পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
৩ লাখের নামে মামলা : প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা প্রান্তিক কৃষকদের
সোহাগ খান : বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। তবে যেসব প্রান্তিক কৃষকদের মাধ্যমেই এই বিপ্লব তাদের অনেকেই আজ ঘরছাড়া কিছু অতিউৎসাহী ব্যাংকারের কারণে। গড়ে মাত্র ২০ হাজার টাকা ঋণের দায়ে মামলা করা হয়েছে তিন লাখ কৃষকের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় ঘরছাড়া আছেন প্রায় ২৪ হাজার। এদের অধিকাংশই নানা প্রাকৃতিক ও মানবঘটিত দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণ খেলাপি হয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা না করার নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও আমলে নিচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
কৃষকের এই নাম মাত্র ঋণগুলো মাফ করে দিয়ে তাদের নতুন করে বাঁচার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। তিনি বলেন, বড় বড় অনেক ঋণও তো মওকুফ করে দেয়া হয়। বছরের পর বছর হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করে হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হচ্ছে। সে প্রেক্ষিতে সরকারের উচিত অসহায় কৃষকদের বিষয়টি বিবেচনায় আনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বছরের সেপ্টেম্বর ভিত্তিক খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের দায়ে মামলায় পড়েছেন ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫শ’ ৪৭ জন প্রান্তিক কৃষক। এই কৃষকদের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের পাওনা মাত্র ৬শ’ ১৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, রাজাশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের করা মামলায় ওয়ারেন্ট জারি হওয়ায় সারাদেশে ঘরছাড়া আছেন ২৩ হাজার ৭৮৫ জন কৃষক।
ব্যাংক খাত থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যবসার নামে দেশের বাহিরে পাচার করছে একটি সিন্ডিকেট। এরা বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর গলিয়ে পার পেয়ে গেলেও মাত্র ২০ হাজার টাকা ঋণের দায় থেকে পার পাচ্ছেন না গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার ৬ নং ঘুড়িদহ ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মন্জু। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাঘাটা শাখার ২০ হাজার টাকার ঋণের দায়ে করা সার্টিফিকেট মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়ে আছে তার নামে। যার ফলে তিনি গ্রামে গিয়ে ঠিকভাবে চাষাবাদও করতে পারেন না। ফলে ঋণ পরিশোধ করার আর কোন সুযোগ নেই এই প্রান্তিক কৃষকের। কৃষি ঋণের হয়রানি বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। তিনি বলেন, একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যার সুদৃষ্টিই পারে ব্যাংকগুলোর এই হয়রানি থেকে আমাদের মত তৃণমূল জনগণকে মুক্তি দিতে।
শুধু মোস্তাফিজুর রহমান মন্জুই নয়, এরকম আওয়া লীগের ত্যাগী ও তৃণমূল পর্যায়ের প্রায় ৪০ জন নেতার নামে মামলা করেছেন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাঘাটা শাখার ম্যানেজার। যাদের সকলের নামেই ওয়ারেন্ট জারি হওয়ায় তারা এখন ঘরছাড়া। সারাদেশে মামলার শিকার ৩ লাখ প্রান্তিক কৃষকের মাঝে প্রায় দেড় লাখ আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মী যাদের ওপর ভর করেই সরকার দেশ চালাচ্ছে। কিন্তু দল ক্ষমতায় থাকতেই ব্যাংগুলোর এই হয়রানিতে অতিষ্ট হয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়তে হয়েছে অনেককেই।
এবিষয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা ম্যানেজার বলেন, আওয়ামী লীগ করে বিধায় টাকা দিবে না তা তো হয় না। আমি শাখায় নতুন এসেছি। যতগুলো খেলাপি পেয়েছি সব নিলাম ডেকে মামলা করে দিয়েছি। সার্টিফিকেট মামলায় ওয়ারেন্টও করিয়েছি। সঠিক সংখ্যা জানতে চাইলে শাখা স্বশরীরে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলেন তিনি।
২০১০ সালে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাঘাটা শাখা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন মথরপাড়া গ্রামের কৃষক শেখসাদী। তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত নিয়মিত কিস্তি দিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০১৩ সালে শেখসাদী প্রায় ৬ একর জমিতে আলু চাষ করেন। ফলনও হয় বাম্পার। একরে প্রায় ১২০ মণ। ৬ একর আলু চাষে তার খরচ হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। কিন্তু আলু বিক্রি করার সময় শুরু হয় রাজনৈতিক দুর্যোগ। সারা দেশে হরতাল-অবরোধের কারণে বিপাকে পড়ে যান এই চাষী। ২০ টাকা কেজির আলু তাকে বিক্রি করতে হয় মাত্র দেড় থেকে দুই টাকা কেজিতে। আবার অবরোধ এর কারণে কোন হিমাগার মালিকও রাখেননি তার আলু। টাকা নিয়ে হিমাগার মালিক পিছনে ঘুরেও হয়নি কোন কাজ। ফলে বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন প্রায় ২শ’ মণ আলু। এই কৃষকের আলুর উৎপাদন খরচ ছিল দেড় লক্ষ টাকা। বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র ৪০ হাজার। ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ক্ষতি কাঠিয়ে উঠতে পারেনি এই কৃষক।
কিন্তু ইতিমধ্যেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সার্টিফিকেট মামলা দিয়ে জমি নিলামে তুলেছেন। জমি বিক্রি না হওয়ায় এখন তার নামে অর্থঋণের মামলা চলমান গাইবান্ধা জেলা কোর্টে। মাসে একবার হাজিরা দিতে হয় জেলা সদরে। একটি হাজিরা মিস হলেই ওয়ারেন্ট জারি হয় বিধায় মাসে ৫শ’ টাকা খরচ হলেও তিনি কোর্টের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ছয় সন্তানের মালিক এই বৃদ্ধ। মানব সৃষ্ট ক্ষতিতে তিনি এখন মামলায় ফেসেছেন। শুধু মামলা থাকায় অন্যকোন ব্যাংকে ঋণের আবেদন করতে পারছেন না তিনি।
একই অবস্থা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধাবকাই গ্রামের কৃষক রউফ মিয়ার। গতবছর ২ একর জমিতে ধানের আবাদ করার জন্য ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের দিরাই শাখা থেকে। কিন্তু ধান মাঠ থেকে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে অকালে বন্যায় ডুবে গেছে তার ফসল। বন্যার কারণে একমুঠো ধান না পেলেও তিনি ব্যাংকের দায়ের করা সার্টিফিকেট মামলায় এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ সুনামগঞ্জের হাওড় ডুবির খবর প্রধান সারির সকল পত্রিকার শিরোনাম ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হওয়া তথ্য অনুযায়ী, কৃষকদের নামে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে বিকেবি। এই ব্যাংকটি একাই ৯০ হাজার ৮৩১ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ মাত্র ৩৪৩ কোটি টাকা। বিশেষায়িত আরেক ব্যাংক রাকাব ১৭৭ কোটি টাকার জন্য ৮৮ হাজার ৫১১ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে অগ্রণী ব্যাংক। এই ব্যাংকটি জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা ঋণের (মোট ৭৮ কোটি টাকা) জন্য ৪৮ হাজার ৯০০ কৃষকের নামে মামলা করেছে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংক ১৭ হাজার ৯৫৯ জন, জনতা ব্যাংক ১৮ হাজার ৬৩৫ জন এবং রূপালী ব্যাংক ১ ৩ হাজার ৩৯ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব মামলায় দরিদ্র এমন অনেক কৃষক আছেন যারা জন্ম সূত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থক, ত্যাগী নেতা, ও তৃণমূল কর্মী। যারা দল ক্ষমতার কোন সুবিধায় তখনো ভোগ করতে পারেনি। আর শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ব্যাংক থেকে নেয়া কৃষি ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি তারা। এদের অনেকের ৫ হাজার টাকার মূল ঋণ ১০ থেকে ১৫ বছরে সুদে-আসলে বেড়ে দ্বিগুণ বা তার বেশি হয়ে গেছে। ফলে অর্থ পরিশোধ করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ মামলা থাকায় নতুন করে তারা কোনো ব্যাংক ঋণ নিতে পারছেন না। ফলে অর্থ পরিশোধের সুযোগও পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, ছোট ছোট এই ধরনের কৃষি ঋণের বিপরীতে মামলা বা গ্রেফতারি পরোয়ানায় না গিয়ে বরং ব্যাংকগুলোকে কৃষকদের কাছ থেকে নমনীয়ভাবে অর্থ আদায়ের পরামর্শ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর ফলে কৃষকদের হয়রানি কমে যাবে। তবে ব্যাংকগুলো যে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা কানে তুলছে না প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গত ছয়মাসেই কৃষি ঋণের মামলা বেড়েছে প্রায় এক লাখ। চলতি বছরের মার্চের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সারা দেশে অনিষ্পন্ন সার্টিফিকেট মামলার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৮৩টি। আর জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৮১ কোটি টাকা।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ঋণ আদায়ে তাদের আইনি বাধ্য-বাধকতা থাকার কারণেই মামলায় যেতে হচ্ছে। তবে মামলা না করে বিকল্প পদ্ধতিতে টাকা আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানান তারা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অল্প কিছু টাকার জন্য প্রান্তিক কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা করার এই বাধ্যবাধকতা থেকে ব্যাংকগুলোর সরে আসা উচিত। তাদের মতে, শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে অনেকে বছরের পর বছর আটকে রাখছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না ব্যাংক। অথচ মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার জন্য কৃষকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে তাদের ঋণ মওকুফ করা উচিত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, প্রান্তিক কৃষকদের হয়রানি বন্ধে ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৩টি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। তবে হঠাৎ করে কৃষকদের বিরুদ্ধে সামান্য কিছু অর্থ আদায়ে মামলার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। অতি উৎসাহী শাখা ব্যবস্থাপকদের কারণেই মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমার ধারণা। যদি কোন ব্যবস্থাপক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নতুন করে আরও মামলা করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্ব-স্ব ব্যাংকে সুপারিশ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।