Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

ঢাকায় ট্যানারির বিষ

প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৫ এএম, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : ট্যানারির কঠিন ও তরল বর্জ্যরে দূষণে বিপর্যস্ত ঢাকা। চারিদিকে বাতাস আর পানিতে ঘুরছে বর্জ্যরে বিষ। এই বিষ হাজারীবাগ, লালবাগ, রায়েরবাজার, ঝিগাতলা, ধানমন্ডিসহ আশপাশের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা। এর মধ্যে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ট্যানারির বিষে আক্রান্ত। অসহনীয় পর্যায়ের দূষণে এবং পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, নানাভাবে এ বিষেই আক্রান্ত হচ্ছে ঢাকার কোটি কোটি মানুষ। গত ১০ জানুয়ারী শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যেসব ট্যানারি হাজারীবাগ ছাড়বে না, সেগুলো বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীর সে নির্দেশও শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। পরিবেশবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আখতার হোসেন খান বলেন, সরকার তার অবস্থানে অনঢ় থাকলে ট্যানারি শিল্প মালিকদের সরানো খুব একটা কঠিন হবে না। তিনি বলেন, ট্যানরির কারণে পুরো ঢাকা শহর এবং এখানকার কোটি কোটি মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফুড চেইনের কারণে ঢাকার মানুষ নানা রোগব্যাধির সাথে এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। আশা করছি সরকার এ বিষয়ে আর কোনো ছাড় দিবে না। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ট্যানারির কারনে শুধুমাত্র পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, ঢাকা থেকে ট্যানারি সরানোর বিকল্প নেই। আমরা প্রস্তুত আছি। সরকারের নির্দেশ পেলেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্যানারি কারখানাগুলো বন্ধ করে দিব।
এক সময় হাজারীবাগের ট্যানারি ছিল পুরান ঢাকার অভিশাপ। এখন তা হয়েছে পুরো ঢাকার জন্য বড় অভিশাপ। বছরের পর বছর ধরে ট্যানারির বর্জ্যে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গা এখন বিষের নদীতে পরিণত হয়েছে। সেই বিষ ঢাকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বালু ও তুরাগ নদী দিয়ে। এসব নদীর তীরঘেঁষে জমিতে যেসব ফসল ফলানো হচ্ছে সেগুলোতেও মিশে যাচ্ছে বিষাক্ত পদার্থ। আর সেগুলো খেয়ে ঢাকার বাসিন্দারাও বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আখতার হোসেন খান বলেন, ট্যানারির বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা এখন আর নদী নেই, হয়েছে বিষাক্ত কেমিক্যালের আধার। ট্যানারির বিষ শুধু আমাদের নদী শেষ করে দিয়েছে তা নয়, ঢাকার চারিদিকে প্রবাহমান নদীগুলোর তীরঘেঁষে জমিতে যে সব শাক-সবজি বা ফসল ফলানো হচ্ছে সেগুলোতেও বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে যাচ্ছে। এগুলো টাকা দিয়ে কিনে মানুষ নানা ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে বহুগুণ।
হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বহু গবেষণা করেছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানুষের জীবনের ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠেছে সেসব গবেষণায়। ‘রাজধানীর ঘনবসতি এলাকা থেকে ট্যানারি স্থানান্তর জরুরি’-মর্মে একডজনের বেশি সুপারিশমালাও প্রণয়ন করেছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। পরিবেশ বিপর্যয় থেকে লাখ লাখ মানুষকে রক্ষার ব্যাপারে এর আগে কোনো সরকারই ট্যানারি স্থানান্তরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ‘হাজারীবাগ-লালবাগের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের’ বিষ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের সব এলাকায়। রায়েরবাজার, ঝিগাতলা ও ধানমন্ডির বিরাট এলাকাজুড়েই এখন ট্যানারি দূষণে আক্রান্ত। সমীক্ষায় বলা হয়, বর্জ্যরে কারণে ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৩০ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু হাজারিবাগের ১৯৪টি ট্যানারি কারখানা থেকে প্রতিদিন ১৫ হাজার কিউবিক মিটার তরল বর্জ্য সরাসরি নিষ্কাশন হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে আরো ১০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য। পাশাপাশি লালবাগ এলাকার ট্যানারিগুলো থেকে ৭ হাজার কিউবিক মিটার তরল ও পাঁচ হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য মিলেমিশে পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করে চলছে। বিসিকের সমীক্ষায় ট্যানারিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের মাত্রা সম্পর্কে বলা হয়, ট্যানারি শিল্পে নির্গত বর্জ্যরে মধ্যে বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন, কেমিকেল অক্সিজেন, অ্যালকালি মিটি, ক্লোরাইড ও অয়েল এন্ড গ্রিজের মাত্রা অসহনীয়। বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেনের সহনীয় মাত্রা ৬০ থেকে ১০০ ডিমান্ড হলেও হাজারীবাগ-লালবাগ ট্যানারিতে নির্গত হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার ৮শ’ ডিমান্ড পর্যন্ত। কেমিক্যাল অক্সিজেনের সহনীয় মাত্রা ২৫০ থেকে ৩৫০ ডিমান্ড, সেখানে নির্গত হয় ২ হাজার ৪শ’ থেকে ৪ হাজার ২৫০ ডিমান্ড পর্যন্ত। একইভাবে অ্যালকালি মিটি ৭৫০ এমএল সহনীয় মাত্রা হলেও নির্গত হয় ৯শ’ থেকে এক হাজার ৬শ’ এমএল। অসহনীয় পর্যায়ে নির্গত কেমিক্যালগুলো মানবদেহের জন্য চরম বিপদ আনছে বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিনে হাজারীবাগ এলাকা ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ট্যানারির বর্জ্য-বিষের সঙ্গে সহাবস্থান করে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্যানারি শিল্পে কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিক। তাদের অনেকেরই শারীরিক অবস্থা শোচনীয়। অন্যরাও আছে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে। শ্রমিকদের পরিবেশের মারাত্মক দূষণরোধে কোনো ব্যবস্থা আগেও ছিল না, এখনও নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান শেডের এক জরিপ থেকে জানা যায়, ট্যানারির প্রতি এক হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৮৯৪ জন বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে। শেড ১৭৯ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৬০ জনকেই দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগবালাইয়ে আক্রান্ত অবস্থায় দেখতে পায়। ট্যানারি শ্রমিকরা যক্ষ্মা, বুকে ব্যথা, জন্ডিস, জ্বর, আমাশয়, হাঁপানি সর্দি, কাশি, রিউমেটিক ফিভার, ব্লাড প্রেসার ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত রয়েছে বলে ওই জরিপে উল্লেখ করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যুগ যুগ ধরে হাজারীবাগ-লালবাগের ট্যানারি এলাকায় কোনো সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছিল না। ট্যানারি এলাকাজুড়ে বর্জ্য দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও বর্জ্য পরিশোধনের কোন প্ল্যান্টও ছিল না। যে যার মতো করে বর্জ্য ফেলেছে। হাজারীবাগ এলাকার পশ্চিমাংশ আগে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কোন বাঁধ না থাকায় দীর্ঘদিন সব ধরনের বর্জ্য অনায়াসেই বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। ৮০’র দশকের পর ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের কারণে ট্যানারির বর্জ্য আশপাশের ডোবা-নালায় জমা হয়। এরপর বিভিন্ন খাল-নালা হয়ে ব্যাপক দূষণ ঘটিয়ে তারপর নদীতে গিয়ে পড়ছে।
ট্যানার্স এসোসিয়েশনের হিসেব অনুযায়ী, শুধু হাজারীবাগেই প্রায় আড়াইশ’ ট্যানারি ছিল। ছোট-বড় আরও অর্ধশতাধিক ট্যানারি রয়েছে লালবাগসহ আশপাশের এলাকায়। এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ, পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদে ও সুস্থ্য জীবনধারার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে অনেক। কিন্তু তাদের দাবি-দাওয়া, প্রতিবাদ পাত্তা পায় না কখনও। ট্যানারি দূষণের মুখে লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে আছে। পরিবেশ বিপন্নতায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসার আশংকায় তারা তটস্থ থাকেন। এলাকার বাসিন্দা ও পরিবেশবিদরা ট্যানারি শিল্পকে রাজধানীর বাইরে অপেক্ষাকৃত জনশূন্য এলাকায় স্থানান্তরের ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে দাবিও জানিয়ে আসছেন। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়ায় ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যায়ে গিয়ে ২৭টি ট্যানারি আর সরানো যায়নি। শিল্পমন্ত্রী মূলত তাদেরকেই ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন।
জানা গেছে, রাজধানীর পরিবেশ রক্ষায় হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরিয়ে নিতে সাভারে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলা হলেও ব্যবসায়ীরা তাদের আগের স্থান ছাড়তে নারাজ। অথচ বিসিক ও ট্যানারি মালিকদের দুই সংগঠনের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ট্যানারি মালিকদের ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগের সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের কথা ছিল। পরে আরও দুই দফা সময় বাড়িয়ে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। সেটা কার্যকর না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে শিল্পমন্ত্রী ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। তাতেও অবশ্য কাজ হয়নি। তবে সংশ্লিষ্টদের আশা, এবার ট্যানারি শিল্প না সরিয়ে উপায় নাই। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ট্যানারি শিল্পের মালিকরা যেতে চাচ্ছেন না সেখানে নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে এই ভয়ে। তিনি বলেন, ঢাকায় ট্যানারি শিল্প চালু রাখার দায়ে তাদেরকে যদি খেসারত দিতে হতো, তাহলে তারা সহজেই যেতো। তিনি জানান, ট্যানারি শিল্পের মালিক ছাড়াও এ সংক্রান্ত কাঁচামাল, রাসায়নিকদ্রব্য সরবরাহকারীসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীও এর সাথে জড়িত।
২০০৫ সালে সরকার সাভারের হেমায়েতপুরের অদূরে ধলেশ্বরী পাড়ে চামড়া শিল্প প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। সেখানে জায়গা হুকুম দখল, মাটি ভরাট ও বিরাট সীমানা প্রাচীর নির্মাণও করা হয়। কিন্তু রাজধানীর ‘ক্যান্সার’ হিসেবে চিহ্নিত হাজারীবাগ-লালবাগের ট্যানারি শিল্পকে স্থানান্তরে কার্যকরী উদ্যোগ সেই থেকে ঝুলছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকায় ট্যানারির বিষ

১৯ জানুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ