Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভার চট্টগ্রাম

প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আইয়ুব আলী : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় দেশ বাংলাদেশ। পাহাড়, নদী ও প্রকৃতির ছায়া সুনিবিড় এ জনপদের পুরোটাই যেন পর্যটনের বিশাল ক্ষেত্র। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা থেকে শুরু করে বহু বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করেছে বাংলাদেশের পর্যটন। দেশের পর্যটন শিল্পের অফুরন্ত সম্ভারের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে যে কটি পর্যটন স্পট রয়েছে সেগুলোর উন্নয়নে সরকার বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে বছরান্তে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন করতে পারে।
যেখানে থাইল্যান্ড, নেপাল, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর শুধু পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছে, সেখানে আমাদের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে এগুলোই বেসরকারি উদ্যোক্তার সৃষ্টি হবে, দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে উৎসাহ ও আগ্রহের সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন এলাকার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলা অন্যতম। এছাড়া কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, নাটোর, পাহাড়পুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, দ্বীপ জেলা ভোলা পর্যটনের বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রামের যে কটি পর্যটন স্পট রয়েছে এবং যেসব স্থানে পর্যটনের সম্ভাবনা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে সেগুলোর উন্নয়নে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বর্তমান বিশ্বে পর্যটনশিল্প একটি লাভজনক ব্যবসা। এটাকে পাশ কাটিয়ে থাকার অবকাশ নেই। চট্টগ্রামে রয়েছে পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভার।
চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও কক্সবাজারের রয়েছে বিপুল সুনাম। চট্টগ্রামের বিনোদন স্পটগুলোর মধ্যে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, কাপ্তাই লেক, চট্টগ্রাম শিশুপার্ক ও কর্ণফুলী শিশুপার্ক, ফয়’স লেক, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, সীতাকু- ইকোপার্ক, জিয়া জাদুঘর, নৌবাহিনী জাদুঘর, সীতাকু-ের চন্দ্রনাথ পাহাড়, ওয়ার সেমিট্রি, ডিসি হিল ও লালদীঘির পার্ক, পারকী বিচ, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, রাঙ্গামাটি, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বান্দরবান, মহেশখালীর পার্ক ও বৃহত্তর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এসব পর্যটন স্পটের বাইরেও বর্তমানে নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে হিলটপ পার্ক।
রাঙ্গামাটি : পাহাড়ঘেরা নীরব প্রশান্তির শহর রাঙ্গামাটিতে যেতে হলে সড়কপথে যেতে হবে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরত্বের এই শহরের প্রতিদিন শহর থেকে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাস ছেড়ে যায়। প্রতিদিন স্পেশাল ও বিরতিহীন ছাড়াও লোকাস বাস ছেড়ে যায় এ শহরমুখে। লোকাল বাসে তিন ঘণ্টা এবং বিরতিহীন বাসে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে রাঙ্গামাটি যেতে। পর্যটনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে স্পিডবোট এবং ইলিশ বোট। পাহাড়ঘেরা সুন্দর চাকমা বাড়িটি রাঙ্গামাটির হ্রদের সৌন্দর্যের একটি। প্রতিবছর রাঙ্গামাটি আদিবাসীদের ঐতিহ্য রাজ্যপুনাহ মেলা এই জনগোষ্ঠীর প্রধান মেলা।
কক্সবাজার : বাংলাদেশের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত বলতে কক্সবাজারকে বোঝায়। চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে যার অবস্থান। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত (১২০ কিলো) বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশির সাথে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে বিশাল বর্ণময় বালুতটের। এই সৌন্দর্য প্রাকৃতিক পরিবেশে পাহাড় ঝর্ণা, হিমছড়ি ইনানীর সুবিশাল পাথর ও বালু সম্মিলন পর্যটনের আকর্ষণ করে বেশি।
পতেঙ্গা : চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত সৌন্দর্যে ঘেরা এ সৈকত বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন এ সৈকতকে ঘিরে মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া বাস, মেক্সি ও টেম্পো করে চট্টগ্রাম শহরের যে কোন স্থান থেকে এই সৈকতে পৌঁছানো যায়।
চট্টগ্রাম শিশুপার্ক ও কর্ণফুলী শিশুপার্ক : চট্টগ্রামে শিশুদের বিনোদনের সুবিধার নিমিত্তে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিনোদন কেন্দ্র। এ শিশুপার্কে রয়েছে শিশুদের জন্য বিনোদনের বিভিন্ন আইটেম। প্রায় ৪টি আইটেমে সাজানো এ বিনোদন কেন্দ্রে রয়েছে চুকচুক গাড়ি, ভয়েজার বোট, মেরি গোডাউন, রেসি গোডাউন, রেসিংকার, দোলনা ছাড়াও অন্যান্য বিনোদন সুবিধা। আধুনিক প্রযুক্তির ক্যাবলক রেসিংকার, ভয়েজার বোট, ক্যাবল ট্রেন, দোলনা এবং অন্যান্য সামগ্রী। ডিজনী ল্যান্ডের আদলে গড়া এই কর্ণফুলী শিশুপার্কের গেইট সবাইকে আকর্ষণ করবে বেশি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর এই শিশু পার্কটি শিশদের বিনোদনের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করবে। কিন্তু এই দুটি পার্কে এখন শিশুদের চেয়ে বুড়োদের ভিড় বেশি লক্ষ্য করা যায়।
ওয়ার সেমিট্রি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিকে স্মরণে রাখার মানসে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম ওয়ার সেমিট্রি। ৭৫৫ জন সৈনিকের সমাধির সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেইভস কমিশন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ ওয়ার সেমিট্রি। চট্টগ্রাম শহরের কক্সবাজার সংলগ্ন চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের পাশেই গড়ে উঠেছে নীরব প্রকৃতি ঘেরা এ স্মৃতিসৌধ। কুমিল্লার ময়নামতিতে এ ধরনের আরও একটি ওয়ার সেমিট্রি রয়েছে।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর : এশিয়া মহাদেশের মধ্যে জাতিতত্ত্বের বিষয় কেন্দ্রিক যে কটি জাদুঘর রয়েছে তন্মধ্যে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরটি সামগ্রিকভাবেই উল্লেখযোগ্য। জাদুঘরের প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে দেশ-বিদেশের একটি জাতি (বাংলাদেশী), বারোটি জনগোষ্ঠী এবং ছাব্বিশটি মৌলগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবন বৈশিষ্ট্য। চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের পরিচিতি দেশের বাইরে ব্যাপক প্রচার পেলেও এদেশের অনেকেই জানেন না চট্টগ্রামে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এত সুন্দর একটি জাদুঘর রয়েছে। প্রায় ৩ একর জায়গার ওপর এটির প্রথম পর্বের কাজ শুরু হয়েছিল গত শতকের শুরুর দিকে। এরপর ১৯৭৮ সালে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নেয়া হলে আরও ৪টি নতুন কক্ষ নির্মিত হয়। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি হলঘর এবং এর পশ্চিম ও পূর্বাংশের প্রতিটি দিকে পাশাপাশি দুটি করে হলঘরমুখী মোট চারটি গ্যালারি নির্মিত হয়েছিলো।
১৯৮৫-৯৫ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাধীনে পূর্বাংশের গ্যালারি দুটির প্রতিটিতে আরও একটি করে মোট দুটি কক্ষ নির্মিত হয়। জাদুঘরের সামনে বিস্তৃত খোলা জায়গা রয়েছে। সেখানে গড়ে উঠতে পারতো নয়নাভিরাম ফুলের বাগান। কিন্তু এত বড় জায়গাটি একরকম খালিই পড়ে রয়েছে। জাদুঘর ভবনটি শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত হওয়ায়এটির অবস্থান সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল নয় অথচ এখানে যারা আসেন তারাই জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের প্রদর্শনী দেখে চমৎকৃত হন।
জিয়া জাদুঘর : চট্টগ্রামের জিয়া জাদুঘরটি বৃটিশ শাসন আমলে কুঠিরবাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিলো। এই জাদুঘরটিতে মোট ১২টি গ্যালারি উপস্থাপনের মাধ্যমে ৭৪৩টি নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত নিদর্শনের মধ্যে বস্তুগত নিদর্শন রয়েছে। মোট দলিল রয়েছে ১২টি। জাদুঘরে গ্যালারি, পাঠাগার ছাড়াও একটি মিলনায়তন স্থাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী চেতনাকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই সকল গ্যালারি স্থাপন করা হয়েছে। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সংগ্রামী জীবন এবং কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে জাদুঘরের প্রদর্শনীর মাধ্যমে। দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘর।
ডিসি হিল : চট্টগ্রামের আরেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হলো ডিসি হিল পার্ক। বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে এখানে মেলা বসে। এছাড়া ডিসি হিলে স্থায়ীভাবে একটি উন্মুক্ত মঞ্চও রয়েছে। মঞ্চের সামনে বিশাল দর্শক গ্যালারি। পাহাড়ের উঁচু-নিচু ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে ডিসি হিল পার্কে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন।
ফয়’স লেক ও চিড়িয়াখানা : চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত পাহাড়ের পাদদেশে লেক সমৃদ্ধ এ বিনোদন কেন্দ্র ফয়’স লেক। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা এ লেক দর্শনার্থীদের একটু হলেও বিনোদন চাহিদা পূরণ করছে। ফয়’স লেকের সামনেই গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা।
সীতাকু- ইকোপার্ক : চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সীতাকু- চন্দ্রনাথ মন্দির ও ইকোপার্ক। পাহাড় ও অরণ্য ঘেরা এ অঞ্চল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অনেক উপরে অবস্থিত। সীতার পুণ্যভূমি খ্যাত এই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠতে হলে একটু বেগ পেতে হয়। বেশ উঁচুতে সিঁড়ি ভেঙে এই পাহাড়ে উঠা বেশ কষ্টসাধ্য হলেও এর সৌন্দর্য দেখে সবাইকে মুগ্ধ করতে পারে এর প্রকৃতি। অন্যদিকে চন্দ্রনাথ মন্দিরের একটু আগেই এ ইকোপার্ক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভার চট্টগ্রাম
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ