Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহৎ উদ্যোগের সর্বনাশ

১০ টাকায় চাল অনিয়মে ১১ মামলা

প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাবিবুর রহমান : দেশের হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের উদ্যোগে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। ৫০ লাখ মানুষকে এ চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সরকারের এ মহৎ উদ্যোগের সর্বনাশ করছে প্রশাসনের দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। তারা সরকারের মহৎ উদ্যোগকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। অবশ্য খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ইতোমধ্যেই ১১টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এতে আসামির সংখ্যা ২২ জন। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
চাল বিতরণ কর্মসূচির ডিলার নিয়োগে দলীয়করণের পর তালিকা প্রণয়ন ও কার্ড বিতরণে চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। এ তালিকায় হতদরিদ্রদের পরিবর্তে নাম রয়েছে দলীয় নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, মহাজনসহ সচ্ছল ও বিত্তবানদের। আবার কার্ড বিতরণের জন্য নেয়া হচ্ছে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। যারা চাল পাচ্ছেন তাদের ১-২ কেজি করে কম দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, হতদরিদ্রের নামে সচ্ছল ব্যক্তিরা এ চাল তুলে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে, ওজনে কম দেয়ার অভিযোগ ওঠার পর খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ৯ অক্টোবর আট বিভাগে আটটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এসব কমিটি হতদরিদ্রদের তালিকা করা, ডিলার নিয়োগ ও চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে। এতকিছুর পরেও বিভিন্ন জেলায় চাল বিতরণে অনিয়ম দুর্নীতি দূর হচ্ছে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দশ টাকায় চাল বিতরণ করাটা সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। সরকারের যে কোনো উদ্যোগ জনগণের জন্য ভালো। কিন্তু মাঝখানে কিছু ব্যক্তিও ব্যবসায়ী এটাকে ব্যবসার দিকে নিয়ে যায় তখন আর সরকারের উদ্যোগ ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয় না। আমার মতে, সরকারের উচিত হবে হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল তারাই যেন পায় সে ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, সরকার যদি ওয়াদা দিয়ে থাকে তবে তা বাস্তবায়ন করা ভালো। তবে তা স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। দলীয় নেতা-কর্মীরা অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজি চাল তারাই পাক আমরা সেটা দেখতে চাই।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে অনিয়মের অভিযোগে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী, নওগাঁর বাদলগাছী ও রাণীনগর, কুমিল্লার চান্দিনা, যশোরের মনিরামপুর, শরিয়তপুরের জাজিরা, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, ময়মনসিংহের নান্দাইল, দিনাজপুরের বিরল, কুমিল্লার তিতাস, পাবনার চাটমোহর, বরিশালের গৌরনদী, দিনাজপুরের বিরল, খানসামা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও মুকসুদপুর, শরীয়তপুর সদর, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, পটুয়াখালীর বাউফল এবং জামালপুর সদর উপজেলায় ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে।
আর ওজনে কম দেয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত নওগাঁর বাদলগাছীর একজন ডিলারকে ৫০ হাজার টাকা, রাণীনগর উপজেলায় একজন ডিলারকে ৫ হাজার টাকা, নওগাঁ সদর উপজেলার একজন ডিলারের ২ জন কর্মচারীকে ১০ হাজার টাকা এবং রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার একজন ডিলারকে ১০ হাজার টাকাসহ মোট ৫ জনের কাছ থেকে মোট ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে। কুমিল্লার চান্দিনায় ২ জন ডিলারকে ২৫ হাজার টাকা, যশোরের মনিরামপুরের ডিলার শহিদুল ইসলাম শাহিনকে ১০ হাজার টাকা, শরিয়তপুরের জাজিরার ডিলার মোঃ মোবারক চকদারকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কালোবাজারে চাল বিক্রির অভিযোগে বগুড়ার শাহজাহানপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত একজন ডিলার ও ২ জন ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে।
এছাড়া, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে একজন, ময়মনসিংহের নান্দাইলে ২৪ জন, বরিশালের গৌরনদীতে ২ জন, কুমিল্লার তিতাসে একজন, পাবনার চাটমোহরে একজন, দিনাজপুরের বিরলে একজন ও খানসামায় একজন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও মুকসুদপুরে ৩ জন, শরীয়তপুর সদরে একজন, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ২ জন, পটুয়াখালীর বাউফলে একজন, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে একজন এবং জামালপুর সদর উপজেলায় একজনের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি দরে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ১৪ জন ডিলারের মাধ্যমে চাল বিতরণ করা হলেও প্রকৃত হতদরিদ্ররা চাল না পাওয়ায় তাদের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অসহায় হতদরিদ্ররা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়েও চাল পাচ্ছে না। এলাকায় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীসহ আবার কোনো কোনো এলাকায় একই পরিবারের একাধিক সদস্যরা পাচ্ছেন এ চাল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা স্বীকার করে বলছেন, ১০/১৫ বছর আগের চেয়ারম্যানদের করা তালিকা অনুযায়ী চাল বিতরণে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আর এ সুযোগে কতিপয় ডিলার কালোবাজারে চাল বিক্রিসহ নিজের মনগড়া মতো তালিকা তৈরি করে চাল বিতরণ করায় প্রকৃত হতদরিদ্ররা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে চাল বিতরণের নানা অভিযোগ নিয়ে সারা দেশেই তোলপাড় শুরু হয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচনের আগে অনেক ওয়াদা দেয়, আর ক্ষমতায় গেলে তা করে না। যখন দেখে সামনে নির্বাচন তখন কিছু করতে চায়। এটা আওয়মী লীগের স্ট্যান্টবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন, গতকাল সচিবালয়ে খাদ্যমন্ত্রী নিজেই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ৪০ জন ডিলারের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। এতে করে প্রমাণ হয় সরকার সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি করছে। দুদু আরো বলেন, ২০০৭ সালে যে ওয়াদা দিয়েছিল তা এখন পূরণ করতে চাইছে। জনগণ বিষয়টি বুঝছে।
অপরদিকে, খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, কালোবাজারে চাল বিক্রি বা কোনো অনিয়মের বিষয়ে তিনি কোনো অভিযোগ পাননি। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানদের তালিকা অনুযায়ী চাল বিতরণ করা হচ্ছে। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জালাল উদ্দিন বলেছেন, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কার্ড বিতরণে এবং মাপে কম দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে সদর উপজেলার হরিদাশপুর ইউনিয়নে ওজনে কম দেয়ার বিষয়ে একটি অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গতকাল সচিবালয়ে বলেছেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য ১১টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এতে আসামির সংখ্যা ২২ জন। এর মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ কর্মসূচিতে অনিয়ম করা চেয়ারম্যান, মেম্বার, ডিলার ও কার্ডধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন, অনিয়ম করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হচ্ছে, অনিয়মের মাধ্যমে যারা তালিকা প্রণয়ন করেছেন তারা যে দলেরই হোক, সরকারি দলের হোক, বিএনপির হোক আর নিরপেক্ষ হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মহৎ উদ্যোগের সর্বনাশ

১৯ অক্টোবর, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ