। এসব আমির-ওমারা, কর্মকর্তা সকালে যখন বাদশাহের দরবারে উপস্থিত হতেন বাদশাহ তাদের বলে দিতেন বিগত রাতে স্ত্রীর সাথে কে কী কথা বলেছেন, তখন কেউ তা অস্বীকার করতে পারত না। বাদশাহের নিকট তার লিখিত প্রমাণ থাকত। এসব লিখিত বিবরণ বাদশাহর নিযুক্ত গোয়েন্দা সরবরাহ করত।
এ ব্যাপক গোয়েন্দা তৎপরতার ফলে আমির-ওমারা ও সাধারণ লোকদের মধ্যে পরস্পর কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি নিজের গৃহে কথা বলতেও তারা সতর্ক হয়ে যায়।
বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীগণ মদ্যপানকে বিদ্রোহের একটি কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, মদপান করলে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না এবং সে ফেতনা-ফ্যাসাদে জড়াতে থাকে। এর প্রতিকারের জন্য আলাউদ্দীন এই উপায় অবলম্বন করেন যে, প্রথমে তিনি মদপান ত্যাগ করেন। সমগ্র দেশের শহরে শহরে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয় যে, বাদশাহ মদপান ছেড়ে দিয়েছেন। অতঃপর ঘোষণা করা হয়, আগামীতে কোথাও মদপানের কোনো  আসর বা বৈঠক হতে পারবে না। এ ঘোষণা কার্যকর হিসেবে দেখানোর জন্য সর্বপ্রথম সেই ইমারতটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়, যেখানে বসে বাদশাহ এবং মোসাহেবরা মদপানের আসর জমাতেন। এরপর বদায়ূনের প্রবেশদ্বারগুলোর নিকট যেসব মটকা বা বড় পাত্র ছিল সেগুলো মাটিতে উপুড় করে ফেলে দেওয়া হয় এবং পাত্রগুলো ভেঙে দেওয়া হয়। কাচের সুরাপাত্র এবং অন্যান্য মদের পাত্র ছাড়া ও রুপার জাম পেয়ালা এবং মদের পাত্র ও মটকা সমস্তই আগুনে গলানো হয় এবং সেগুলো দ্বারা মুদ্রা ঢালাই করে অর্থ ভা-ারে জমা করা হয়। সকল শহরে ঘোষণা প্রচার করা হয়, মদ্যপান অবস্থায় যাকে পাওয়া যাবে তার শিরñেদ করা হবে।
ফের ফরমান জারি করা হয়, যার নিকট মদ রয়েছে, সে যেন তা সড়কে নিক্ষেপ করে। এ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে এত বিপুল পরিমাণ মদ সড়কগুলোতে বইতে থাকে যে, বর্ষাকালের দিনগুলোর ন্যায় সেগুলো কাদাযুক্ত হয়ে যায়।
সরকারি গোয়েন্দারা সর্বত্র আনাচে-কানাচে অবস্থান করত এবং প্রত্যেক ব্যক্তির গতিবিধির প্রতি কড়া সৃষ্টি রাখত। ভয়ঙ্কর অপরাধীদের একটি কূপে নিক্ষেপ করা হতো, যা বিশেষভাবে তাদের জন্যই খনন করা হতো। এ কূপে আটকদের অনেকেই এ বন্দিদশায় মৃত্যুবরণ করত। ভাগ্যক্রমে যারা মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যেত, তারা বহু বছর চিকিৎসার পর চলাফেরা করার শক্তি অর্জন করত।
বুদ্ধিজীবীরা নানা স্থানে বিদ্রোহের তৃতীয় কারণ বলেছিলেন, আমির ও অফিসারদের মধ্যে যোগাযোগ সম্পর্কের কারণে দল ও জোট গঠন। তাদের মত, সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। যখন বাদশাহের আমিরদের মধ্যে কোনো আমির ষড়যন্ত্র অথবা বিদ্রোহ করত, তখন তার সকল আত্মীয়স্বজন তার পক্ষ অবলম্বন করত। এভাবে যে আমিরের পরিবার বড় হতো, তার কাছে তার আত্মীয়স্বজনদের এক বিরাট বাহিনী হয়ে যেত। আলাউদ্দীন এ দুর্বলতা দূর করার জন্য নির্দেশ দিলেন যে, কোনো আমির বাদশাহের অনুমতি ছাড়া তার কোনো ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না। অনরূপভাবে আমিরদের পরস্পরের মধ্যে মেলামেশাও নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করতে হলে বাদশাহের অনুমতি প্রয়োজন হতো। যদি কোনো আমিরের গৃহে হঠাৎ কোনো মেহমান এসে যেত অথবা তিনি তার ছেলে বা মেয়ের সম্বন্ধ  করতে চাইতেন তা হলে মন্ত্রী সৈয়দ খানের কাছে আবেদন করতে হতো। বাদশাহ এ মন্ত্রীকে এ কাজেই নিয়োগ দেন। সৈয়দ খান এ আবেদনপত্র বাদশাহের সমীপে পেশ করতেন। বাদশাহ উপযুক্ত মনে করলে অনুমতি দিতেন, নয়তো অস্বীকার করতেন।
বাদশাহকে বিদ্রোহের চতুর্থ কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল যে, যখন নি¤œস্তরের লোকদের কাছে অর্থ সম্পদ বেড়ে যায় তখন তারা বাদশাহ হওয়ার জন্য বিদ্রোহ এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আলাউদ্দীন বিদ্রোহের এ কারণ দূর করার জন্য প্রজা সাধারণের কাছ থেকে যে কোনো প্রকারেই হোক অর্থ ছিনিয়ে নিয়ে নিজের অর্থ ভা-ারে জমা করতে থাকেন। প্রতিটি কসবা গ্রামের নিষ্কর ও ওয়াকফ সম্পত্তি কিংবা যে কোনোভাবে প্রজাদের দখলে ছিল সেসব সম্পত্তি বাদশাহের মালিকানাভুক্ত করা হয়। প্রত্যেক ব্যক্তির সঞ্চয় করা পুঁজি তার কাছ থেকে নিয়ে অর্থ ভা-ারে জমা করে দেওয়া হয়। গ্রামীণ এলাকায় চৌধুরীদের আর্থিক অবস্থা হ্রাস করার জন্য বাদশাহ আইন করেন যে, ভূমি জরিপ করে সমগ্র উৎপাদন সমীক্ষা করতে হবে এবং তার অর্ধেক মালিকদের কাছ থেকে নিয়ে অর্থ ভা-ারে জমা করতে হবে। এ আইন সবার ক্ষেত্রে প্রযোগ্য হবে। চৌধুরীগণ তাদের অধিকার মনে করে যে অংশ নিয়ে যেতেন তাও রাজ ভা-ারে জমা হতে লাগল। বলা হয় গায়ের চৌধুরী ও জামিদাররা চাষবাসের জন্য চারটি গরু এবং দুধ-দই-এর জন্য দুটি মহিষ, দুটি গাভী এবং বারোটি বকরির অধিক রাখতে পারবে না। আরও বলা হয় পশু মালিকদের  কাছ থেকে চরানোর অর্থাৎ লালন-পালনের করও উসুল করা হবে।। যদি বাদশার কোনো চাকর এক পাই সমান তার পকেটে রাখে তাহলে সে শাস্তি ভোগ করবে। এর ফলে যেসব লোক বড়লোকের পোশাক পরিধান করত (অর্থাৎ দামি পোশাক), উত্তম খাবার গ্রহণ করত এবং ঘোড়ায় চড়ে বের হতো, মূল্যবান অস্ত্রও রাখত তারা এতই দরিদ্র নিঃস্ব হয়ে পড়ে যে, তাদের জীবনযাপন করাটাই কঠিন হয়ে পড়ে, এমন কি তাদের নারীরা অন্যদের গৃহে চাকরানি অর্থাৎ বুয়ার কাজ করতে বাধ্য হয়। আলাউদ্দীন খিলজি কর্তৃক সন্ত্রাস -বিদ্রোহ দমনের কৌশল অবলম্বনের বিবরণ পাঠ করলে তার সম্পর্কে মানুষের ধারণা যাই হোক না কেন তিনি তার সা¤্রাজ্যের সর্বত্র শান্তি-শঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  অনুরূপভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম তথা বাজার দর নিয়ন্ত্রণে তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিদ্যমান। শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে আলাউদ্দীনের বিভিন্ন পদক্ষেপকে সুনজরে দেখার উপায় নেই এবং ওইসব মন্দ কাজ তিনি কেন করতে গেলেন তাও বিবেচনা করার বিষয়। তিনি একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির নিছক জাহেল- অজ্ঞ শাসক ছিলেন। ‘আলিফ বা তা’ও জানতেন না। শৈশবে তিনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন এবং বাকি জীবনও কাটে তার জাহেল অজ্ঞ মূর্খের সাথে। যখন আলাউদ্দীন সুলতান হিসেবে সিংহাসনের অধিষ্ঠিত হন, তখন আরজি ও দরখাস্ত পাঠ করার জন্য লেখাপড়া শেখার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তার সম্পর্কে এসব অভিযোগ সত্য বলে অনেকে স্বীকার করেন।
সাথে সাথে এ কথাও সত্য যে, আলাউদ্দীন সিংহাসনে আরোহণ করার পর তার দরবারে যারা আমির-ওমারা-মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অফিসার নিযুক্ত হন, তারা সবাই ছিলেন জ্ঞানী, সুদক্ষ ও সুযোগ্য। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার পূর্বে আলাউদ্দীন তাদের পরামর্শ গ্রহণে সংকোচ বোধ করতেন না, যার প্রমাণ বহু ক্ষেত্রে রয়েছে। তার দোষ ও মন্দ কাজগুলোর পাশাপাশি যদি তার মধ্যে নিহিত ভালো দিকগুলো যাচাই করা হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, তাতে রাষ্ট্র ও জনগণের বহু কল্যাণ নিহিত ছিল। তার কঠোরতা ও রক্তপাত সমগ্র ভারত বর্ষে শান্তিশৃঙ্খলা বয়ে আনে। তার সিংহাসন লাভের পূর্বে সর্বত্র অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিরাজ করছিল। প্রতি এলাকায় লুটেরা এবং ডাকুদের কাছে জনগণ ছিল জিম্মি, বাণিজ্যিক ও ভ্রমণপথগুলো ছিল রুদ্ধ, ব্যাপারীরা তাদের মালামাল নিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারত না। ভ্রমণকারী নিরাপদে চলাফেরা করার সাহস হারিয়েছিল। কিন্তু আলাউদ্দীন যখন ডাকাত-দুর্বৃত্ত কবলিত এসব এলাকা তার সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন, তখন ওইসব দস্যু তস্কর লুটেরাদের খতম করে সড়কগুলো চলাচলের জন্য নিরাপদ করেন। ফলে সওদাগরেরা রাতের বেলায়ও আশঙ্কামুক্ত হয়ে সফর করতে থাকেন এবং কেউ তাদেরকে কিছুই বলতেন না। বাংলা হতে কাবুল পর্যন্ত এবং কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বাণিজ্যিক পথগুলো এমনভাবে সুরক্ষিত হয়ে যায় যে, মনে হতো সেগুলো দিল্লি শহরের অলিগলি। সওদাগরেরা যত খুশি মালামাল সঙ্গে রাখতে পারতেন, মুসাফিরদের অবস্থাও ছিল একই। এরা জঙ্গলে যেখানে ইচ্ছা সেখানে পা দরাজ করে স্বস্তিতে রাত যাপন করত। কারো সাহস ছিল না তাদের কোনো বস্তুতে হাত লাগানোর।
আলাউদ্দীনের প্রশাসনিক ও পরিচালনাগত যোগ্যতা প্রসংসিত হয়েছে। আলাউদ্দীনের একটি বড় গুণ ছিল, তিনি নির্ভীক সাহসী ছিলেন। তিনি যে রাজ্য অধিকার করতে চাইতেন, তা সহজেই অধিকার করে নিতেন, কোনো বাধাই মানতেন না। তার রাজত্বকালে তিনি ছোট-বড় সর্বমোট ৮৪টি যুদ্ধ করেন এবং প্রত্যেক যুদ্ধে শত্রুর ওপর জয়লাভ করেন। তার আমলে তিনি যত এলাকা জয় করেন অন্য কোনো বাদশাহর আমলে তা হয়নি। আলাউদ্দীন একজন যোগ্য শাসক ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার নীতি ছিল এই যে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে তিনি মা, বাবা, ভাই, স্ত্রী এবং সন্তান কারো প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করেননি।
আলাউদ্দীন খিলজি ছিলেন ভারতবর্ষের সেই সব মুসলিম রাজন্যবর্গের মধ্যে অন্যতম যারা সা¤্রাজ্যের সীমা সম্প্রসারণে বড় বড় যুদ্ধ করেছেন। উপমহাদেশের মুসলমানগণ প্রায় আটশ বছর রাজত্ব করেছেন। এতে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মুসলিম বংশ ক্ষমতাসীন ছিল। তাদের মধ্যে খিলজি বংশের আলাউদ্দীন ছিলেন অন্যতম। ওইসব বংশের বাদশাহগণ অল্প অল্প করে এলাকা দখল করলেও আলাউদ্দীন বিশাল এলাকা তার সা¤্রাজ্যভুক্ত করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সন্ত্রাস-বিদ্রোহ-অরাজকতা প্রতিরোধে আলাউদ্দীন খিলজির কৌশল
আরও পড়ুন